কালোজিরেতে পাওয়া গেল হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন? তথ্যটি সম্পূর্ণ সত্য নয়
একটি গবেষণায় বলা হয়েছে কালোজিরেতে নোভেল করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য প্রতিরোধক আছে, কিন্তু এই বিষয়ে আরও বিস্তরিত গবেষণা জরুরি।
সোশাল মিডিয়া পোস্ট এবং হোয়্যাটসঅ্যাপ মেসেজে সম্প্রতি যে দাবি করা হচ্ছে কালোঞ্জি বা কালোজিরের মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। এই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নামক জৈব-অনু সম্প্রতি নোভেল করোনাভাইরাসের চিকিৎসাতেও বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। বুম দেখেছে ভাইরাল হওয়া দাবিগুলির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই এবং বিভ্রান্তিকর।
কালোজিরের মধ্যে অবশ্যই কিছু ঔষধি গুণাবলী আছে এবং বহু রোগের ক্ষেত্রেই কালোজিরেকে প্রাকৃতিক প্রতিষেধক হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু যে নতুন করোনাভাইরাসটির সংক্রমণে কোভিড-১৯ হয়, কালোজিরে তার ক্ষেত্রেও কার্যকরী কিনা, তার প্রমান পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
২০২০ সালের একটি গবেষোণায় দেখা গেছে যে কালোজিরেতে এসএআরএস-কোভ-২ এর সংক্রমণ রুখে দেওয়ার সম্ভাব্য উপাদান রয়েছে। কিন্তু, এখনও অন্য কোনও গবেষণায় এখনও এই তত্ত্বকে পরীক্ষা করে দেখা হয়নি, ফলে কালোজিরেতে সম্ভাব্য করোনা প্রতিষেধক থাকার সত্যতা এখনও প্রমাণিত হয়নি।
বিশ্বের ১৮৫টি দেশের ২৯ লাখ মানুষ এখনও পর্যন্ত কোভিড-১৯'এ আক্রান্ত হয়েছেন। বহু দেশে এই ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসায় বিশেষ ক্ষেত্রে ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও এখনও পর্যন্ত এই অসুখের কোনও নিশ্চিত নিরাময় খুঁজে পাওয়া যায়নি। ম্যালেরিয়া প্রভাবিত অঞ্চল বলে ভারতের বহু ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা স্বাভাবিকভাবেই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন তৈরি করে, ফলে বেশ কিছু দেশ ভারতের কাছ থেকে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন চাইছে। ভারত থেকেও ইতিমধ্যে ৫৫ টি দেশে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: হোমিওপ্যাথি ওষুধ আর্সেনিকাম অ্যালবাম ৩০ কি করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করে? একটি তথ্য যাচাই
ভাইরাল হওয়া একটি হোয়্যাটসঅ্যাপ মেসেজে দাবি করা হয়েছে কালোজিরেতে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন রয়েছে এবং প্রতি দিন সকালে খালি পেটে কালোজিরের সাতটি দানা মধুর সঙ্গে খেলে করোনাভাইরাস সংক্রমণকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এ ছাড়া আরও একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে। 'ফক্স নিউজ' চ্যানেলের একটি বুলেটিনের ভিডিও, যেখানে ক্লোরোকুইনের আবিষ্কার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, সেই ভিডিওটিকে এডিট করে তাতে কালোজিরের গুণাগুণ লেখা একটি গ্রাফিক যোগ করা হয়েছে। 'ফক্স নিউজ' চ্যানেলের মূল কভারেজে এই গ্রাফিকটি ছিল না। বুম নীচের ভিডিওটি তার হোয়্যাটসঅ্যাপ হেল্পলাইনেও পেয়েছে।
এই দাবিটি ফেসবুকেও বিভিন্ন ছবির সঙ্গে ভাইরাল হয়েছে। তবে বিভিন্ন পোস্টে কালোজিরের দানা খাওয়ার সংখ্যাটা বদলে গেছে।
আরও পড়ুন: এই ছবিগুলি আর ভিডিওটিতে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেখানো হচ্ছে না
তথ্য যাচাই
বুম দেখতে পায় ২০২০ সালের ১৮ মার্চ তারিখে নেচার জার্নালে সর্বপ্রথম জিয়া লিউ এবং রুইউয়ান চাও এবং অন্যান্যদের একটি পিয়ার রিভিউ করা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় যেখানে বলা হয়েছে ক্লোরোকুইনের একটি অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত সহ-যৌগ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন এসএআর এস-কোভ-২ কে টেস্ট-টিউবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে।
