কোন বিমান কোথায় উড়ে চলেছে তা জানার পরিষেবা 'প্লেন-ফাইন্ডার' (Plane Finder) এর নামে একটি স্ক্রিনশট থেকে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে যে, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউক্রেনে একমাত্র বিমান-সংস্থা এয়ার-ইন্ডিয়ার (Air India) (AI121), যার উড়ান সে দেশে আটকে পড়া ভারতীয় নাগরিকদের উদ্ধার করে স্বদেশে ফিরিয়ে আনছে।
গত সপ্তাহে রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসী যুদ্ধ শুরু করার পর সেখানে আটকে-পড়া অসহায় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের দেশে ফিরিয়ে আনার কাতর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই স্ক্রিনশটটি সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
স্ক্রিনশটটিতে দেখানো হয়েছে, অন্য সব বিমানসংস্থার উড়ান যেখানে ইউক্রেনের আকাশ-সীমা এড়িয়ে চলেছে, সেখানে এয়ার-ইন্ডিয়ার এআই-১২১ উড়ানটি নির্দিষ্ট একদিকে চলেছে।
রিপাবলিক টিভির (Republic TV) একটি প্রতিবেদনে ওই স্ক্রিনশট দেখিয়ে দাবি করা হয়েছে, এয়ার ইন্ডিয়াই একমাত্র বিমান-সংস্থা যারা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করে চলেছে।
প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, যখন ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ৬টি রুশ বিমান ধ্বংস করে দিয়েছে এবং একটি এ-এন ২২৫ বিমান দখল করেছে (যেটা আবার রাশিয়া পুনর্দখলও করে নিচ্ছে), তখন এই বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্রাংকফুর্ট-গামী বিমানটিই একমাত্র স্থিরভাবে গন্তব্যের দিকে চলেছে।
পরে অবশ্য রিপাবলিক টিভি ওই পোস্টটি মুছে দেয়। টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
নিউজ-১৮ ইন্ডিয়ার ম্যানেজিং এডিটর আমিশ দেবগণ-ও এই পোস্টটি শেয়ার করে লেখেন, "এই একটা ছবিই সব কথা বলে দিচ্ছে। এটা এক নতুন ভারত। জয় হিন্দ!" এই টুইটটিও অবশ্য পরে মুছে দেওয়া হয়, তবে তার আর্কাইভ বয়ান এখানে দেখে নিতে পারেন।
এই স্ক্রিনশটটি ফেসবুক এবং টুইটারেও ভাইরাল হয়েছে। তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি ছবিও এবং ক্যাপশনে ঘুরে-ফিরে একই কথা বলার চেষ্টা হয়েছে যে, এটা ইউক্রেনের রণাঙ্গনে আটকে পড়া ভারতীয়দের উদ্ধার করে আনতে সক্ষম নতুন ভারতের ক্ষমতাকেই দেখিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন: ইউক্রেনে রুশ তাণ্ডব বলে ছড়াল ২০১৪ সালের সরকার বিরোধী প্রতিবাদের ছবি
তথ্য যাচাই
বুম দেখলো, স্ক্রিনশটটি সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে কিউবেক টাঙ্গো নামক একটি টুইট অ্যাকাউন্ট থেকে।
ছবিটার উৎস কোথায়?
কিউবেক টাঙ্গোর টুইট পরীক্ষা করলে দেখা যাবে সেখানে বেশ কয়েকজন জবাবে জানাচ্ছে যে তারা প্লেন-ফাইন্ডারের ওই উড়ানের ছবিটা দেখতে পাচ্ছে না। পরের টুইটগুলিতে তিনি বলছেন, তাঁকে জানানো হয়েছে যে ছবিটা পাল্টে ফেলা হয়েছে এবং এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে তাঁর কাছে এ জন্য দুঃখপ্রকাশও করা হয়েছে।
এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ান কি ইউক্রেনের আকাশ-সীমায় প্রবেশ করেছিল?
এরপর আমরা ২৪ ফেব্রুয়ারি এয়ার ইন্ডিয়ার এআই-১২১ বিমানটির উড়ান-পথ লক্ষ্য করি এবং তাতে ভাইরাল হওয়া স্ক্রিনশটের কোনও সত্যতা মেলেনি। ভাইরাল ছবিতে এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ানটি একাকী একটা নির্দিষ্ট দিকে চলেছে, যেখানে অন্য সব বিমান অন্য দিকে উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওই একই দিনে একই ফ্লাইটের 'পাথফাইন্ডার'-এর গ্রাফিকে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। ওই উড়ানের গতিপথ লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে, সেটি মোটেই ইউক্রেনের দিকে যাচ্ছে না, বরং তার উল্টো দিকেই চলে যাচ্ছে।
তা ছাড়া ওই উড়ান এআই-১২১ ইউক্রেনে আটকে পড়া ভারতীয়দের উদ্ধার করে আনছে, এই দাবিটিও সম্পূর্ণ ভুয়ো। কেননা এই উড়ানটি দিল্লি-ফ্রাঙ্কফুর্ট রুটের নিয়মিত উড়ান, আদৌ ইউক্রেন-গামী কোনও উড়ান নয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি কি এয়ার ইন্ডিয়া আটকে-পড়া ভারতীয়দের ইউক্রেন থেকে উদ্ধার করেছিল?
আমরা খোঁজ নিয়ে দেখি ২৪ ফেব্রুয়ারি এয়ার ইন্ডিয়ার কোনও বিমানকে ভারতীয়দের উদ্ধার করে আনতে ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছিল কিনা এবং দেখতে পাই, এআই-১৯৪৭ নম্বর উড়ানটিকে এই উদ্দেশ্যে দিল্লি থেকে পাঠানো হয়েছিল। তবে ইতিমধ্যে ইউক্রেন তার আকাশ-সীমা সব অসামরিক উড়ানের জন্য বন্ধ করে দেওয়ায় সেটি ফেরত চলে আসতে বাধ্য হয়।
দ্য প্রিন্ট-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ সকল বৈমানিকের উদ্দেশে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায়, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির কারণে অসামরিক সব বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে সে দেশের আকাশ-সীমা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আর এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ানটিকেও সেই কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার ফিরে আসার নির্দেশ দেয় এবং সেটি ইরানের আকাশপথ থেকে ফিরে চলেও আসে।
খবরে প্রকাশ, উদ্ধার হওয়া ভারতীয় নাগরিকদের নিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার প্রথম বিমানটি ইউক্রেন নয়, রোমানিয়ার বুখারেস্ট থেকে ওড়ে এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি সেটি মু্ম্বইতে পৌঁছায়।
সংবাদ-সংস্থা পিটিআইকে উদ্ধৃত করে দ্য ট্রিবিউন সংবাদপত্র লেখে, "শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ভোর ৩টে ৩৮ মিনিটে এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ানটি বুখারেস্টের উদ্দেশে রওনা হয় এবং ভারতীয় সময় সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে সেখানে পৌঁছয়। এর পর দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে সেটি মুম্বইয়ের উদ্দেশে ফিরতে শুরু করে। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ইউক্রেনের আকাশ-সীমা অসামরিক বিমানের উড়ানের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তাই বুখারেস্ট এবং বুদাপেস্ট থেকেই উদ্ধারকারী উড়ানগুলি এখন উড়ছে।"
আরও পড়ুন: ইউক্রেন সংকট: ২০১৯ সালে দম্পতির পতাকা জড়ানো আলিঙ্গনের ছবি ছড়াল