একাধিক মূলধারার গণমাধ্যম তালা-লাগানো একটি গোরস্তানের ছবি ভাইরাল করে ভুয়ো দাবি করেছে, পাকিস্তানের (Pakistan) এক বাবা-মা নাকি এই ভাবে কবরটিতে তালা মেরে দিয়েছেন, যাতে তাঁদের মৃতা মেয়ের সঙ্গে নেক্রফিলিয়া (শবদেহ সঙ্গম) (Necrophilia) না ঘটে।
বুম দেখলো, দাবিটা সর্বৈব ভুয়ো এবং কবরস্থানটি আদৌ পাকিস্তানে নয় ভারতের হায়দরাবাদে দরাব জঙ কলোনির মসজিদ-এ-সালার মুল্ক-এ অবস্থিত। পাকিস্তানি বাবা-মায়ের তরফে মেয়ের মৃতদেহের বলাৎকারের আশঙ্কা দূর করতে এই বন্দোবস্তের গুজবটাও বানানো।
আমরা এক স্থানীয় লোকের সঙ্গে কথা বলেছি, কবরস্থানের কেয়ারটেকারের সঙ্গেও কথা বলেছি। তাঁরা জানিয়েছেন, কবরস্থানটি গ্রিল দিয়ে ঘিরে দেওয়ার কারণ, যাতে চোরেরা ধনসম্পদের খোঁজে সেখানে ঢুকে খোঁড়াখুঁড়ি করতে না পারে এবং ভবিষ্যতে যাতে পরিবারের অন্য মৃতদেরও সেখানে কবরস্থ করা যায়।
তালা-দেওয়া গোরস্তানের ছবিটা প্রথম ভাইরাল হয় জনৈক হ্যারিস সুলতান সেটি টুইট করে এই ক্যাপশন দেওয়ার পর, “পাকিস্তান এমনই একটা হতাশ ও মরিয়া যৌনতাদীর্ণ সমাজ তৈরি করেছে যে, এখন নিজেদের মেয়ের মৃতদেহকে ধর্ষকদের হাত থেকে বাঁচাতেও গোরস্তানে তালা লাগাতে হচ্ছে! বোরখার সঙ্গে ধর্ষণকে সংযুক্ত করলে কবর পর্যন্ত তা তোমাকে ধাওয়া করবে!”
ওই টুইটটি হ্যারিস এত দিনে মুছে দিয়েছেন, কিন্তু সেটির আর্কাইভ এখানে দেখা যেতে পারে।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডেইলি টাইমস এই টুইটটি পত্রপাঠ লুফে নেয় এবং তালাবদ্ধ কবরের উল্লেখ করে পাকিস্তানে মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হিংসা এবং মৃত নারীর শবের ধর্ষণের মতো পৈশাচিকতার বর্ধমান প্রবণতার উল্লেখ করে। তারা অবশ্য ভাইরাল হওয়া ছবিটা ছাপেনি, তবে কোনও আনুষঙ্গিক তথ্য ও প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানে ওই ন্যক্কারজনক প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা লিখেছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলি হ্যারিসের ওই টুইট এবং ডেইলি টাইমস-এর প্রতিবেদনের যথার্থ্য বিচার না করেই গোগ্রাসে গিলে নেয়।
সংবাদসংস্থা এএনআই তালা-দেওয়া কবরের ছবিসহ পাকিস্তানে মহিলাদের শবের ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার গল্প রসিয়ে বলতে থাকে, যা যাচাই না করেই অন্য সংবাদমাধ্যমও প্রচার করতে শুরু করে। ওয়াইওন, জি নিউজ, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, মিরর নাউ, ইন্ডিয়া টিভি, এনডিটিভি, অমর উজালা, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য প্রিন্ট, ডিএনএ, অপইন্ডিয়া হিন্দি, এবিপি নিউজ, নিউজ ২৪, দৈনিক জাগরণ, ফার্স্ট পোস্ট ইত্যাদি সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তথ্য যাচাই
বুম ছবিটি রিভার্স সার্চ করে ‘তালা-দেওয়া মেয়েদের কবরস্থান’, এই শব্দগুলি বসিয়ে। কিন্তু পাকিস্তানে এই মর্মে আর কোনও খবরই আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি যে সেখানে নেক্রফিলিয়া (শবদেহ সঙ্গম) রুখতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু হ্যারিস সুলতানের আদি টুইটটিতে যারা ‘উত্তর’ দিয়েছেন, তাদের কেউ-কেউ খবরটির সত্যতা বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। কোনও কোনও জবাবে এমনও বলা হয় যে, অনেক সময় কবরস্থানকে অপবিত্র করার অপচেষ্টা ঠেকাতেও এ ভাবে গ্রিল-তালা দিয়ে তা সুরক্ষিত করা হয়। বুম পাকিস্তানি সাংবাদিকদের সঙ্গেও কবরে শায়িত মহিলাদের শবের ধর্ষণ বিষয়ে খোঁজখবর নিতে থাকে। কিন্তু তেমন সন্তোষজনক কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। তবে প্রসঙ্গত এটা জানা যায় যে, প্রায়শ কবরস্থানটি সংরক্ষিত করে রাখতে কিংবা অন্য কারও কবর হিসাবে নতুন করে ব্যবহৃত হওয়া ঠেকাতে কখনও-সখনও এ ভাবে তালাচাবি দেওয়ার রেওয়াজ আছে।
