একটি মিথ্যে ভাইরাল বার্তায় ভারতীয় টাকার (Indian Rupee) আন্তর্জাতিকীকরণ ও বিদেশে সেটির গ্রহণযোগ্যতা অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। ঠিকই যে, ওই বার্তায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলির উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, নানা বিদেশি দেশ ভারতের সঙ্গে ভারতীয় টাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য ‘ভস্ট্রো’ অ্যাকাউন্ট খুলেছে। কিন্তু ওই বার্তার অনেক উক্তিই কাল্পনিক বা মিথ্যে।
বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য সেটির একাধিক উক্তি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে উদ্ধৃত, বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু বুম নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এমন কোনও লেখা দেখতে পায়নি যাতে বলা হয়েছে, ৩০টি দেশ ভারতীয় টাকা গ্রহণ করছে।
রাজ্যসভার প্রকাশিত তথ্য বলছে, ভারতীয় মুদ্রায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহজ করতে ১৮ দেশের বেশ কিছু সংস্থা ভস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খুলেছে। ভারতীয় টাকায় বাণিজ্য করার কাজটা সহজ করার জন্য, ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই) এই অ্যাকাউন্টগুলির রূপরেখা জুলাই ২০২২-এ ছকে দেয়।
ভাইরাল মেসেজটি বুমের হেল্পলাইনেও (৭৭০০৯০৬৯৮৮) আসে। সেটি নীচে দেওয়া হল।
সেটি সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
তথ্য যাচাই
পশ্চাদপট
ভারতীয় টাকায় বাণিজ্য করার ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান আগ্রহকে কাজে লাগানোর জন্য, গত জুলাইয়ে, আরবিআই ভস্ট্রো অ্যাকাউন্টের সূচনা করে। দু’টি প্রেক্ষাপট ওই সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করে:
১) ইউক্রেন-এ সামরিক অভিযান চালানোর জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ডলারে বাণিজ্য করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার ফলে, ভারতীয় টাকায় সে দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করার পথ সুগম করা।
২) শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক অস্থিরতা – যা ছিল এবং এখনও চলছে – ও সে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার তলানিতে ঠেকায়, সে দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া সম্ভব করার স্বার্থে। ওই অ্যাকাউন্ট ‘করেসপন্ডেন্ট ব্যাঙ্কিং’-এর সুবিধে করে দেয়। এই ব্যবস্থায়, একটি ভারতীয় সংস্থা (এ ক্ষেত্রে একটি ভারতীয় ব্যাঙ্ক) একটি বিদেশি সংস্থার (এ ক্ষেত্রে সাধারণত একটি বিদেশি ব্যাঙ্ক) হয়ে অ্যাকাউন্ট খোলে ও সেটি চালনা করতে পারে। কয়েকটি নির্ধারিত ভারতীয় ব্যাঙ্ক ভস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। একটি বিদেশি ব্যাঙ্ক তার ভারতীয় শাখার মাধ্যমেও ওই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে।
একটি বিদেশি সংস্থা যদি ওই অ্যাকাউন্ট খুলতে চায়, তাহলে তাকে ভারতে একটি অনুমোদিত ব্যাঙ্কের (অথরাইজড ডিলার ব্যাঙ্ক বা এডি ব্যা্ঙ্ক) সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এর পর এডি ব্যাঙ্কে ওই অ্যাকাউন্ট খোলা ও চালানোর অনুমতি চেয়ে আরবিআই-এর কাছে আবেদন করতে হবে তাকে। কোনও ভারতীয় রপ্তানিকারী কোনও একটি দেশে রপ্তানি করতে চাইলে, তিনি ভস্ট্রো অ্যাকাউন্ট থেকে ভারতীয় টাকায় পেমেন্ট পেতে পারেন। যদি কোনও আমদানিকারক বিদেশ থেকে দ্রব্য কিনতে চান, তাহলে তিনি সেই দেশের ভস্ট্রো অ্যাকাউন্টে সরাসরি ভারতীয় টাকা জমা করে জিনিস আমদানি করতে পারেন। আরবিআই আরও বলেছে যে, ওই ধরনের অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স থেকে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনও সীমা বাঁধা নেই।
এবং বাজার দরেই সেই টাকা বিদেশি মুদ্রায় রূপান্তরিত করা যাবে। ওই অ্যাকাউন্টের উদ্বৃত্ত আমানত সরকারি ঋণপত্রে বিনিয়োগ করা যেতে পারে, বা প্রকল্প ও বিনিয়োগ করতে কাজে লাগানো যেতে পারে।
১) কতগুলি দেশ ভারতীয় টাকায় বাণিজ্য করছে?
