তারিখহীন একটি ভিডিওতে (viral video), আফগানিস্তানের কান্দাহার (Kandahar) শহরে, এক ব্যক্তিকে হেলিকপ্টার থেকে ঝুলে থাকতে দেখা যাচ্ছে। মঙ্গলবার ভিডিওটি এই মিথ্যে দাবি সমেত ভাইরাল হয় যে, এক 'মার্কিন দোভাষীকে' ওই বর্বরোচিত পদ্ধতিতে হত্যা করে তালিবান।
কিন্তু ওই ঘটনারই অন্যান্য ভিডিও প্রমাণ করে যে, দাবিটি মিথ্যে। সেগুলিতে দেখা যায়, লোকটি জীবিত এবং তিনি পরে আছেন হেলিকপ্টার থেকে ঝুলে থাকার জন্য বিশেষ সরঞ্জাম।
৩০ অগস্ট, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পরিপ্রেক্ষিতে ভিডিওটি শেয়ার করা হয়। মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, আফগানিস্তানে ২০ বছর ধরে চলতে থাকা যুদ্ধের অবসান ঘটে। আফগানিস্তানের যুদ্ধই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম সামরিক অভিযান। জানা গেছে, বেশ কিছু বিমানসহ, মার্কিন সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র তালিবানরা (Taliban) কব্জা করেছে।
জি নিউজের প্রধান সম্পাদক সুধীর চৌধুরী ভিডিওটি টুইট করেন এবং পরে টুইটটি ডিলিট করে দেন। সেটির ক্যাপশনে তিনি লেখেন, "বিশ্বকে সন্ত্রাসের এক নতুন যুগে নিয়ে যাওয়ার পথে এ এক বিশেষ ছবি। সম্ভবত এক মার্কিন দোভাষীকে তালিবানরা একটি মার্কিন ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার থেকে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিয়েছে। আফগানিস্তানে পড়ে থাকা বাকি হেলিকপ্টারগুলিও এভাবেই ব্যবহার করা হবে।" তিনি। আর্কইভ টুইট দেখা যাবে এখানে।
অর্ণব গোস্বামী পরিচালিত রিপাবলিক টিভিও ওই ভিডিওটি দেখায়। দাবি করা হয়, তালিবানরা একটি মার্কিন ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার থেকে, এক ব্যক্তিকে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়। এবং তাই নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বিতর্ক অনুষ্টানেরও আয়োজন করা হয়।
দেখার জন্য ক্লিক করুন এখানে।
বেশ কয়েকটি অন্যান্য ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমও ওই ভিডিওটি সম্পর্কে মিথ্যে খবর ছড়ায়। তাদের মধ্যে ছিল আজ তক, নিউজ ২৪, নিউজ ১৮, উইঅন নিউজ, নবভারত টাইমস, দৈনিক ভাস্কর, অমর উজালা, জি হিন্দুস্তান, এবিপি নিউজ ও দক্ষিণপন্থী ওয়েবসাইটঅপইন্ডিয়া।
বাংলা গণমাধ্যমে আনন্দবাজার মুদ্রণ ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রতিবেদনে বিভ্রান্তিকর শিরোনাম লেখে, "ব্ল্যাক হক থেকে মানুষ ঝুলিয়ে টহল তালিবানের।" অন্যদিকে আনন্দবাজার ডিজিট্যাল তাদের প্রতিবেদনে লেখে, "স্থানীয় সূত্রের দাবি, তালিব জঙ্গিরা ওই ব্যক্তিকে খুন করার পর এ ভাবে হেলিকপ্টারে বেঁধে ঝুলিয়ে কন্দহর টহল দিতে বেরিয়েছিল।" একই ভুয়ো দাবি সহ প্রতিবেদন প্রকাশ করে জি ২৮ ঘন্টা ও নিউজ১৮ বাংলা।
আরও পড়ুন: ভারতীয় কিশোরী ও তার দাবি নাসার প্যানেলে অন্তর্ভুক্তি: পড়ুন আসল কাহিনী
তথ্য যাচাই
ভিডিওটির উৎস
ভাইরাল ভিডিওটি প্রথম টুইট করে টুইটার অ্যাকাউন্ট তালিব টাইমস। সেটির ক্যাপশনে বলা হয়, "আমাদের বিমান বাহিনী! এই সময় ইসলামিক এমিরেটস বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারগুলি কান্দাহারের ওপর উড়ছে ও শহরটিকে পাহারা দিচ্ছে।"
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
