ইরাকে ইসলামিক স্টেট (ISIS) মেয়েদের উপর কী রকম অত্যাচার চালাচ্ছে, সে বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে ২০১৪ সালে লন্ডনে (London) কুর্দিশ সমাজকর্মীদের এক কর্মসূচির একটি ভিডিও নতুন করে ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে দাবি করা হল যে, তালিবানরা কী ভাবে আফগান মেয়েদের (women) নিলামে বিক্রি করছে, এই ভিডিওতে তা দেখা যাচ্ছে।
গত সপ্তাহে তালিবানরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আফগানিস্তানের বিপুল অংশের দখল নিয়েছে। দক্ষিণ আফগানিস্তানের শহর জারাঞ্জের পাশাপাশি উত্তরের বড় শহর কুন্দুজ, শের-এ-পুল এবং তালোকানও তাদের দখলে চলে এসেছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি এই সংঘর্ষ ফের চরমে ওঠায় সারা দেশে প্রচুর নাগরিক নিহত হয়েছেন; এমনকি বহু শিশুহত্যার সংবাদও মিলেছে। এই বছর এপ্রিল মাসে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেন যে, আফগানিস্তানে আসার ২০ বছরের মাথায় আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সে দেশ থেকে সমস্ত আমেরিকান সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়া হবে। পরে জানানো হয়, ৩১ অগস্টের মধ্যেই সেনা সরিয়ে নেওয়ার কাজ সম্পূর্ণ করা হবে।
দেশ থেকে পালাতে মরিয়া বহু আফগান নাগরিক প্লেনে ওঠার জন্য মারপিট করছেন, অনেকে প্লেনের ডানায় চড়ে বসেছেন, আবার অনেকে প্লেনের ওঠতে দেওয়ার আর্জি নিয়ে টারম্যাকে প্লেনের সামনে দৌড়চ্ছেন— এমন মর্মান্তিক বহু দৃশ্য প্রকাশ্যে এসেছে। তালিবানরা দেশের দখল নেওয়ায় ফের মহিলাদের মর্মান্তিক পরিস্থিতির দিকে দুনিয়ার নজর পড়ছে। তালিবানদের কড়া নির্দেশ, মহিলাদের শিক্ষা নিষিদ্ধ; পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বাইরে বেরোনোর, পুরো শরীর ঢাকা পোশাক ছাড়া অন্য কিছু পরার (কোনও ভাবেই যাতে শরীরের কোনও অংশ দেখা না যায়) ক্ষেত্রেও কড়া নিষেদ্ধাজ্ঞা। এই সব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় অতীতে মেয়েদের মারধর করা বা পাথর ছুঁড়ে হত্যা করার মতো কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
ডি ডব্লিউতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করে দাবি করা হয়েছে যে, আফগানিস্তানে তালিবান শাসনকালে যত বিয়ে হয়েছে, তার সিংহভাগই হয়েছে বলপূর্বক। যে ভাইরাল ভিডিওটি শেয়ার করা হচ্ছে, তার ক্যাপশনে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ বিষয়ে লেখা রয়েছে, এবং দাবি করা হয়েছে যে, ভিডিওটির দৃশ্যগুলি আফগানিস্তানের।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে একটি ক্যাপশন দেওয়া হয়েছে যাতে দাবি করা হয়েছে যে, ভিডিওটিতে যে দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, তা আফগানিস্তানের মেয়েদের উপর হওয়া অত্যাচারের ছবি তুলে ধরেছে। হিন্দিতে লেখা ওই ক্যাপশনের অনুবাদ, "তালিবানরা ১০০ টাকায় আফগান মেয়েদের বিক্রি করছে। ওরা যা ইচ্ছা তাই করছে, আর সারা বিশ্বের মুসলমান সমাজ চুপ করে আছে"।
( মূল হিন্দিতে লেখা: 100,,100 रूपये मे तालिबान, अफगान औरतों लड़कियों को बेच रहा ले जाओ कुछ भी करो, दुनिया के सारे मुस्लिम चुप)
ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, বিস্মিত পথচারীদের সামনে এক ব্যক্তি অ-মুসলিম মেয়েদের যৌনদাসী হিসাবে বিক্রি করার জন্য নিলাম করছে। সে মাইক্রোফোনে বলছে, " ১৮ বছরের আয়েশা …এর দাম খুব কম মাত্র ২৫ ডলার…২৫ ডলার এই খ্রিষ্টান (অস্পষ্ট)"।
ভিডিওটি দেখুন এখানে।
আরও পড়ুন: ২০১৮ সালে যুদ্ধবিরতি ঘিরে নাগরিকদের আনন্দ জোড়া হল তালিবানি দখলের সাথে
তথ্য যাচাই
২০১৮ সালে এই একই ভিডিও একই ক্যাপশনের সঙ্গে ভাইরাল হয়েছিল। তখনও এটি সত্যি ঘটনা বলে দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু আসলে ইসলামিক স্টেট মহিলাদের উপর যে অত্যাচার করে, তার বিরুদ্ধে সচেতেনতা বাড়ানোর জন্য লন্ডনে সমাজকর্মীরা যে কর্মসূচির আয়োজন করেছিলেন, ভিডিওটি সেই সময় তোলা হয়।
ভিডিওটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশে রিভার্স ইমেজ সার্চ চালিয়ে আমরা বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশন সংস্থার প্রকাশিত ২০১৪ সালের অনেকগুলি প্রতিবেদন দেখতে পাই। সেগুলির মধ্যে বিবিসির একটি প্রতিবেদনও ছিল যাতে ঘটনাটিকে "লন্ডনে ইসলামিক রাষ্ট্রের দাসী নিলামের প্রদর্শন"।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, "প্রবাসী কুর্দিশদের একটি সংগঠন, কমপ্যাশন ফর কুর্দিস্তান" ইরাকে ইসলামিক স্টেটের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য এই কর্মসূচির আয়োজন করে। বিবিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, এই সংগঠনটি ১৪ অক্টোবর ডাউনিং স্ট্রিট এবং পার্লামেন্ট ভবনের মতো লন্ডনের বিভিন্ন জায়গায় ভিডিও তোলে।
এই নকল নিলাম এবং অন্যান্য কর্মসূচি সম্বন্ধে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর নিউজউইক-এর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, "সেন্ট্রাল লন্ডনে কুর্দিশ সমাজকর্মীরা আইসিসের যৌনদাসী বিক্রির বাজারের ছবি তুলে ধরল।"
ভুয়ো দাবি সমেত ভিডিওটি যে সব টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করা হয়েছিল ২০১৮ সালে বুম তাদের উত্তরও দিয়েছিল।
আফগানিস্তানে সংঘর্ষ বাড়ার ফলে সোশ্যাল মিডিয়াতেও বহু ভুয়ো তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে আবার তালিবানদের দেশ দখল করার আগে মাস্ক পরার ব্যঙ্গাত্মক কাহিনি শেয়ার করেছেন। আবার কিছু পুরানো ভিডিও সাম্প্রতিক ঘটনার দৃশ্য বলে ছড়িয়ে পড়েছে।