ভাইরাল তথ্যের সন্ধানে বুম কিছু গবেষণা খুঁজে পায় যেখানে কালোজিরের ঔষধেয় গুনাগুনের কথা আলোচনা করা হয়েছে। একটি গবেষণায় এরকমও দাবি করা হচ্ছে যে কালোজিরে হয়তো কোভড-১৯ প্রতিহত করতে পারবে। আরেকটি গবেষণা বলছে কালোজিরে এবং ক্লোরোকুইন দিয়ে ম্যালেরিয়া প্রতিহত করা সম্ভব। কিন্তু এখনও সব গবেষণা প্রাথমিক অবস্থায় আছে তাই এই ব্যাপারে দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
যদিও বুম কোন গবেষণা খুঁজে পায়নি যেখানে কালোজিরেতে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন থাকার কথা বলা হয়েছে।
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কালোজিরে
বুম একটি সাম্প্রতিক গবেষণার খোঁজ পায় যেখানে কালোজিরের মধ্যে এসএআরএস-কোভ-২ এর সম্ভাব্য প্রতিরোধকের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এই গবেষনাগুলি গবেষণাগারে টেস্টটিউবে সম্পাদন করা হয়েছিল। এই গবেষনায় কালোজিরে থেকে লব্ধ উপাদানকে অন্য অনুর সাথে মিশিয়ে মলিকুইলার ডকিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জিন-বিশ্লেষণে প্রাপ্ত নোভেল করোনাভাইরাসের একটি বিশেষ প্রোটিয়েজকে নিশানা করা হয়েছিল।
মলিকিউলার বা আণবিক ডকিং হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে পারমাণবিক স্তরে একটি ক্ষুদ্র অনুর সাথে একটি প্রোটিনের বিক্রিয়ার ধরনগুলো বের করা হয়। যার সাহায্যে নির্দিষ্ট একটি ক্ষুদ্র অনুর বৈশিষ্ট সম্পর্কে এবং সেই অনুর একটি নির্দিষ্ট প্রোটিনের বাইন্ডিং সাইটে কিভাবে রোধক হিসেবে কাজ করে সেই বিষয়ে অবগত হওয়া যায়। প্রোটিয়েজ হচ্ছে প্রোটিন বিশ্লেষণকারী উৎসেচক, এই উৎসেচকগুলিও সরলতম প্রোটিন দিয়েই তৈরি হয়। যে আলজেরিয়র গবেষকরা উক্ত গবেষণাটি করেছেন তারা অ্যান্টি-ভাইরাল অর্থাৎ ভাইরাস বিনাশকারী গুনাগুন থাকার জন্যই কালোজিরেকে বেছে নিয়েছিলেন।
এই বিজ্ঞানীরা আরও জানিয়েছেন যে গবেষণাগারের টেস্ট টিউবে হওয়া এই পরীক্ষা আরও বেশি মাত্রায় অন্যান্য গবেষণাগারে করে দেখা প্রয়োজন। তবেই বোঝা যাবে যে যৌগ নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন তা সত্যিই কি এই নোভেল করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারবে কিংবা পরে এই ভাইরাসের চিকিৎসায় তা ব্যবহার করা যাবে কি না।
আরও পড়ুন: মাস্ক কি ভাইরাস ধ্বংস করতে পারে? একটি তথ্য যাচাই
কালোজিরের বৈজ্ঞানিক নাম নাইজেলা স্যাটিভা এবং এর ঔষধি গুণাবলি রয়েছে। চরম স্নায়বিক ও মানসিক অসুখ, হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবিটিস, বিভিন্ন প্রদাহ এবং প্রজনন অক্ষমতার মতো বিভিন্ন অসুখের চিকিৎসায় কালোজিরের কার্যকরী ব্যবহার হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, পরজীবী ও ভাইরাল সংক্রমণের কারণে বিভিন্ন সংক্রামক অসুখের ক্ষেত্রেও কালোজিরের ব্যবহার হয়। এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধেও কালোজিরের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কালোজিরেতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকার ফলে সাম্প্রতিক কালে এটি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং এর কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকায় একে প্রতিস্থাপক খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করার সম্ভাবনাও রয়েছে।
ক্লোরোকুইন আর কালোজিরে
ইঁদুরের মধ্যে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে ক্লোরোকুইনের সাথে কালোজিরের উপাদান মিশিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। দেখা গেছে কালোজিরের উপাদানের উপস্থিতিতে ক্লোরোকুইনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে কালোজিরের উপাদান মিশিয়ে ক্লোরোকুইনের পরীক্ষা করা হয়নি এখনো। কালোজিরেতে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের উপস্থিতি এবং কোভিড-১৯ এর জন্য এর ব্যবহার নিয়ে কোনও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এখনো হয়নি, তাই এই বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে। কালোজিরের সাথে মধু মিশিয়ে প্রাতঃরাশের আগে খেলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হবে না এমন দাবিও অবৈজ্ঞানিক এবং বিভ্রান্তিকর।
আরও পড়ুন: মিথ্যে: বিভিন্ন ধরনের চা পানে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সারতে পারে