ভাইরাল-হওয়া একটি গ্রাফিক (Graphic)-এ দাবি করা হয়েছে ড. ভীমরাও রামজি অম্বেডকর (B. R. Ambedkar) বলেছিলেন, ভারতে যেদিন কোনও আদিবাসী মহিলা (Tribal Woman) রাষ্ট্রপতি (President) নির্বাচিত হবেন সেদিন দেশের সংরক্ষণ ব্যবস্থা (Reservation System) তুলে দেওয়া উচিত।
কিন্তু বুম এমন কোনও তথ্য খুঁজে পায়নি যা প্রমাণ করে, অম্বেডকর এই কথা বলেছিলেন। তাছাড়া যেসব বিশেষজ্ঞরা তাঁর লেখা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাঁরাও ওই উদ্ধৃতিটিকে (Quote) খারিজ করে দিয়েছেন।
ভীমরাও রামজি অম্বেডকর একাধারে একজন সক্রিয় দলিত কর্মী, সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও আইনজ্ঞ ছিলেন। দলিতদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও ভারতের সংবিধান রচনায় তাঁর অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয়।
সম্প্রতি ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স-এর প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মু (Droupadi Murmu) রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই এই উদ্ধৃতিটি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
২৫ জুলাই, ২০২২ জনজাতি সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে ভারতের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে দ্রৌপদী মুর্মু ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
ভাইরাল উদ্ধৃতিটি ইংরেজিতে লেখা: "যেদিন কোনও আদিবাসী মহিলা ভারতের রাষ্টপতি হবেন, সেদিন দেশের সংরক্ষণ ব্যবস্থার অবসান ঘটানো উচিত – ড. ভীমরাও রামজি অম্বেডকর।"
(ইংরেজিতে উদ্ধৃতিটি লেখা: The day when a Tribal woman becomes the President of India the reservation in the country should be abolished. -Dr. Bhimrao Ramji Ambedkar)
ফেসবুক পোস্টটি দেখুন এখানে
ওই একই গ্রাফিক একই ভুয়ো দাবি সমেত, ফেসবুকেও শেয়ার করা হচ্ছে।
ভাইরাল গ্রাফিকটি বুমের হোয়াটসঅ্যাপ টিপলাইন নম্বরেও (৭৭০০৯০৬৫৮৮) আসে।
আরও পড়ুন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে ফের ছড়াল আনন্দবাজারের ভিন্ন লেখার শিরোনাম
তথ্য যাচাই
বুম যাচাই করে দেখে, অম্বেডকরের উক্তি বলে যে উদ্ধৃতিটি চালানো হচ্ছে, সেটি ভুয়ো। অম্বেডকর এ কথা বলেছেন, এই দাবির সমর্থনে আমরা কোনও অকাট্য প্রমাণ খুঁজে পাইনি।
ভাইরাল গ্রাফিকটি থেকে কি-ওয়ার্ড নিয়ে আমরা সার্চ করে অম্বেডকরের লেখা ও বক্তৃতায় কোথাও ওই মন্তব্য খুঁজে পাইনি।
তাছাড়া, 'অ্যানিহিলেশন অফ কাস্টস'-এর মতো তাঁর বিখ্যাত লেখাতেও ওই বক্তব্য দেখতে পাওয়া যায়নি। বিদেশ মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে ড. অম্বেডকরের সব লেখা ও বক্তৃতা রয়েছে, কিন্তু সেগুলির মধ্যে তাঁর এমন কোনও উক্তি নেই যাতে তিনি বলেছেন, কোনও আদিবাসী রাষ্ট্রপতি হলে, সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত।
দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পরই ওই উদ্ধৃতিটি সোশাল মিডিয়ায় দেখা যায়। ভাইরাল হওয়ার সময়টাই উদ্ধৃতিটির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়।
বিশেষজ্ঞরা উদ্ধৃতিটিকে ভুয়ো বলে খারিজ করেছেন
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা মেরুনা মুর্মুর সঙ্গে যোগাযোগ করে বুম। যিনি বাংলার বিশ্ববিদ্যালয় জগতে, সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ের প্রথম আদিবাসী অধ্যাপিকা (অ্যাসোটিয়েট প্রফেসর)।
অধ্যাপিকা মুর্মু বুমকে বলেন, "ড. অম্বেডকরের এরকম কোনও উক্তি আমি কখনও দেখিনি। ড. অম্বেডকর সব সময় সমষ্টির উন্নতির কথা বলতেন। ব্যক্তিগত সাফল্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে উনি মনে করতেন না।"
"তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতে একজন খুব শিক্ষিত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও, তিনি তাঁর দলিত পরিচয়ের জন্য বৈষম্যের শিকার হন। ফলে, একজন আদিবাসী মহিলা ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়াটা গণতন্ত্রের পক্ষে এক বিরাট পদক্ষেপ হতে পারে, কিন্তু ভারতবর্ষে আদিবাসীদের দুর্দশার সঙ্গে তার কোনও সামঞ্জস্য নেই," অধ্যাপিকা মুর্মু বুমকে বলেন।
