সোশাল মিডিয়ায় করোনা অতিমারি কোভিড-অতিমারি (Pandemic) ও মাস্কের (Mask) কার্যকারিতা নিয়ে বিভ্রান্তিকর দাবি সহ ষড়যন্ত্রমূলক (Conspiracy Theory) একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
১০ মিনিট ৩৩ মিনিটের ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওটিতে গণমাধ্যম ডিএনএন বাংলার (DNN Bangla) লোগো রয়েছে। সাংবাদিক এক ব্যক্তিকে প্রশ্ন করেন, "আপনারা কি বলছেন যে মাস্ক পরবেন না, ভ্যাকসিন নেবেন না?" প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, "আপনার প্রশ্নটা খুব সহজ একটা প্রশ্ন। আমি একটু পেছনে যায়। প্রথম কথা বিল গেটস ফাউন্ডেশন, হিলারি ক্লিন্টন ফাউন্ডেশন এটা আমার পাড়ার, ডানকুনি পাড়া, নাগেরবাজার মোড় কিংবা মধ্যমগ্রাম চৌমাথার কোনও সংস্থা অর্গানাইজেশন নয়। এইটা হিলারি ক্লিন্টন ফাউন্ডেশন এবং বিল গেটস ফাউন্ডেশন; মিস্টার বিল গেটস বিশ্বের ধনি ব্যক্তি। তিনি কিন্তু আমেরিকাতে বসে আছেন। তাঁর কথাতে ওঠে বসে হু। তাঁর কথাতে ওঠে বসে ডাঃ অ্যান্থনি ফাউসি। যিনি কিনা এই পুরো প্ল্যান পোগ্রামটা করেছেন। প্ল্যানডেমিক আমরা বলছি। প্ল্যান পোগ্রামটা কী করেছেন? যে একটা ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার মিথ্যে আয়োজন করে, মানুষকে সারা বিশ্বে ডিপপুলেট করতে হবে অর্থাৎ জনসংখ্যা কমাতে হবে। আগে যেমন মিসাইল দিয়ে যুদ্ধ হতো। আগে অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ হতো। এখন বায়োওয়েপনের নামে একটা মিথ্যে বায়োওয়েপনের গল্প ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের মুখে।..."
তিনি আরও বলেন, "দ্বিতীয় কথা, "এখন যেটা দেখতে পাচ্ছি যেগুলো ফোর্স করা হচ্ছে। চাপিয়ে দেওয়া আইন যেগুলোকে বলা হচ্ছে। যেমন মাস্ক না পড়লে আপনি বেরতে পারবেন না। টিকা না নিলে আপনি কোথাও ভ্রমণ করতে পারবেন না। তারপর স্যানিটাইজার আপনি না নিলে পরে আপনার সঙ্গে আপানার আশেপাশের লোকদের ঝগড়া লেগে যাবে। এই তিনটে জিনিসের বিরুদ্ধে পরিস্কারভাবে অনেক যুক্তি-যুক্ত বিজ্ঞানসম্মত অনেক কথা এতদিন ধরে, দু'বছর ধরে বলে বলে, না খেয়ে খেয়ে নিজের চেম্বারে শুধু বসে রুগিদের বাঁচিয়েছি।... সমস্ত প্রমাণ দিয়ে দেব যে কি মিথ্যাচারিতা চলছে, এই নিষ্পাপ সাধারণ মানুষরা, যারা বেচারিরা বিজ্ঞান বোঝে না তাদের মাস্ক পরিয়ে কিভাবে মারছে।" তিনি পরিচয় হিসেবে বলেন ডাঃ রাজেশ রায়, তিনি নাগেরবাজারের হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি ডাক্তার হিসেবে পেশাদার।
সংবাদিক পরে আরেক স্থানীয় ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলেন। ওই দ্বিতীয় ডাক্তারবাবু বলেন, "এখানে সমর্থন বা অসমর্থনের প্রশ্ন না। প্রশ্নটা হচ্ছে এর গুরুত্ব। মেডিকেল সায়েন্সে চরম বলে কিছু নেই। এখানে বিভিন্ন রকম মতানৈক্য থাকবে। প্রথম থেকেই কেউ বলছে না যে মাস্ক পরলেই হয়ে যাবে। একটা সময় যখন বলা হচ্ছিল মাস্ক পরলেই করোনা রোখা যাবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলেই রোখা যাবে। হাত সাবান দিয়ে ধুলেই রোখা যাবে। সমস্ত রোগের জন্যই এগুলি প্রকৃত সত্য কথা। আমরা মানুষকে এটাই বলতে পারি যেখানে অতিরিক্ত ভিড় আছে, সেখানে আপনি মাস্কটা ব্যবহার করুন। সবসময়ের জন্য মাস্ক ব্যবহার করবেন না। এতে আপনার ক্ষতি হয়। অক্সিজেনকে ঢুকতে দিচ্ছে না। এতে আরও শ্বাসযন্ত্র সংক্রান্ত যে রোগ থাকে, সিওপিডি পেশেন্ট কতক্ষণ মাস্ক পরে থাকবে। কার্বন মনোক্সাইড বেড়ে যাবে। ফুসফুস থেকে রক্তে চলে যাবে।... সুতরাং সবকিছু ব্যালেন্স করে চলতে হবে।" পরিচয় হিসেবে তিনি বলেন ডাঃ অরুনাভ চক্রবর্তী।
ফেসবুক পোস্টটিতে ক্যাপশন লেখা হয়েছে, "#ভ্যাকসিন_নিবেন_না_! #মাক্স_পড়বেন_না_! একদল চিকিৎসক বলেছেন! কেন বলেছেন ভিডিওটা দেখলে বুঝতে পারবেন। DNN BENGALA NEWS"
ভিডিওটি দেখা যাবে এখানে।
আরেকটি ফেসবুক পোস্টে ক্যাপশন লেখা হয়েছে, "বিশ্বাস করি বা না করি, কিন্তু কিছু জিনিস ক্রমশ প্রকাশ্য,, আর কথা গুলো এক্কেবারে ফেলে দেওয়ার মতও না। #DNN_বাংলা_নিউজ..."
