পশ্চিমবঙ্গের ফুরফুরা শরিফের (Furfura Sharif) পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকির (Taha Siddiqui) একটি ভিডিও কাটছাঁট (cropped video) করে শেয়ার করে ভুয়ো দাবি তোলা হচ্ছে যে, তিনি নাকি মুসলিমদের (Muslims) বলেছেন হিন্দুদের (Hindus) বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে।
বুম দেখলো, ভিডিওটি কেটে-ছেঁটে তৈরি করা এবং মূল ভিডিওটিতে সিদ্দিকি মুসলিমদের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছেন, শিক্ষায় যেন হিন্দুদের সঙ্গে তারা প্রতিযোগিতা করে।
সিদ্দিকি পশ্চিমবঙ্গের ফুরফুরা শরিফের একজন পীরজাদা, মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে যার প্রভাব যথেষ্ট। অতীতেও সিদ্দিকির সম্পর্কে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার অভিযোগ তোলা হয়েছে এবং ২০২২ সালের জুন মাসে টাইমস নাউ গণমাধ্যমে এই মর্মে একটি অভিযোগ দায়ের হওয়ার কথাও প্রচার করা হয়েছিল।
ভাইরাল করা ভিডিওটিতে দেখানো হয়েছে, ত্বহা সিদ্দিকি বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে মুসলমানদের বলছেন হিন্দুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে l অনুবাদ করলে বক্তৃতার অংশবিশেষ দাঁড়ায় এই রকমঃ “ওহে মুসলমানরা জাগো!হে মুসলিমরা, তোমাদের ছেলেমেয়েদের লড়াই করতে শেখাও! যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত করো! তৈরি হও, প্রস্তুত হও! মুসলিম বাবা-মায়েরাও ছেলেমেয়েদের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হও! আমাদের হিন্দুদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে হবে!”
সাংবাদিক অভিজিৎ মজুমদার টুইটারে এই ভিডিওটি শেয়ার করে ক্যাপশন দিয়েছেন—“ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি মুসলিমদের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন হিন্দুদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য তৈরি হয়!”
কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের বরিষ্ঠ উপদেষ্টা কাঞ্চন গুপ্তও এই ভিডিওটি উদ্ধৃত করে লিখেছেন, “বেশ কয়েক বছর আগে আমি একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম—‘আমার বাংলা কত শ্যামল-সবুজ!’ এবং যথারীতি বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা তার ব্যাপক প্রতিবাদ করেছিল l দুর্ভাগ্যবশত, বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা এই ঘৃণা ছড়ানোর প্রকল্পে সহযোগী l মূর্খরা বোঝে না, এই সর্বগ্রাসী ঘৃণা একদিন তাদেরও গ্রাস করে নেবে!”
বিজেপি কর্মী রাকেশ সিংহ, হিন্দু গণহত্যা নজরদারি (Hindu Genocide Watch) এবং রাষ্ট্রজ্যোতি এই ভিডিওটি শেয়ার করেছে এবং ফেসবুকেও অনেকে শেয়ার করেছে।
ভিডিওগুলি দেখুন এখানে।
তথ্য যাচাই
বুম দেখে ত্বহা সিদ্দিকির বক্তৃতার ভিডিওটি অনেক কেটে-ছেঁটে প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাইরাল করা হয়েছে। পুরো ভিডিওটিতে সিদ্দিকি হিন্দুদের সঙ্গে লড়াই করার কথা বলছেন কেবল শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে।
টুইটারে ভিডিওটির খোঁজ করতে গিয়ে আমরা তমাল সাহা নামে এক সাংবাদিকের একটি টুইট দেখতে পাই, তাতে পুরো বক্তৃতার ভিডিওটি রয়েছে।
তমালবাবুর সেই টুইটে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা উল্লেখ করা অংশটি বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদও করা রয়েছে।
ইউটিউবে সার্চ করে আমরা ২৭ মিনিটের একটি বক্তৃতার ভিডিও-ও খুঁজে পাই, যেখানে সিদ্দিকিকে বলতে শোনা যাচ্ছে, “আমি যখন যুদ্ধ ঘোষণা করার কথা বললাম, তখন দেখলাম মঞ্চে উপবিষ্ট মন্ত্রীরা কেমন যেন চুপসে গেলেন! সকলে বিমূঢ হয়ে গেল, ভাবতে শুরু করল, আমি বুঝি সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করতে চাই!”
ভিডিওটির ১৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের মাথায় এই বক্তব্যই শোনা যাচ্ছে l
এর পরেই সিদ্দিকিকে তাঁর বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বলতে শোনা যায়, “মুসলমানরা, যুদ্ধ করা বলতে আমি তোমাদের তরোয়াল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা বলছি না, লাঠি বা বন্দুক নিয়ে লড়াইয়ে নামার কথা বলছি না। এ লড়াই শিক্ষার জন্য। একজন হিন্দু ছেলের সঙ্গে একজন মুসলিম ছেলের শিক্ষা অর্জনের প্রতিযোগিতা। একটি মুসলিম মেয়েও এক হিন্দু মেয়ের সঙ্গে শিক্ষার লড়াই লড়ে এগিয়ে যেতে পারে। তার পর একদিন বাংলার হিন্দু ও মুসলিম ছেলেমেয়েরা একজোট হয়ে শিক্ষার লড়াইয়ে অন্য রাজ্যের মোকাবিলা করবে। এটাই আমার বলা যুদ্ধ বা লড়াইয়ের সার, এই লড়াই শিক্ষার জন্য!”
লেখাপড়া শেখার ক্ষেত্রে হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের লড়াই এবং তার পর এই রাজ্যের হিন্দু-মুসলিম পড়ুয়াদের অন্য রাজ্যের পড়ুয়াদের সঙ্গে লড়াই অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বিতার অংশটিকে ছেঁটে বাদ দিয়ে ভাইরাল করা হয়েছে দুই সম্প্রদায়ের ধর্মের মধ্যে সংঘর্ষের তত্ত্ব সিদ্দিকির মুখে বসানোর অভিসন্ধি নিয়ে l