মহারাষ্ট্র সরকারের অধীনে, ড. বাবাসাহেব অম্বেডকরের লেখা ও বক্তৃতা সংকলন প্রকল্পের সম্পাদক অধ্যাপক হরি নারকে টুইটারে ওই উদ্ধৃতিটিকে ভুয়ো ও কাল্পনিক বলে খারিজ করেছেন। অধ্যাপক নারকে ওই প্রকল্পের ১৭-২২ খণ্ড সম্পাদনা করছেন।
মারাঠিতে লেখা তাঁর টুইটে নারকে বলেন, "ড. অম্বেডকরের বলে যে উক্তিটি প্রচার করা হচ্ছে সেটি ভুয়ো, কাল্পনিক ও মিথ্যে। বাবাসাহেব ও কথা বলেনওনি, লেখেনওনি। বাবাসাহেবের লেখা ও বক্তৃতার ১-২২ খন্ডে কোথাও এ কথা নেই্। ওই ধরনের উদ্ধৃতি প্রকাশ করার সময়, সেটির সূত্র উল্লেখ করা উচিত (বইয়ের নাম, পাতার নম্বর)।"
উনি আরও বলেন, "সেসব এখানে দেওয়া নেই। কারণ, এই উদ্ধৃতিটি ভুয়ো। বাবাসাহেবের বলে এই ধরনের মিথ্যে উক্তি ক্রমাগত শেয়ার করে চলেছে আইটি সেল ও গুজব সৃষ্টিকারী দলগুলি। বুদ্ধিবৃত্তিক বৈষম্য তৈরি করার মতো অশুভ উদ্দেশ্যেই এই কাজ করা হয়। এটি সাম্য-বিরোধী আচরণের পরিচয় দেয়।"
সংরক্ষণের পক্ষে ড. অম্বেডকরের অবস্থানের উদাহরণ
উপরন্তু বিদেশ মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে আপলোড করা ড. অম্বেডকরের 'লেখা ও বক্তৃতা'র খণ্ডগুলিতে আমরা সংরক্ষণের পক্ষে তাঁর মতামতের অনেক উদাহরণ পাই।
'আনটাচেবল' (অস্পৃশ্য) বইটির লেখক মুলক রাজ আনন্দ-এর সঙ্গে মে, ১৯৫০ এক সাক্ষাৎকারে, অম্বেডকরের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়। তাতে উনি আদিবাসী ও তফসিলি জাতিদের উন্নতির জন্য স্কুল, কলেজ ও শিক্ষাবৃত্তির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেন। আনন্দ এক জায়গায় তাঁকে বলেন যে, এর ফলে 'বর্ণ হিন্দুদের' মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেবে। তার উত্তরে আম্বেডকর বলেন, তার জন্য 'বর্ণ হিন্দুদের' বিরুদ্ধে ওই সম্প্রদায়গুলিকে সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে।
খণ্ড-৭, ভাগ-১-এ দেখা যাবে ওই বক্তব্য। (দেখার জন্য ক্লিক করুন এখানে)
পাঞ্জাবের পাতিয়ালায়, ২৯ অক্টোবর, ১৯৫১ দেওয়া এক ভাষণেও অম্বেডকরের সংরক্ষণপন্থী অবস্থান স্পষ্ট হয়। 'সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন'-এর নির্বাচন উপলক্ষে প্রচার চলাকালে তিনি ভাষণটি দেন। সেখানে ড. অম্বেডকর বলেন, দশ বছরের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পরও তিনি সংরক্ষণ জারি রাখার পক্ষে (অর্থাৎ, ১৯৬০-এর পরেও) 'যত দিন না অস্পৃশ্যতা দূর হচ্ছে'।
সংরক্ষণের জন্য ১০ বছরের বেঁধে দেওয়া সময় সীমার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানকে সমর্থন না করার জন্য ড. অম্বেডকর কংগ্রেসের তফসিলি জাতি/জনজাতি প্রার্থীদের সমালোচনা করেন। লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলিতে রাজনৈতিক সংরক্ষেণের ক্ষেত্রে ১০ বছরের যে ধারা বলবৎ করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে অম্বেডকর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তবে ১৯৬০ সালে তফসিলি জাতি/জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে, সংসদে প্রতি ১০ বছর অন্তর তা পুনর্নবীকরণ হয়ে আসছিল। ডিসেম্বর ২০১৯ সর্বসম্মতিক্রমে তার মেয়াদ ২০৩০ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
খণ্ড-১৭, ভাগ-৩-এ দেখা যাবে। (দেখার জন্য ক্লিক করুন এখানে)
২০১৮ সালে লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা সুমিত্রা মহাজন ও তার আগে অনেকই দাবি করেন যে, অম্বেডকর কেবল ১০ বছরের জন্য সংরক্ষণ চেয়েছিলেন । কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এই দাবি খারিজ করেন।
এই দাবিটি যে খারিজ করা হয়েছে, তার দৃষ্টান্তগুলি দেখা যাবে অনুরাগ ভাস্কর-এর একটি গবেষণা পত্রে। তিনি জিন্দাল গ্লোবাল ল স্কুলের সহকারী অধ্যাপক। 'দ্য মিথ অফ দ্য টেন ইয়ার লিমিট অন রিজারভেশন অ্যান্ড ড. অম্বেডকরস স্ট্যান্স' নামক তাঁর ওই গবেষণাপত্রটি সেজ জার্নাল-এ প্রকাশিত হয়েছে (এখানে পড়ুন)। 'অম্বেডকর, গাঁধী অ্যান্ড প্যাটেল: দ্য মেকিং অফ ইন্ডিয়াস ইলেক্টোরাল সিসটেম' বইয়ের লেখকরাজা শেখর ভ্রন্ড্রু'র একটি লেখা থেকেও এ বিষয়ে জানা যায়। 'অম্বেডকর অ্যান্ড পোলিটিক্যাল রিজারভেশন' নামে লেখাটি ১৬ অগস্ট, ২০২০ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত হয় (এখানে পড়ুন)।
আরও পড়ুন:৫ জি নিলামে ২.৮ লক্ষ কোটি টাকা লোকসান দাবির সংবাদপত্রের ছবি ভুয়ো