বুম আরও দেখে যে, তাবাসুম রেডিও নামের এক আফগান রেডিও স্টেশন তারও আগে. টেলিগ্রামে-এ ক্লিপটি পোস্ট করেছিল। কিন্তু তালিবানরা ওই ভাবে এক ব্যক্তিকে ফাঁসি দিচ্ছে, এমনটা কোথাও বলা হয়নি।
বিভিন্ন দিক থেকে তোলা ওই ঘটনার ছবিতে, ঝুলে থাকার বিশেষ সরঞ্জাম পরিহিত ওই ব্যক্তিকে হাত নাড়াতে দেখা যায়
ওই ঘটনার ওপর আমরা আরও কয়েকটি ভিডিও দেখতে পাই। সেগুলিতে ভাইরাল ক্লিপের ওই ব্যক্তিটিকে বিশেষ সরঞ্জাম পরে থাকতে ও হাত নাড়তে দেখা যায়। তা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, ওই ব্যক্তি জীবিত ছিলেন ও তাঁর বিশেষ সরঞ্জামকে ফাঁসির দড়ি বলে ভুল করা হয়।
'কান্দাহার' ও 'হেলিকপ্টার' – এই শব্দ দু'টি দিয়ে সার্চ করলে, আমরা ফেসবুকে অন্য দিক থেকে তোলা আরও একটি ক্লিপ দেখতে পাই। সেটির শুরুতেই ওই ব্যক্তিকে হাত নাড়াতে দেখা যায়। ফেসবুক ব্যবহারকারী খান মহম্মদ আয়ান ভিডিওটি পোস্ট করেন। তাঁর লেখা ক্যাপশনটি অনুবাদ করলে জানা যায়, হেলিকপ্টারের সাহায্যে, কান্দাহারের গভর্নরের অফিসের মাথায় নিজেদের পতাকা লাগানোর চেষ্টা করে তালিবান।
নিচের ক্লিপে লোকটিকে হাত নাড়তে দেখা যাচ্ছে।
আমরা আরও একটি ভিডিও দেখতে পাই। সেটি গভর্নরের অফিসের কাছ থেকে তোলা। এবং ওই একই হেলিকপ্টারকে উড়তে দেখা যায় তাতেও। সেই সঙ্গে, পতাকার পোল দেখা যায় নিচে থেকে।
কান্দাহারের এক স্থানীয় রিপোর্টার, অর্ঘান্ড আবদুলমানান, ভিডিওটি পোস্ট করেন। তাঁর দেওয়া ক্যাপশনে বলা হয়, "পতাকা লাগাতে প্লেনটি কান্দাহারের গভর্নরের অফিসের কাছে আসে। পতাকা লাগানোর জন্য একজন সেনা প্লেনটি থেকে ঝুলে থাকেন। কিন্তু পতাকা ওড়েনি।"
এর থেকে জানা যাচ্ছে যে, লোকটি হলেন এক তালিবান সেনা, যিনি তালিবানের পতাকা লাগানোর চেষ্টা করছিলেন।
তাছাড়া, জহিদ জালাল (@A_Jahid_Jalal)নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে কিছু ফোটো পোস্ট করা হয়। অন্য দিক থেকে তোলা ওই ঘটনাটির আরও একটি ভিডিও পোস্ট করেন জালাল।
ফোটোটিকে জুম করে বড় করে নিলে দেখা যায়, লোকটি হাত তুলে রয়েছেন।
তথ্য-যাচাই সংস্থা অল্ট নিউজ-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ জুবায়ের একটি ভিডিওর সন্ধান পান যেটিতে ওই ব্যক্তিকে হাত নাড়তে দেখা যায়।
একজন আফগান রিপোর্টার জানিয়েছেন, ভাইরাল ভিডিওটিতে যাঁকে দেখা যাচ্ছে তিনি তালিবানের ফ্ল্যাগ লাগানোর চেষ্টা করছিলেন
মিথ্যে দাবি-করা একটি টুইট উদ্ধৃত করে তার পাশাপাশি আসল তথ্যটি তুলে ধরেন আফগান সাংবাদিক বিলাল সারওয়ারি। তিনি বলেন, যে আফগান পাইলট প্লেনটি চালাচ্ছেন তাঁকে উনি চেনেন। এবং ভাইরাল ভিডিওতে যে লোকটিকে দেখা যাচ্ছে তিনি হলেন একজন তালিবান যোদ্ধা, যিনি তালিবানের পতাকা লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি।
তাছাড়া, ভাইরাল ভিডিওটির ওপর বিবিসি'র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, তালিবানকে উদ্ধৃত করে আফগানিস্তান সংক্রান্ত কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে জানান যে, সম্প্রতি কব্জা-করা মার্কিন সরঞ্জামের সাহায্যে, এক সরকারি ভবনে একটি পতাকা লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছিল ওই ভাবে।
হেলিকপ্টারটি কার মালিকানাধীন ছিল, বুম তা স্বাধীনভাবে যাচাই করে দেখতে পারেনি।
আফগানিস্তানে তালিবান তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার পর থেকে, একাধিক ভুল ও মিথ্যে খবর বুম খণ্ডন করেছে। আমাদের তথ্য-যাচাইগুলি আপনারা নিচের থ্রেডে দেখতে পাবেন।