হোয়াটসঅ্যাপ ও অন্যান্য সোশাল মিডিয়ায় যুদ্ধে নিহত সেনা কল্যাণ তহবিলে অনুদান চেয়ে একটি বার্তা ভাইরাল হয়েছে। বার্তাটিতে বলা হয়েছে, বলিউডের নায়ক অক্ষয় কুমার (Akshay Kumar) এই তহবিলটি সমর্থন করছেন এবং এর অর্থ দিয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনীর জন্য আগ্নেয়াস্ত্র (Weapons) কেনা হবে।
বুম দেখে এই বার্তাটি বিভ্রান্তিকর। এটা ঠিকই যে, “ভারত কে বীর” নামে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি তহবিলের হয়ে অক্ষয় কুমার চাঁদা তুলছেন, চাইছেনও। কিন্তু সেটা যুদ্ধে নিহত সেনাদের কল্যাণ তহবিল নয়। শুধু তা-ই নয়, এই দুটি তহবিলই সেনা ও আধা-সেনার কল্যাণ তহবিল, বাহিনীর জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কেনার তহবিল নয়, যা নাকি ওই ভাইরাল বার্তায় দাবি করা হয়েছে।
বুম-এর হেল্পলাইন নম্বরেও (৭৭০০৯০৬৫৮৮) এই বার্তাটি এসে পৌঁছেছে, যেটা নীচে দেখতে পারেন।
বার্তাটি এই রকম:
“সুপারস্টার অক্ষয় কুমারের সুপারিশে মোদী সরকারের আরও একটি মহৎ সিদ্ধান্ত দিনে মাত্র এক টাকা করে দান করুন, তা-ও ভারতীয় ফৌজকে। গত কাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ভারতীয় বাহিনীর আধুনিকীকরণ এবং যুদ্ধে হতাহতদের আধুনিকীকরণের জন্য তহবিল তৈরি করতে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সিদ্ধান্ত নেয়, যে-তহবিলে প্রত্যেক ভারতীয় তাঁর নিজের ইচ্ছামত যে-কোনও অঙ্কের অর্থ দান করতে পারেন। এক টাকা থেকে শুরু করে যে-কোনও অঙ্কের অর্থ! সেনাবাহিনী ও আধা-সেনার জন্য অস্ত্রশস্ত্র কিনতে এই দানের অর্থ উপযোগ করা হবে। ‘মন কি বাত’ এবং ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ-এর পরামর্শ অনুসারে মোদী সরকার শেষ পর্যন্ত সিন্ডিকেট ব্যাংকের নয়াদিল্লি শাখায় এই তহবিলের জন্য অ্যাকাউন্ট খুলেছে। এটা চলচ্চিত্র তারকা অক্ষয় কুমারের একটা দারুণ পদক্ষেপ, যার ফলে ভারতের অতিবৃহৎশক্তি হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। যদি ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার ৭০ শতাংশও দিনে মাত্র এক টাকা করে তহবিলে দান করে, তাহলেও এক দিনে তহবিলে ১০০ কোটি টাকা ৩০ দিনে ৩ হাজার কোটি টাকা এবং এক বছরে ৩৬ হাজার কোটি টাকা জমা পড়ে যাবে, যেটা পাকিস্তানের সারা বছরের প্রতিরক্ষা বাজেটের চেয়েও বেশি!আমরা প্রতি দিন ১০০ থেকে ১০০০ টাকা অপ্রয়োজনীয় নানা ব্যাপারে খরচ করি, কিন্তু যদি সেনাবাহিনীর জন্যে দিনে মাত্র এক টাকা করেও খরচ করি, তাহলেও ভারত একটা বৃহৎশক্তি হয়ে উঠবে। আপনার দানের টাকা সরাসরি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সেনাকল্যাণ তহবিলে জমা পড়বে, যা সেনা ও সরঞ্জাম মোতায়েনের জন্য জরুরিl অতএব আর দেরি না করে মোদীজির এই উদ্যোগে শামিল হোন। মোদীজির হাত শক্ত করুন! দেশকে শক্তিশালী করুন! ভবিষ্যতে পাকিস্তান ও চিন যাতে বেয়াদপি করতে না পারে। তহবিলের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর নীচে দেওয়া হল। বার্তাটি ছড়িয়ে দিন! জয় হিন্দ! বন্দে মাতরম্!”