ভিডিওটি দেখা যাবে এখানে।
আরও পড়ুন: ভুয়ো খবর: ফাইজার অধিকর্তা বুর্লাকে এফবিআই প্রতারণায় গ্রেফতার করেনি
তথ্য যাচাই
বুম যাচাই করে দেখে ওই গণমাধ্যমের ক্লিপংয়ে পরিবেশিত ব্যক্তিদের বক্তব্যগুলি ষড়যন্ত্রমূলক যার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক যুক্তির কোনও যোগ নেই। প্রথম ব্যক্তি অতিমারির নেপথ্যে ডাঃ অ্যান্থনি ফাউসি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিল গেটসের সংস্থা রয়েছে এই সব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলেন এবং মাস্ক পরার ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে দ্বিতীয় ডাক্তার অনেক ভুয়ো তথ্য পরিবেশন করেন।
অতিমারির নেপথ্যে ডাঃ অ্যান্থনি ফাউসি?
৮১ বছর বয়সী ডাঃ অ্যান্থনি ফাউসি (Anthony Fauci) মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউসের মুখ্য-স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা এবং আমেরিকার অন্যতম সংক্রমণ সংক্রান্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (NIAID) ডিরেক্টর। মার্কিন দুনিয়ায় কোভিড অতিমারি সম্পর্কে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রবক্তারা একাধিকবার তাঁকে আক্রমণ করেছেন। মূলত রিপাবলিকান দলের সমর্থকরা ডাঃ ফাউসিকে তাদের লক্ষ্যবস্তু করে। প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন তিনি ক্ষমতায় ফিরলে ফাউসিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন।
২০২১ সালের জুন মাসে এসব নস্যাৎ করে ফাউসি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বিজ্ঞানকে মানার জন্য তাঁকে এই হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে। ডাঃ ফাউসি বিশ্বের সংক্রমণবিদ্দের অন্যতম যিনি জৈবঅস্ত্র হিসেবে উহান ল্যাব থেকে কোভিড ছড়ানো হয়েছে এই প্রবক্তার ঘোরতর বিরোধী।
দক্ষিণপন্থী প্রচার গণমাধ্যমেও ফাউসির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব জুড়ে ঢালাও প্রচার করা হয়। পড়ুন এখানে ও এখানে।
ফাউসির ইমেল সংক্রান্ত ভুয়ো খবরের তথ্য-যাচাই পড়া যাবে এখানে।
বিল গেটস কী দায়ী?
ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্বের প্রবক্তারা বিল গেটসের সঙ্গে ভ্যাক্সিন প্রস্তুতকারক সংস্থা মোডার্নার নামও জুড়ে দেয়। বলা হয়, গেটস মুনাফা পেতেই কোভিড অতিমারির পরিকল্পনা করেছে।
এই সব তত্ত্বে গেটস পরিচালিত দাতব্য সংস্থা বিল ও মিলিন্ডা গেটস সংস্থার নামও জোড়া হয়। বলা হয়, অতিমারির ভয় সৃষ্টি করা হয়েছে পরিকল্পনা মাফিক। এব্যাপারে রয়টর্স গণমাধ্যমের তথ্য-যাচাই প্রতিবেদন পড়া যাবে এখানে।
আরও পড়ুন: বিল গেটস ও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ভুয়ো খবর
প্ল্যানডেমিক তত্ত্ব?
