বোরখা পরা অনেক মহিলার মাঝে এক নারী, মাথায় কোনও হিজাব ছাড়াই, হাতে বই নিয়ে হাঁটছেন, এবং তাঁকে স্পষ্টতই অন্যদের চেয়ে আলাদা মনে হচ্ছে, এমন একটি চিত্রকলা (Artwork) সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করা হয়েছে। ওই ছবিটি শেয়ার করে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে যে, এই চিত্রকলাটি আফগান গ্রাফিতি শিল্পী শামসিয়া হাসানির (Shamsia Hassani) তৈরি।
বুম যাচাই করে দেখে ভাইরাল হওয়া ছবিটি আসলে চেক প্রজাতন্ত্রের একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার তৈরি চিত্রণ; এবং, ছবিতে মেয়েটির হাতে যে বইটি আছে, তার প্রচ্ছদ সম্পাদনা করে বদলে দেওয়া হয়েছে।
আফগানিস্তানে তালিবানরা ক্ষমতা দখল করার এবং তারপর সে দেশে সরকার গঠন করার পরই এই ছবিটি শেয়ার করা হয়। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে, এক গুরুত্বপূর্ণ তালিবান নেতা মন্তব্য করেছেন যে, মেয়েদের খেলার কোনও 'প্রয়োজন নেই'। তাঁর সেই মন্তব্যের পরই আফগানিস্তানের মহিলা ফুটবল দল পাকিস্তানে পালিয়ে যায়।
মেয়েদের বাইরে বেরোনো বা কর্মরত মহিলাদের উপর তালিবানের বিভিন্ন বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়ার অস্বস্তিকর নানা ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে এসেছে। ইতিমধ্যে আফগান মহিলাদের একটা অংশকে তালিবানদের সমর্থনে বের হওয়া মিছিলে অংশ নিতে দেখা যায়।
ছবিটি শামসিয়া হাসানির তৈরি ছবি বলে টুইটারে ছবিটি ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয়। একজন ব্যবহারকারী ছবিটির সঙ্গে ইংরেজিতে ক্যাপশন লেখেন, "৩৩ বছর বয়সি আফগান গ্রাফিতি শিল্পী এবং কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শামসিয়া হাসানির সৃষ্টি অসাধারণ চিত্রকলা। আমরা যদি শেয়ার করতে থাকি, তবে ইসলামিক স্বর্গ নামক নরকে থাকতে বাধ্য হওয়া নারীরা কিছুটা শক্তি পাবেন।"
টুইটটির আর্কাইভ এখানে দেখতে পাবেন।
কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুরও ছবিটি টুইট করেছেন। পরে তিনি টুইট করে জানান যে, ছবিটি আসলে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার তৈরি। তবে তিনি তাঁর আগে টুইট করা ছবিটিও রেখে দেন।
একই ছবি ফেসবুকেও ভাইরাল হয়েছে, সঙ্গে বাংলায় ক্যাপশন লেখা হয়েছে, "কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা এবং আফগানিস্তানের সুপরিচিত গ্রাফিতি শিল্পী শামসিয়া হাসানির আঁকা ছবি।" এখানে সেরকম দু'টি পোস্ট দেখা যাবে এখানে ও এখানে।
আরও পড়ুন: পাঞ্জাবে এক ধর্মীয় মেলায় মদ বিতরণের ভিডিও কৃষক বিক্ষোভের সঙ্গে জুড়ল
তথ্য যাচাই
বুম ছবিটির উপর রিভার্স ইমেজ সার্চ চালায় এবং দেখতে পায় ভাইরাল হওয়া ছবিটি আফগান গ্রাফিতি শিল্পী শামসিয়া হাসানির চিত্রকলা নয়। হাসানি নিজে টুইট করে এবং তাঁর ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল থেকে এই বিষয়ে জানান।
শামসিয়া হাসানি টুইট করেছেন, "সম্প্রতি আমি লক্ষ্য করেছিযে, বহু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী তাঁদের পেজে এবং প্রোফাইলে আমার চিত্রকলা হিসাবে এই ছবিটি শেয়ার করেছেন। কিন্তু এটি আমার চিত্রকলা নয়। আমি বুঝতে পারছি যে, তাঁরা আমাকে এবং আমার শিল্পকে সমর্থন জানাতেই চাইছেন। কিন্তু এই ছবিটির আসল শিল্পী এই কৃতিত্বের অধিকারী এবং নিশ্চিত করুন যেন তাঁর কাছেই তা পৌঁছায়।"
আসল ছবিটি চেক প্রজাতন্ত্রের ইয়াং অ্যান্ড রুবিকাম নামের একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার তৈরি। তারা এই ছবিটি রিপোর্টার নামের একটি ম্যগাজিনের জন্য তৈরি করে। বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত খবর প্রকাশ করে, এরকম বহু ওয়েবসাইটে এই ছবিটির ক্রেডিট ওয়াইঅ্যান্ডআর-কেই দেওয়া হয়েছে। এরকম দু'টি প্রতিবেদন এখানে এবং এখানে দেখতে পাবেন।
এই একই ছবি দেওয়া রিপোর্টার ম্যাগাজিনের এই ক্যাম্পেনের নাম দেওয়া হয়েছে 'দৃষ্টিভঙ্গি বদলান' এবং ' গোঁড়ামিকে প্রশ্ন করুন'। ২০১৮ সালে রিপোর্টার ম্যাগাজিন সিলিও অ্যাওয়ার্ডস-এ একটি ব্রোঞ্জ পদকও পায়। আসল ছবিতে হিজাবহীন ওই মহিলার হাতে রিপোর্টার ম্যাগাজিন দেখা যায়, ভাইরাল হওয়া ছবিতে যেমন লাল বই দেখা যাচ্ছে, তা নয়।
২০১৮ সালে ওয়াইঅ্যান্ডআর ভ্যালেন্টাইন ম্যাককর্মিক লিজিবেল (ভিএমএল) নামে অন্য একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার সঙ্গে মিশে যায় এবং তৈরি হয় ভিএমএলওয়াইঅ্যান্ডআর।
বুম ওয়াইঅ্যান্ডআর-এর তৎকালীন এক্সিকিউটিভ ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং এজেন্সি প্রোডিউসার টমাসভোরাকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি জানান, "এই চিত্রকলাটি আমাদের তৈরি করা। উল্লেখিত ছবিটির সঙ্গে আমাদের কাজের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। এবং আমরা ছবিটিতে কোনও বদল করার অনুমতিও দিইনি।"
আসল ছবি এবং ভাইরাল হওয়া ছবির মধ্যে একটি তুলনা নীচে দেওয়া হল।
আরও পড়ুন: উত্তরপ্রদেশের হাথরাসের মৃতা নির্যাতিতা বলে সম্পর্কহীন ছবি ফের জিইয়ে উঠল