বাচ্চা অপহরণের গুজব (Child Kidnapping Rumor) ছড়াতে যেসব ভিডিও আর সম্পর্কহীন ছবি যা এক সময় ছড়ানো হয়েছিল, খারিজ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেগুলি আবার শেয়ার করা আছে হোয়াটসঅ্যাপে (WhatssApp)।
এই নিয়ে এক সেট বার্তা শেয়ার করা হচ্ছে। তাতে রয়েছে এক মাথা-কাটা বাচ্চার বীভৎস ছবি, তাকে মেরে ফেলার ক্লিপ, এবং এক পুলিশ অফিসারের জোড়াতালি দেওয়া ক্লিপ, যাতে উনি বলছেন ৫০০ ছেলেধরা (Child lifters) ঘুরে বেড়ানোর কথা। সেই সঙ্গে আছে সম্পর্কহীন ছবির একটি স্লাইড শো। সেগুলি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে কী ধরনের ভয়ঙ্কর অস্ত্র ব্যবহার করে অপহরণকারীরা। ছবিগুলি একসঙ্গে ও আলাদা আলাদা ভাবে বুমের হেল্পলাইন ও টিপলাইনে একাধিকবার আসে। নীচের স্ক্রিনশটে দেখা যায় যে, হোয়াটসঅ্যাপে ওই ক্লিপ আর ছবিগুলি 'অনেকবার ফরওয়ার্ড' করা হয়। কোনও লিখিত বিবরণ ছাড়াই সেগুলি শেয়ার করা হচ্ছে।
মাথা-কাটা বাচ্চার ভিডিও আর ছবি
সম্প্রতি রাজস্থানে একটি ছেলের গলা কেটে দেয় একটি লোক। সেই ঘটনার ভিডিও এখন হোয়াটসঅ্যাপে ছেলেধরার গুজব ছড়াতে শেয়ার করা হচ্ছে। ঘটনাটি ৮ জানুয়ারি ২০২১-এ রাজস্থানের দন্তারামগঢ় তেহসিলের করাড গ্রামে ঘটেছিল। সেখানে উত্তম রাগের নামে ১১ বছর বয়সের একটি ছেলেকে তার কাজিন ২১ বছর বয়সী কৈলাশচন্দ রাগের খুন করে। দন্তারামগড় পুলিশের কথা অনুযায়ী, কৈলাশচন্দ মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবক। একটি পারিবারিক বিবাদের কারণে সে ওই অপরাধ করে। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দন্তারামগড় থানার ইন্সপেক্টর হিম্মত সিংহের সঙ্গে বুম যোগাযোগ করে। তিনি বলেন, "নিহত ছেলেটি ও আততায়ী একে অপরের আত্মীয়। ছেলেটি স্কুল থেকে ফেরে এবং ঘটনাটির এক ঘন্টা আগেও তারা কারাড গ্রামের বাজারে খেলছিল। গ্রামবাসীরা জানান যে, কৈলাশচন্দের মানসিক সমস্যা আছে। তার ১০ বছর বয়সী কাজিনকে হিংসে করত। তার মানসিক সমস্যার জন্য সে ওষুধও খায়।" ওই ভিডিওটির সঙ্গে ছেলেধরার কোনও সম্পর্ক নেই বলে জানান সিংহ।
বুমের তথ্য যাচাই এখানে পড়ুন।
ছেলেধরা সংক্রান্ত গুজব সম্পর্কে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের সাবধানবাণী সম্পাদনা করা হয়েছে
উত্তরপ্রদেশ পুলিশের এক উচ্চপদস্থ অফিসার, বেআইনি দেহাংশ ব্যবসায়ী ও ছেলেধরা সংক্রান্ত গুজব সম্পর্কে সতর্ক করে দেন একটি ভিডিওতে। কিন্তু সেই ভিডিওটি সম্পাদনা করে ওই গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্যেই শেয়ার করা হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপে। ওই ক্লিপটি ২০১৯-এ ভাইরাল হলে, বুম সেটিকে খণ্ডন করেছিল। সম্পাদিত ভিডিওতে এক ভাষ্যকারের বক্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, গোরখপুরের পুলিশ 'ছেলেধরাদের দল সম্পর্কে সকলকে জানাচ্ছে'। ভিডিওটিতে একটি সংবাদ বুলেটিনের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। তাতে গোরখপুরের পুলিশ অতিরিক্ত সুপার ড. কৌস্তবকে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। ভিডিওতে কৌস্তব ছেলেধরার সংক্রান্ত গুজব সম্পর্কে সাবধান থাকতে বলছেন সকলকে। কিন্তু সম্পাদিত ভিডিওটিতে তাঁর কথা তুলে দিয়ে, ভাষ্যকারের কথা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাষ্যকার বলছেন, "৫০০-রও বেশি দেহাংশ ব্যবসায়ী ভিখারি সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে"। বুম ড. কৌস্তবের সঙ্গে যোগাযোগ করে। দেহাংশ ব্যবসায়ীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে তিনি সকলকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করেছেন বলে যে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তা মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেন ড. কৌস্তব ।
অপহরণের গুজব ছড়াতে একটি ক্লিপে পুরনো ও খারিজ-করা ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে
ছেলেধরার গুজব ছড়াচ্ছে ১৮ সেকেন্ডের একটি ক্লিপ। তাতে একত্রিত করা হয়েছে এমন কিছু ছবি যেগুলি আগে আলাদা আলাদা ভাবে শেয়ার করা হয় এবং মিথ্যে বলে খারিজ করা হয়েছিল। ভিডিওটিতে একটি অপ্রাসঙ্গিক বার্তা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে কোনও ছবি শেয়ার করার ব্যাপারে সাবধান করা হচ্ছে।
