মায়ানমারে (Myanmar) সশস্ত্র বিদ্রোহীদের এক গোষ্ঠীর একজন তরুণীকে নির্মমভাবে লাঞ্ছনা ও পরে তাকে গুলি করে হত্যার একটি হৃদয়বিদারক ভিডিও সম্প্রতি মণিপুরের (Manipur) ঘটনার ভুয়ো দাবি করে ভাইরাল হয়েছে সোশাল মিডিয়ায়।
ভিডিওটি শেয়ার করে দাবি করা হয় ঘটনাটি মণিপুরের যেখানে সশস্ত্র জনগণ একজন খ্রিস্টান কুকি মহিলাকে লাঞ্ছনা করছে।
বুম যাচাই করে দেখে দাবিটি ভুয়ো। ভাইরাল এই ভিডিওতে আদতে মায়ানমারের পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) সদস্যদের গুপ্তচরবৃত্তির সন্দেহে একজন মহিলাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে দেখা যায়।
প্রায় ৩ মিনিটের সেই ভিডিওতে সশস্ত্র উর্দিধারী বেশ কয়েকজন লোককে একজন মহিলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় মারধর করতে দেখা যায়। হাতকড়া পরা ওই মহিলা তাদের থামার জন্য অনুরোধ করে। এরপর দুষ্কৃতীরা ওই মহিলার চোখ বাঁধার আগে রাইফেল ব্যবহার করে তাকে আঘাত করে, রাস্তার মাঝখানে হাঁটু গেড়ে তাকে বসায় এবং তার মাথায় একাধিকবার গুলি করে।
সাম্প্রতিককালে মণিপুরে মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে হওয়া সংঘর্ষের সাথে যুক্ত করে ভিডিওটি ছড়ান হচ্ছে যা প্রথম এবছরের মে মাসে শুরু হয়েছিল। টুইটারে এক ব্যবহারকারী ভিডিওটি শেয়ার করে লেখেন, "মণিপুর মোদী ও শাহের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ভিডিওগুলি প্রকাশ্যে এসেছে যেখানে সশস্ত্র বেসামরিক লোকেরা নির্যাতন করছে এবং শেষ পর্যন্ত একটি কুক্কি খ্রিস্টান তরুণীকে গুলি করে হত্যা করছে। মণিপুরে আগুন জ্বলছে আর মোদী নীরব। মেয়েটিকে তখন ঠান্ডা মাথায় গুলি করা হয়েছিল, ভিডিওটির ওই অংশ শেয়ার করা হয়নি।"
পোস্টটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন এবং আর্কাইভ দেখতে এখানে।
তথ্য যাচাই
বুম যাচাই করে দেখে ভিডিওটি মিয়ানমারের তামু শহরে ২০২২ সালের জুনে হওয়া এক ঘটনার যার ভিডিও ডিসেম্বরে ভাইরাল হয়েছিল। এই ঘটনার সাথে মণিপুরে সাম্প্রতিক হওয়া সংঘর্ষের কোনো যোগসূত্র নেই।
ভিডিওটির একটি ফ্রেমকে আমরা ইয়ানডেক্সে রিভার্স সার্চ করে ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন খুঁজে পাই যেখানে তামুতে একটি ঘটনায় জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)-এর একজন মহিলাকে নির্মমভাবে লাঞ্ছনা, তাকে হত্যা এবং ঘটনাটিকে তাদের এক আচরণবিধির "লঙ্ঘন" বলে অভিহিত করার বিষয়ে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় সেবিষয়ে রিপোর্ট করা হয়।
বুমের মায়ানমার শাখাও নিশ্চিত করে জানায় ভিডিওটি সেদেশের, মণিপুরের নয়।
২০২১ সালে মায়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে আবির্ভূত নির্বাসিত সরকার এনইউজি ওই বছরের মে মাসে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স তথা পিডিএফ গঠন করে। পিডিএফ হল বিদ্রোহী এক গোষ্ঠী যারা তাতমাডো তথা মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং তাদের ৬০,০০০ এরও বেশি এক সৈন্যদল রয়েছে যারা প্রায়শই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে মায়ানমারের অন্যান্য জাতিগত সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করে।
নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং মায়ানমারের ন্যাশনাল লিগ অফ ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেত্রী অং সান সু চি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০২২ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে এনএলডি ব্যাপক জয়লাভ করলে সেখানকার সামরিক বাহিনী তা নির্বাচনী জালিয়াতির দাবিতে প্রত্যাখ্যান করে। সেদেশে জনগণের ব্যাপক বিক্ষোভের ফলে সেখানকার সামরিক বাহিনী আরও সহিংসতা, অভিযান এবং গ্রেপ্তারিতে লিপ্ত হলেও তারা মায়ানমারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে উঠতে পারেনি। এরপর থেকেই সামরিক বাহিনীর অভিযান ক্রমশ সহিংস হয়ে উঠেছে যার মধ্যে অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি নাগরিকদের উপর বোমা হামলার রিপোর্টও রয়েছে।
সংবাদ প্রতিবেদনটির সূত্র ধরে আমরা ঘটনাটির সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করি এবং ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর মায়ানমার নাও- এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ভিডিওটির এক অংশ দেখতে পাই।
এনইউজির প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সেক্রেটারি নাইং হতো অঙ-এর উদ্ধৃতি দেওয়া এই রিপোর্ট অনুসারে ঘটনাটি ২০২২ সালের জুন মাসে মণিপুরের মোরেহ নামে এক ভারতীয় শহরের সীমান্তবর্তী তামু শহরে ঘটেছিল। ডিসেম্বর মাস নাগাদ সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্রাফিক ভিডিওগুলি আবির্ভূত হওয়ার পরেই এনিউজি ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত হয়। নাইং হতো অঙ ভিডিওটির বিষয়ে বলেন ঘটনাটির কিছু অপরাধী তামু জেলার পিডিএফের চতুর্থ ব্যাটালিয়নের অন্তর্গত।
প্রতিবেদনটিতে মহিলাটিকে ২৫ বছর বয়সী আয় মার তুন হিসাবে শনাক্ত করা হয় যাকে সামরিক কিছু জান্তা কর্মীদের দ্বারা পিডিএফ সদস্যকে হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ওই মহিলাকে বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল এবং মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর অধীনে কাজ করা একটি গ্রুপ পায়ু সও হতেই সৈন্যর সদস্য ও চর হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছিল।
ইলেভেন মায়ানমারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভিডিওটি একটি সামরিকপন্থী টেলিগ্রাম চ্যানেলে পোস্ট করে ভাইরাল করা হয়।
৫ ডিসেম্বর এনইউজি ঘটনাটি সম্পর্কে তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এক বিবৃতি দিয়ে জানায় কীভাবে তারা "সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের নির্দেশ দিয়েছে জরুরীভাবে ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে তদন্ত করার জন্য এবং খুঁজে বের করতে পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের সদস্যরা কোনভাবে ঘটনাটির সাথে জড়িত ছিল কিনা।" ওই বিবৃতিতে তাদের সামরিক গোষ্ঠীগুলিকে "নৃশংসতা ও বর্বরতা করে সন্ত্রাসী সামরিক কাউন্সিল বাহিনীর মতো কাজ করার ফাঁদে না পড়ার জন্য" স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
(অতিরিক্ত রিপোর্টিং: বুম মায়ানমার)