একই বার্তা সমাজ-মাধ্যমেও ভাইরাল হয়েছে।
তথ্য যাচাই
বুম দেখে বার্তাটিতে দুটি ভিন্ন তহবিলকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে —একটি যুদ্ধে নিহত সেনাদের জন্য কল্যাণ তহবিল, আর অন্যটি “ভারত কে বীর” নামক একটি তহবিল, যেটির সঙ্গে সত্য-সত্যই চিত্রতারকা অক্ষয় কুমারও জড়িত। শেষোক্ত তহবিলটি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতায় পড়ে, যা আধা-সেনা এবং কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনীর কল্যাণের লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে, আর প্রথমটি ভারতীয় ফৌজের জন্য তৈরি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের নিজস্ব তহবিল।
১. যুদ্ধে নিহত সেনা-কল্যাণ তহবিল
এই তহবিলটি ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর, যা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত স্থলসেনা, বায়ুসেনা বা নৌসেনার পরিবারবর্গকে সাহায্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত। তহবিল বিষয়ক তথ্যে জানানো হচ্ছে, এখানে জমা পড়া অর্থ দিয়ে রণাঙ্গনে হতাহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসন দান করা হয়ে থাকে। এই তহবিলে দেওয়া অনুদান আয়কর মুক্ত!
এ ব্যাপারে ২০১৬ সালের ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি তথ্য-বুলেটিনও নীচে দেওয়া হল।
দেখা যাচ্ছে, এই তহবিলে অর্থ দান করতে হলে কানাড়া ব্যাংকের শাখায় তা করতে হবে, ভাইরাল হোয়াট্স্যাপ বার্তায় যেখানে সিন্ডিকেট ব্যাংক-এর কথা ছিল। বুম দেখেছে, কানাড়া ব্যাংকই তহবিলে দান করার সঠিক ঠিকানা, যা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সরকারি ওয়েবসাইটেও সমর্থিত।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানায়, ‘ভারত মাতার সুপুত্র’ নামে তারা একটি বিশেষ পোর্টাল চালু করছে, যেখানেও পূর্বোক্ত তহবিলের চাঁদা জমা দেওয়া যাবে। তাতেও কানাড়া ব্যাংকে অর্থ জমা দেবার কথাই বলা হয়েছে।
২. ভারত কে বীর
যুদ্ধে নিহত সেনা কল্যাণ তহবিলে চিত্রতারকা অক্ষয় কুমারের জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ আমরা পাইনি, তবে ২০১৭ সালে চালু হওয়া “ভারত কে বীর” প্রকল্পটির তহবিলের সঙ্গে তিনি যুক্ত। এই তহবিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন ৮টি কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনীর নিহত জওয়ানদের পরিবারবর্গকে আর্থিক সহায়তা দেবার জন্য তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে আসাম রাইফেল্স, সিআরপি, বিএসএফ এবং এনএসজির (ন্যাশনাল সিকিওরিটি গার্ড) মতো বাহিনী।
নীচে একটি পোস্ট দেওয়া হল, যাতে অক্ষয় কুমার সশস্ত্র বাহিনীর কল্যাণার্থে আর্থিক অনুদানের জন্য আবেদন জানাচ্ছেন। চিত্রতারকা সেখানে সরকারের কাছেও সাহায্য প্রার্থনা করেছেন, যদিও তহবিলের প্রযুক্তিগত দিকগুলি তিনি নিজেই দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
২০১৭ সালে অক্ষয় কুমার তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে সঙ্গে নিয়েই “ভারত কে বীর” তহবিল প্রকল্পের অ্যাপ ও ওয়েবসাইট চালু করেন।
“ভারত কে বীর” তহবিলে দেওয়া চাঁদা কেন্দ্রীয় ভাবেও দেওয়া যায়, আবার নিহত জওয়ানের পরিবারবর্গকে সরাসরিও দেওয়া যায়।
২০১৮ সালে তহবিলটিকে একটি ট্রাস্ট-এ পরিণত করা হয়। জানানো হয়, এই ট্রাস্ট-এর সব সদস্যই সরকারি চাকুরে। এর বোর্ড-এর বৈঠকে অক্ষয় কুমার এবং বিখ্যাত ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় পদ্মশ্রী পি গোপীচন্দকে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসাবে ডাকা হয়।
এই তহবিলে দেওয়া চাঁদার উপরেও কর মকুব করা হয়। “ভারত কে বীর” ওয়েবসাইটটি এখানে দেখতে পাওয়া যাবে।
বুম ইতিপূর্বে এই প্রতিবেদনের একটি হিন্দি সংস্করণেরও পর্দাফাঁস করেছে।