দিল্লিতে (Delhi) আম আদমি পার্টি (Aam Aadmi Party) সরকারি স্কুলগুলির (School) উন্নতিসাধনে যে চেষ্টা করছে সে বিষয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ (New York Times) একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরই ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP) ও কংগ্রেসের (INC) একাধিক সদস্য এবং সংবাদ চ্যানেল আজতক (AajTak) দাবি করেছে প্রতিবেদনটি সংবাদ (News) নয় বরং বিজ্ঞাপণের (Paid Promotion) অংশ।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন পোস্টে এই দাবির সপক্ষে প্রমাণ হিসাবে বলা হচ্ছে পরের দিনই ঠিক এই প্রতিবেদনটিই সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সংবাদপত্র খালিজ টাইমস (Khaleej Times)-এ প্রকাশিত হয়।
বুম অনুসন্ধান করে দেখে এই দাবিটি ভিত্তিহীন। আমাদের তথ্য যাচাই থেকে জানা যায় খালিজ টাইমস-এ যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল তা নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের পুনর্মুদ্রণ। সেখানে নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং প্রতিবেদনটির লেখক করণ দীপ সিংহের (Karan Deep Singh) প্রতি কৃতজ্ঞতাও স্বীকার করা হয়েছে। তাছাড়া বুম নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ডিরেক্টর অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন (Director of External Communication) নিকোল টেলরের (Nicole Taylor) সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান এই প্রতিবেদনটি অ্যাডভেটোরিয়াল (advertorial) বা বিজ্ঞাপণী প্রতিবেদন এমন দাবি ভিত্তিহীন এবং তিনি নিশ্চিত করেন যে, প্রতিবেদনটি পত্রিকার সংবাদেরই অংশ। তিনি আরও জানান খালিজ টাইমস-এ এনওয়াইটি-র প্রতিবেদনটিই পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
টেলর বুমকে জানান, "দিল্লির শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির প্রচেষ্টা বিযয়ে প্রতিবেদনটি নিরপেক্ষ এবং ক্ষেত্রভিত্তিক সাংবাদিকতার উপর ভিত্তি করে রচিত। নিউ ইয়র্ক টাইমস বহু বছর ধরেই শিক্ষা বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ সাংবাদিকতা চিরকালই স্বাধীন রাজনৈতিক বা বিজ্ঞাপণী প্রভাব থেকে মুক্ত। অন্য অনেক সংবাদমাধ্যম নিয়মিত আমাদের প্রতিবেদন পুনর্মুদ্রণ করে থাকে।"
এনওয়াইটি-র প্রথম পাতায় সংবাদ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পরের দিন, ১৯ অগস্ট, ২০২২, সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (Central Burro Of Investication) দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী (Deputy Chief Minister) মণীশ সিসৌদিয়াকে (Manish Sisodia) বাড়িতে দফায় দফায় তল্লাশি চালায়। সিসৌদিয়া দিল্লি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্বে রয়েছেন, প্রতিবেদনে তাঁর প্রভূত উল্লেখ ছিল। এরপর থেকেই সোশাল মিডিয়ায় এই প্রতিবেদনটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের ঢল নামে। প্রতিবেদনটি পয়সা দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে, এই দাবির পাশাপাশি আমরা আরও একটি ভুয়ো দাবির সন্ধান পাই যাতে বলা হয়েছে, এই প্রতিবেদনের সঙ্গে যে স্কুলের ছবি প্রকাশিত হয়েছে সেটি একটি বেসরকারি স্কুল, আপ-সরকার চালিত সরকারি স্কুল নয়।
যাঁরা এই সংবাদ প্রতিবেদনটিকে বিজ্ঞাপণ বা পয়সা দিয়ে প্রকাশ করা খবর বলে মিথ্যা দাবি করেছেন, তাঁদের অন্যতম বিজেপি-র আইটি সেলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান অমিত মালব্য (Amit Malviya)। তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আপ-এর সর্বোচ্চ নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়ালের একটি ভিডিওর কাটা অংশ শেয়ার করেন, যেখানে কেজরীওয়ালকে এনওয়াইটি-তে এই সংবাদ প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়ার কথা ঘোষণা করে শোনা যাচ্ছে তিনি বলছেন আমেরিকার কোন সংবাদপত্রে কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। মালব্য একটি টুইটে ইংরেজিতে লেখেন "এটা কী করে সম্ভব যে, দিল্লির অস্তিত্বহীন শিক্ষা মডেল বিষয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস আর খালিজ টাইমস একেবারে এক প্রতিবেদন, অক্ষরে অক্ষরে এক, প্রকাশ করল তার লেখকের নামও এক, ব্যবহৃত ছবিও এক (তাও, সেই ছবিটি একটি বেসরকারি স্কুলের)? অরবিন্দ কেজরীওয়ালের শ্রেষ্ঠ রক্ষণকৌশলটি পয়সা দিয়ে করানো খবর বই আর কিছু নয়।"
(মূল ইংরেজিতে লেখা: How is it that New York Times and Khaleej Times carry exactly the same article, word by word, authored by the same person, same pictures (that too of a private school) on Delhi's non existent education model? Arvind Kejriwal's best defence is nothing but paid promotion…)
মালব্যর টুইটটির আর্কাইভ দেখতে ক্লিক করুন এখানে।