ছেলেধরার গুজব ছড়াচ্ছে ১৮ সেকেন্ডের একটি ক্লিপ। তাতে একত্রিত করা হয়েছে এমন কিছু ছবি যেগুলি আগে আলাদা আলাদা ভাবে শেয়ার করা হয় এবং মিথ্যে বলে খারিজ করা হয়েছিল। ভিডিওটিতে একটি অপ্রাসঙ্গিক বার্তা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে কোনও ছবি শেয়ার করার ব্যাপারে সাবধান করা হচ্ছে।
ছবি ১ ও ২
একটি গাড়িকে ঘিরে ভিড়ের ছবিটি অগাস্ট ২০২০তে তোলা হয়। এই ছবিগুলি ও আরও কিছু ছবিতে কয়েকটি বাচ্চাকে একটি গাড়ির পেছনে মাল রাখার জায়গায় বসে থাকতে দেখা যায়। বাচ্চাদের ওই ভাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য, স্থানীয় মানুষ বাচ্চাগুলির পরিবারের লোকজনকে আটকান। তাঁদের সন্দেহ হয়েছিল বাচ্চাগুলিকে বোধহয় অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেই সময় ওই ছবিগুলি ভাইরাল হয়। ঘটনাটি ঘটে হরিয়ানার লাডওয়া-য়। সেই সময় বুম লাডওয়া পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, গাড়ির ভেতরে জায়গা না থাকায়, বাচ্চাদের মাল রাখার জায়গায় বসানো হয়েছিল। পরিবারের এক সদস্যের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে পরিবারটি হরিয়ানা যাচ্ছিল। বুমের তথ্য যাচাই এখানে পড়ুন।
ছবি ৩
একটি ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট আবার ফিরে এসেছে। তাতে একটি খারিজ-করা ছবি রয়েছে, যাতে দুই ব্যক্তিকে ছেলেধরা বলে মিথ্যে শনাক্ত করে মারধোর করা হয়। ওই ফেসবুক পোস্টের সঙ্গে দেওয়া লিখিত বিবরণে বলা হয়, "সাবধান! নিজের বাচ্চাদের চোখে চোখে রাখুন। গোয়ালিয়রের ট্রান্সপোর্ট নগরে তিন দেহাংশ ব্যবসায়ী বাচ্চাদের অপহরণ করার চেষ্টা করছিল। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাচ্ছে।"
বুম আগে জেনে ছিল যে, ওই তিন ব্যক্তি হলেন একজন স্বঘোষিত সাধু ও তাঁর দু্ই অনুগামী। ছেলেধরা সন্দেহে জনতা তাঁদের মারে। দৈনিক ভাস্করের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাটি ৭ অগাস্ট ২০১৯-এ ঘটে। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায় যে, সাখি বাবা নামের এক স্থানীয় সাধু মেয়ের পোশাকে গোয়ালিয়র শহরের দিকে যাচ্ছিলেন। সেই সময়, তাঁকে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয় মানুষ মারধোর করে। ওই মারমুখী জনতার হাতে থেকে পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে। বুমের তথ্য যাচা্ই এখানে পড়ুন।
বুম আগে জেনে ছিল যে, ওই তিন ব্যক্তি হলেন একজন স্বঘোষিত সাধু ও তাঁর দু্ই অনুগামী। ছেলেধরা সন্দেহে জনতা তাঁদের মারে। দৈনিক ভাস্করের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাটি ৭ অগাস্ট ২০১৯-এ ঘটে। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায় যে, সাখি বাবা নামের এক স্থানীয় সাধু মেয়ের পোশাকে গোয়ালিয়র শহরের দিকে যাচ্ছিলেন। সেই সময়, তাঁকে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয় মানুষ মারধোর করে। ওই মারমুখী জনতার হাতে থেকে পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে। বুমের তথ্য যাচা্ই এখানে পড়ুন।
ছবি ৪
রতলাম-এ একটি মধুচক্র ভেঙ্গে দেওয়ার ছবি এই দাবি সমেত শেয়ার করা হচ্ছে যে, পুলিশ যাদের ধরেছে, তারা ছেলেধরা। বুম 'রতলাম পুলিশ' কি-ওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করলে, হিন্দি সংবাদপত্র 'পত্রিকা.কম'-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্ট সামনে আসে। তাতে বলা হয়, সপ্তাহের শুরুতে শহরে একটি মধুচক্র ভেঙ্গে দেওয়া হয়। বুমের তথ্য যাচাই এখানে পড়ুন।
ছবি ৫
ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, একটি টেবিলে তলোয়ার আর ছুরি সাজিয়ে রাখা আছে। ২০১৬তে গুজরাটে এক বেআইনি অস্ত্র কারবার ভেঙ্গে ওই অস্ত্রগুলি উদ্ধার করা হয়। বুম দেখে, বেআইনি অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত থাকার জন্য গুজরাটের রাজকোট পুলিশ একটি হোটেলে তল্লাসি চালায় ও কয়েক জনকে গ্রেফতার করে। আমরা দেখি যে, স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম 'গুজরাত হেডলাইন নিউজ' বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা ওই একই অস্ত্রের ছবি প্রকাশ করে ছিল। ওই একই ছবি বিভিন্ন সময়ে ভাইরাল হয়। ছবিগুলি একবার সাম্প্রদায়িক বক্তব্য সমেত শেয়ার করে বলা হয় যে, অস্ত্রগুলি একটি মসজিদে পাওয়া যায়। বুমের তথ্য যাচাই এখানে পড়ুন।