সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একাধিক পোস্টে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে যে, উত্তরপ্রদেশে (Uttar Pradesh) ২০১৭ সালে বেকারত্বের হার (unemployment rate) ছিল ১৭.৫%, এবং ২০২১ সালে যোগী আদিত্যনাথের (Yogi Adityanath) সরকারের আমলে তা নেমে ৪.২% হয়েছে।
পোস্টগুলিতে দাবি করা হয়েছে যে, এই তথ্য সেন্টার ফর মনিটরিং দ্য ইন্ডিয়ান ইকনমির (সিএমআইই) (CMIE) রিপোর্ট থেকে নেওয়া হয়েছে। সেন্টার ফর মনিটরিং দ্য ইন্ডিয়ান ইকনমি একটি স্বাধীন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। তারা প্রতি মাসে ভারতে কর্মসংস্থান সংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। প্রকৃত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে বেকারত্বের হার কখনও দুই অঙ্কের ঘরে প্রবেশ করেনি। বরং ২০১৭ সালের সব মাসেই বেকারত্বের হার ৭ শতাংশের কম ছিল। সিএমআইই-র ডেটাবেসে সব রাজ্যের প্রত্যেক মাসের এবং প্রতি চার মাসের বেকারত্বের পরিসংখ্যান রয়েছে। সেখানে বার্ষিক পরিসংখ্যান দেওয়া নেই।
বেকারত্বের যে ৪.২ শতাংশ হারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা-ও ২০২১ সালের বার্ষিক হার নয়। এই পরিসংখ্যান ২০২১ সালের শুধুমাত্র অক্টোবর মাসের বেকারত্বের হার। ২০২১ সালের একাধিক মাসে বেকারত্বের হার ৪.২ শতাংশের বেশিই ছিল।
পোস্টগুলির পরবর্তী অংশে দাবি করা হয়েছে যে, বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী ইজ অব ডুইং বিজনেস (ইওডিবি )তালিকায় উত্তরপ্রদেশ ২০১৭ সালে ১২ নম্বরে ছিল, এবং ২০২০ সালে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। এই পোস্টগুলিতে উল্লিখিত সংখ্যাগুলি সঠিক, কিন্তু যে সূত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা ঠিক নয়। এই তালিকা আসলে সরকারের নিজের তৈরি ইজ অব ডুইং বিজনেস ইনডেক্স থেকে নেওয়া হয়েছে। ইজ অব ডুইং বিজনেস ইনডেক্স কেন্দ্রীয় বাণিজ্য এবং শিল্প মন্ত্রকের শিল্পোন্নয়ন এবং অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য দফতরের তৈরি একটি তালিকা।
আরও পড়ুন: চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আলেকজান্ডারকে যুদ্ধে হারান, আদিত্যনাথের দাবি কি ঠিক?
২০১৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসে। সে কারণেই ওই বছরের পরিসংখ্যানের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে।
নীচে এই দাবিটি দেখতে পাবেন।
পোস্টটি ফেসবুক এবং টুইটারেও দেখা যেতে পারে।
উত্তরপ্রদেশে কর্মসংস্থান
সিএমআইই-র প্রকাশিত মাসিক বেকারত্বের হারের সময়ক্রমানুসারী পরিসংখ্যান অনুসারে, উত্তরপ্রদেশের বেকারত্বের হার ২০১৭ সালের আগে সবচেয়ে বেশি ছিল ২০১৬ সালের জুন মাসে। সেই সময় বেকারত্বের হার ১৮ শতাংশে পৌঁছেছিল। এই থিঙ্ক ট্যাঙ্কের তথ্যভান্ডারে বেকারত্বের বার্ষিক পরিসংখ্যান নেই।
২০১৬ সালের জুলাই মাসে এই বেকারত্বের হার ছিল ১৪.২%, এবং অগস্টে তা বেড়ে হয় ১৭.১%।
তবে ২০১৭ সালে বেকারত্বের হার ১৭% অতিক্রম করেনি, এমনকি ২০১৭ সালে বেকারত্বের হার দুই অঙ্কের সংখ্যাতেও পৌঁছায়নি। ২০১৭ সালের বেকারত্ব সংক্রান্ত তথ্য নীচে দেখতে পাবেন।