দিল্লি বিজেপি-র আইটি সেলের প্রধান পুনীত আগরওয়াল, অল ইন্ডিয়া কিসান কংগ্রেসের চেয়ারম্যান সুখপাল সিং খাইরা, এবং কংগ্রেস সমর্থক গৌরব পান্থীও এই একই দাবি করেন।
এ ছাড়াও হিন্দি সংবাদ চ্যানেল আজতক একটি টুইট শেয়ার করে, যাতে তাদের সংবাদ উপস্থাপক সুধীর চৌধুরীর অনুষ্ঠানের একটি অংশ দেখা যাচ্ছে যেখানে তিনি একই ভ্রান্ত দাবি করছেন। এই সংবাদ অংশটিতে তিনি দাবি করেন যে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিকে দিল্লির শিক্ষা ব্যবস্থার যে পরিমাণ প্রশংসা করা হয়েছে এবং যেভাবে একেবারে একই প্রতিবেদন খালিজ টাইমসেও প্রকাশিত হয়েছে তাতেই বোঝা যায় যে এটি পয়সা দিয়ে ছাপানো প্রতিবেদন।
নীচে দেওয়া ভিডিওটিতে ৫ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের মাথায় সুধীর চৌধুরীকে এই দাবি করতে শোনা যাচ্ছে।
আজতকের করা টুইটটির আর্কাইভ দেখার জন্য ক্লিক করুন এখানে।
আরও পড়ুন: আগরতলায় সিএনজি গাড়িতে আগুন দাবিতে ছড়াল গুয়াহাটির অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা
তথ্য যাচাই
বুম প্রথমে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটির ডিজিটাল ভার্সান দেখে। সেখানে প্রতিবেদনটি পয়সা দিয়ে ছাপানো বা বিজ্ঞাপন এমন কোনও উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়নি।
তাছাড়াও নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ওয়েবসাইটে দেওয়া সংবাদপত্রটির সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী যাঁরা সংবাদের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা কোনভাবেই বিজ্ঞাপণী কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। কাজেই সংবাদপত্রটির স্বঘোষিত সম্পাদকীয় নীতি অনুসারেই তাদের দিল্লির সাংবাদিক এবং প্রতিবেদনটির লেখক করণ দীপ সিং কোনভাবেই বিজ্ঞাপণী প্রচারের জন্য প্রতিবেদন লেখার কাজে যুক্ত থাকতে পারেন না।
এর পর আমরা খালিজ টাইমস-এর ডিজিটাল কপি-র খোঁজ করি। দেখা যায় যে সেই পত্রিকার দশম পৃষ্ঠায় সত্যিই ১৯ অগস্ট, ২০২২ তারিখে এই প্রতিবেদনটিই মুদ্রিত হয়েছিল। এখানেও এমন কোনও কথার উল্লেখ ছিল না যা থেকে মনে হতে পারে প্রতিবেদনটি টাকা দিয়ে ছাপানো হয়েছে, বা এটি কোন বিজ্ঞাপণের অংশ।
খালিজ টাইমস-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা রয়েছে যে এই প্রতিবেদনটি এনওয়াইটি-তে প্রকাশিত এবং প্রতিবেদকের নাম করণ দীপ সিং। এর থেকে অনুমান করা চলে যে, খালিজ টাইমস-এ প্রতিবেদনটি এনওয়াইটি থেকে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
এরপর বুম ভাইরাল হওয়া দাবিটি বিষয়ে মন্তব্যের জন্য এনওয়াইটি-র সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চায় প্রতিবেদনটি বিজ্ঞাপণী প্রচারের অংশ কি না? এই দাবিটিকে খারিজ করে এনওয়াইটি-র ডিরেক্টর অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন নিকোল টেলর জানান যে, প্রতিবেদনটি এনওয়াইটি-র সংবাদের অংশ এবং খালিজ টাইমস-এ সেটিই পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
টেলর বুমকে জানান, "দিল্লির শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির প্রচেষ্টা বিযয়ে প্রতিবেদনটি নিরপেক্ষ এবং ক্ষেত্রভিত্তিক সাংবাদিকতার উপর ভিত্তি করে রচিত। নিউ ইয়র্ক টাইমস বহু বছর ধরেই শিক্ষা বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ সাংবাদিকতা চিরকালই স্বাধীন রাজনৈতিক বা বিজ্ঞাপণী প্রভাব থেকে মুক্ত। অন্য অনেক সংবাদমাধ্যম নিয়মিত আমাদের প্রতিবেদন পুনর্মুদ্রণ করে থাকে।"
খালিজ টাইমস-এ যে প্রতিবেদনটি মুদ্রিত হয়েছে সেটি সিন্ডিকেটেড কনটেন্ট-এর উদাহরণ। এই ক্ষেত্রে সাধারণত বড় সংবাদমাধ্যমগুলি অন্যান্য সংবাদমাধ্যমকে তাদের সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন পুনর্মুদ্রণের অনুমতি দেয়। তার বিনিময়ে একটি সাবস্ক্রিপশন ফি দিতে হয় এবং যথাযথ ভাবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে হয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমস রয়টার্স অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ব্লুমবার্গ ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো সংবাদ সংস্থা তাদের প্রতিবেদনকে এই সিন্ডিকেট ব্যবস্থার মাধ্যমে গোটা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেয়।
ভারতে এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই) এবং প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া-র (পিটিআই) মতো ওয়্যার সার্ভিস সংস্থা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের জন্য এই একই ধরনের ব্যবস্থা চালায়।
আমরা খালিজ টাইমস-এর কাছে তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছি। তাদের মন্তব্য পাওয়া মাত্রই এই প্রতিবেদনটির মাধ্যমে তা প্রকাশ করা হবে।
আরও পড়ুন: ডিনামাইটে আহত বলিভিয়ার প্রতিবাদী জম্মু-কাশ্মীরের ভিডিও বলে ছড়াল