এইভাবে খোঁজ করতে-করতেই আমরা ‘গব্বর০০৯৯’-এর করা একটি টুইটের হদিশ পাই, যেখানে সবুজ রঙের ধাতব গ্রিলের ঢাকা দেওয়া ওই কবরটিরই ছবি আমাদের নজরে পড়ে যায়। সেখানে কবরটিকে ভারতের হায়দরাবাদে অবস্থিত বলে জানানো হয়েছে।
ওই টুইটটিতে যাঁরা ‘উত্তর’ দিয়েছেন, তাঁদের একজন সৈয়দ সলমন লিখেছেন, উক্ত কবরটি হায়দরাবাদের দরাব জঙ কলোনিতে সালার-এ-মুল্ক নামের মসজিদের গায়ে অবস্থিত। আমরা গুগল ম্যাপ-এ মসজিদটির স্থান নির্ণয় করি এবং গুগল স্ট্রিট থেকে মসজিদের সামনের ছবিও সংগ্রহ করি। আর তখনই আমরা দেখতে পাই, মসজিদের প্রবেশপথের সামনেই সবুজ ধাতব গ্রিলে ঢাকা ওই কবরটি, যার ছবি ভাইরাল করে গল্প ফাঁদা হয়েছে।
এআইএমআইএম নেতা ওয়ারিস পাঠান ওই কবরস্থানেই দাঁড়িয়ে তোলা একটি ভিডিও আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন, যাতে গোরস্তানের এক কর্মচারী কবরে তালা লাগানোর বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন।তাঁর মতে পরিবারের লোকেরাই ওই গ্রিল ও তালা লাগিয়ে দিয়েছেন, যাতে আর অন্য কেউ একই কবরে অন্য কোনও দেহ সমাধিস্থ করতে না পারে।
অন্য এক ব্যক্তি ওই কবরস্থানে ঘুরে বেড়িয়ে তাঁর নিজের তোলা একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। তাঁর মতে এটি তাঁর এক বন্ধুর মায়ের কবর, যিনি বৃদ্ধ হয়েছিলেন। ভিডিওতে তিনি জানিয়ে দেন, এই কবরটি ভারতের হায়দরাবাদে অবস্থিত, পাকিস্তানে নয়, এবং শবের ওপর বলাত্কারের গল্পটি ভুয়ো বলে নস্যাৎ করে দেন।
বুম দরাব জঙ কলোনির এক স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গেও কথা বলেছে, যিনি ছবির কবরটিকে মসজিদ-এ-সালার মুল্ক-এর সংলগ্ন বলে শনাক্ত করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর ভুল হবে না, কেননা গত ৫০ বছর ধরে তিনি এখানেই বসবাস করছেন।
আমাদের অনুরোধে তিনি আবারও মসজিদ লাগোয়া কবরস্থানটি সফর করেন এবং সেখানকার কেয়ারটেকারের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সেটির ছবি তুলেও আমাদের পাঠান।
গ্রিল ও তালাচাবি দিয়ে কবরটি ঢেকে দেওয়া প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য—পরিবারের লোকেরাই এই ভাবে গ্রিল আটকে দেন, যাতে অন্য আর কেউ ওই একই স্থানে আর কোনও মৃতদেহ সমাধিস্থ করতে না পারে। তাঁর মতে, “কবর বানানোর খরচ আছে—প্রায় ১৫ হাজার টাকা। তাই অনেকে কবর পুনর্ব্যবহার করে। তাদের ‘কবর দখলকারী’ বলা হয়। এই গ্রিল-টিল দেওয়া হয় ওই সব দখলকারীদের ঠেকাতে।”
বুম কবরস্থানের কেয়ারটেকারের সঙ্গেও কথা বলেছে। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, কবর খুঁড়ে মৃত মহিলাদের শব ধর্ষণের পৈশাচিক ঘটনা তার জানা নেই। তাঁর মতে, এমন কখনও এখানে ঘটতে দেখা বা শোনা যায়নি। এই সব থেকে পরিষ্কার যে, ভাইরাল হওয়া কবরটি পাকিস্তানে নয়, ভারতেই তার অবস্থান এবং কবর খুঁড়ে মৃত মহিলার শবের সঙ্গে যৌন সঙ্গমের কোনও ঘটনাও এ ক্ষেত্রে নেই।
অল্ট নিউজ-এর তথ্য যাচাইকারীরা এর আগে এই ভুয়ো গুজবটির পর্দাফাঁস করেছেন।