পরিকল্পনা অনুযায়ী অতিমারির সৃষ্টি করা হয়েছে এই ভুয়ো 'প্ল্যানডেমিক' তত্ত্ব সংক্রান্ত একাধিক তথ্য-যাচাই প্রতিবেদন সারা বিশ্বের তথ্য-যাচাইকারীরা অতিমারি চলাকালীন বিভিন্ন সময়ে খণ্ডন করেছে। ভুয়ো তথ্য ও ভিডিও সহ হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ডের পাশাপাশি সোশাল মিডিয়ায় সেই সব ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব ছড়ানো হয়েছে গত দু'বছর ধরে। সোশাল মিডিয়া কোম্পানিগুলিও সে সবের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বেশকিছু সময়। #CoronaVirusFacts এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে ফেসবুক ও টুইটারে বিশ্বের নানা দেশের তথ্য-যাচাইকারী সংস্থাগুলি এখনও নানা এই ধরণের বিভ্রান্তিকর ও ভুয়ো তথ্য যাচাই করে চেলেছে।
কোভিড-১৯ ভাইরাস কোনওভাবে মনুষ্যতর প্রাণীর সংস্পর্শে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। তাঁরা জৈবঅস্ত্র বা অতিমারি পরিকল্পিত এসব তত্ত্বকে নস্যাৎ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। এব্যাপারে ডিএফআর ল্যাবের পর্যবেক্ষণ পড়া যাবে এখানে।
আরও পড়ুন: মিথ্যে:জাপানি নোবেল বিজয়ী তাসুকু হঞ্জো বলেছেন সার্স-কভ-২ মানুষের তৈরি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবৃতি
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চিনের উহানে 'ভাইরাল নিমোনিয়া'র উপস্থিতির কথা প্রথম জানায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা 'হু'। চিনের সরকার গণমাধ্যমে সে সময় বিবৃতি দিয়ে জানায় একথা। ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি এই ভাইরাল নিমোনিয়ার নেপথ্যে যে নোভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব আর তা সে কথা স্পষ্ট করে হু। সে সময় থেকে কোভিড-১৯ নিয়ে হু-এর সব বিবৃতি পড়া যাবে এখানে।
জনহপকিন্স বিশ্ব বিদ্যালয় ও মেডিসিন করোনাভাইরাস রিসোর্সসেন্টারের মাধ্যমে তারপর থেকেই সারা বিশ্বে অতিমারি সংক্রমণ, মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য নথিভুক্ত করা শুরু করে। বিশ্বের কোভিড তথ্য এখানে দেখুন।
ভিডিওতে বলা মাস্ক সংক্রান্ত ভুয়ো তত্ত্ব
মাস্ক তৈরি করা হয় শ্বাস-চলাচলের উপযোগী উপাদান দিয়ে। ঘন্টার পর ঘন্টা ডাক্তাররা মাস্ক পরে শল্যচিকিৎসা করেন।
মাস্ক পরে থাকলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা কার্বনের যৌগ দেহে বেড়ে যাবে এই তত্ত্বও ভিত্তিহীন। মাস্ক সংক্রান্ত বিভিন্ন ভুয়ো তথ্য নিয়ে বিবিসির তথ্য-যাচাই পড়ুন এখানে।
অতিমারি রুখতে সারা বিশ্বেই জনবহুল এলাকায় মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। কোভিড-১৯ ভাইরাল ছড়ায় প্রথানত 'ড্রপলেটের' মাধ্যমে। সংক্রামিত ব্যক্তি থেকে সংক্রমণ রুখতে জনবহুল এলাকায় মাস্কের ব্যবহার ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। সঠিক ভাবে মাস্ক পরলে সংক্রমণ রোখা যায়।
স্বাস্থ্য নিদান তোয়াক্কা না করে অবশ্য এর বিরুদ্ধে নানা দেশে মাস্ক বিরোধীরা প্রতিবাদও করছেন।
প্রখ্যাত মার্কিন ডাক্তার ফাইম ইউনুস (Faheem Yonus) ১৫ জানুয়ারি ২০২২ টুইটারে তাঁর কোভিডে মাস্ক ও টিকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। গত দু'বছরে হাজার বারের বেশি তিনি কোভিড-১৯ রুগির সংস্পর্শে এসেছেন। টিকা নেওয়ার ফলে তাঁর শরীরে কোভিড-১৯ সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি সেকথাও নেটিজেনদের সঙ্গে ভাগ করে নেন তিনি।
বুম যাচাই করে দেখে ভিডিওতে বক্তব্য পেশ করা ব্যক্তিরা কেউ ভাইরাস ঘটিত রোগ বা অতিমারি বিশেষজ্ঞ নন। বুমের অভিজ্ঞ পাঠকদের প্রতি বার্তা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভুল মতামতে বিশ্বাস না করে বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে চলুন।
আরও পড়ুন: কোভিড সারাতে শুকনো আদা? তেমন কোনও প্রমাণ নেই