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক’টি দেশ ভারতীয় টাকা ব্যবহার করতে রাজি হয়েছে, সেই বিষয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছে ওই মেসেজে। তাতে এক বার বলা হয়েছে ৩০টি দেশ। আবার পরে বলা হয়েছে ৬৪ দেশ।
কিন্তু রাজ্যসভাকে অর্থ মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য বলছে, ১৮টি দেশে ৬০ ভস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।
ওই ১৮টি দেশ হল বৎসোয়ানা, ফিজি, জার্মানি, গায়ানা, ইজরায়েল, কেনিয়া, মালয়শিয়া, মরিশাস, মায়ানমার, নিউজিল্যান্ড, ওমান, রাশিয়া, সেচেল্স, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, তানজানিয়া, উগান্ডা ও যুক্ত রাজ্য। ওই মেসেজে ইজরায়েল ও জার্মানির নাম সঠিক লেখা হয়েছে।
কিন্তু ইতালির নামটা ঠিক নয়। উত্তরটা নীচে দেওয়া হল (দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুন)।
ওই মেসেজে দাবি করা হয়েছে যে, সৌদি আরব-ও ভারতীয় টাকা গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু ওই রাজতন্ত্র ভারতের সঙ্গে টাকা-রিয়াল বাণিজ্য ব্যবস্থা স্থাপন করা নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। তবে কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি এখনও।
২) নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ কি এ বিষয়ে লেখা বেরিয়েছে?
ভারত কোন কোন দেশের সঙ্গে ভারতীয় টাকার মাধ্যমে বাণিজ্য করছে বা ভবিষ্যতে আরও কোন কোন দেশের সঙ্গে ওই ব্যবস্থাগড়ে তুলবে, সেই বিষয় নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত কোনও লেখা বুম খুঁজে পায়নি।
তবে বৈদিশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত যে ভারতীয় টাকায় বিদেশি লেনদেন মেটানো শুরু করেছে, সেই বিষয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ লেখা বেরিয়েছে।
সেটি এখানে দেখা যাবে।
তাদের মতামত জানতে চেয়ে বুম নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাদের বক্তব্য জানার পর এই প্রতিবেদন আপডেট করা হবে।
৩) ডিজিএফটি কি কোনও সারকুলার প্রকাশ করেছে?
ডিরেক্টর জেনারেল অফ ফরেন ট্রেড ভারতীয় টাকায় বাণিজ্য চালানোর ব্যাপারে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। ফলে, মেসেজের দাবিটি ঠিক। আরবিআই যে ভস্ট্রো অ্যাকাউন্ট চালু করেছে, তার উল্লেখ আছে বিজ্ঞপ্তিটিতে। তবে, মেসেজটিতে আরও যা সব দাবি করা হয়েছে, সেগুলির কোনও উল্লেখ নেই বিজ্ঞপ্তিটিতে।
বিজ্ঞপ্তিটি এখানে দেখা যাবে।
৪) এই ব্যবস্থার মধ্যে ৫০ দেশ অন্তর্ভুক্ত হলে ভারতীয় টাকা কি আইএমএফ-এ জায়গা করে নেবে?
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল-এর (আইএমএফ) একটি বিশেষ ধরনের অ্যাসেট বা সম্পদ আছে – স্পেশ্যাল ড্রইং রাইটস। এটা কোনও মুদ্রা নয়, বরং একগুচ্ছ মুদ্রা ব্যবহার করার অধিকার। বর্তমানে এসডিআর-এর ডালিতে যে মুদ্রাগুলি আছে, সেগুলি হল মার্কিন ডলার, ইউরোপের ইউরো, জাপানের ইয়েন, ব্রিটেনের পাউন্ড ও চিনের উয়ান। প্রতিটি মুদ্রার গুরুত্ব ও ডালিতে সেগুলির কোনটা কতটা থাকবে, তা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর স্থির করা হয়।
এসডিআর-এ চিনের উয়ান-এর অন্তর্ভুক্তি সাম্প্রতিক কালে, ২০১৬ সালে, হয়েছে। এসডিআর-এ স্থান পাওয়ার শর্ত হিসেবে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি মুদ্রাকে ক’টি দেশ ব্যবহার করছে, সেই রকম কোনও সংখ্যা নির্ধারিত করা নেই।
ব্যাঙ্ক অফ ইন্টার্ন্যাশনাল সেটেলমেন্ট-এর ব্যাঙ্কিং বিভাগের প্রধান পিটার জোলনার, এসডিআর-এ স্থান পাওয়ার জন্য একটি মুদ্রার কি বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন, তা ২০১৬’য় ঠিক করে দেন।
১) একটি দেশের অথবা কয়েকটি দেশের যৌথ মুদ্রার রপ্তানি মূল্য পাঁচ বছর সর্বোচ্চ থাকা জরুরি।
২) মুদ্রাটি যেন সহজে কেনা-বেচা করা যায়। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সেটি ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হতে হবে। এবং উন্নত ও বিস্তৃত বিদেশি মুদ্রার বাজারে যেন, মূল্য না খুইয়ে, সেটিকে চব্বিশ ঘন্টাই কেনাবেচা করা সম্ভব হয়। এখানে পড়ুন সেটি।