এছাড়া সিএমআইই-এর তথ্যভান্ডারে ২০১৭ সালের প্রতি চার মাসের (জানুয়ারি-এপ্রিল, মে-অগস্ট এবং সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) যে পরিসংখ্যান রয়েছে, সেখানে কোথাও উত্তরপ্রদেশের বেকারত্বের হার ১৭% কাছাকাছি বলে উল্লেখ করা হয়নি।
সিএমআইই যে তথ্য দিয়েছে, তা নীচে দেওয়া হল।
পনেরো বছরের ঊর্ধ্বে কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাতে তার যে অংশটি কাজ করতে ইচ্ছুক, কাজ খুঁজছে অথচ কাজ পায়নি, সেই হারটিকেই বলা হয় বেকারত্বের হার।
কোভিড-১৯ অতিমারির প্রথম প্রবাহের মোকাবিলায় লকডাউন শুরু হয়। সেই সময় উত্তরপ্রদেশে বেকারত্বের হার ২০১৭ সালের তুলনায় ঢের বেশি হারে পৌঁছয়। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বেকারত্বের হার ছিল ২১.৫%, এবং মে মাসে ছিল ২০.৪%। তার পর থেকে অবশ্য উত্তরপ্রদেশের বেকারত্বে হার নিম্নমুখী।
ভাইরাল পোস্টে যে ৪.২% বেকারত্বের হারের দাবি করা হয়েছে, তা আসলে সিএমআইই-র ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের পরিসংখ্যান। রাজ্যে বেকারত্বের হারের এটিই সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান। ওই পোস্টে এই পরিসংখ্যানকেই ২০২১ সালের বার্ষিক পরিসংখ্যান বলে মিথ্যে দাবি করা হচ্ছে। ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, অতিমারির দ্বিতীয় প্রবাহের সময়, অর্থাৎ এপ্রিল এবং মে মাসে বেকারত্বের হার ছিল যথাক্রমে ৬.৩% এবং ৬.৯%। অগস্ট মাসে এই হার দাঁড়ায় সাত শতাংশে।
২০১৬ সালে তাঁর দল ক্ষমতায় আসার আগে রাজ্যে বেকারত্বের হার কত বেশি ছিল, এবং তাঁর সরকার কী ভাবে এই হার কমিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ইতিপূর্বেই সেই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন।
সিআইএমই'র সময়ানুক্রমিক পরিসংখ্যান দেখতে পারেন এখানে এবং প্রতি চার মাসের পরিসংখ্যান প্রোফাইল দেখতে পারেন এখানে।
ঈজ অব ডুইং বিজনেস
ওই পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে, ইওডিবি-র তালিকায় উত্তরপ্রদেশের স্থান ২০১৭ সালে ১২ নম্বরে ছিল, এবং ২০২০ সালে রাজ্যটি তালিকার দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। দাবিটি সত্যি। কিন্তু এই তথ্য বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া গেছে বলে যে দাবি করা হয়েছে, তা একেবারেই মিথ্যে।
এই পরিসংখ্যান আসলে সরকারের নিজের ইজ অব ডুইং বিজনেসের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য এবং শিল্প মন্ত্রকের শিল্প উন্নয়ন এবং অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য দফতর, সরকারের স্থির করে দেওয়া কিছু সংস্কারের মাপকাঠি ব্যবহার করে এই রিপোর্টটি তৈরি হয়েছে।
২০২০ সালের রিপোর্ট আসলে ২০১৯ সালের ব্যবসায়িক কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এবং তাতে উত্তরপ্রদেশ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে, যা অন্ধ্রপ্রদেশের পরেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো সংস্থা এখান থেকে নেওয়া তথ্যের সাহায্য নিয়েছে।
যদিও এটি বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য নয়, কিন্তু সরকারের তৈরি ইওডিবি রিপোর্ট বিশ্ব ব্যাঙ্কের সঙ্গে যৌথ ভাবে তৈরি করা হয়।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের নিজস্ব ডুইং বিজনেস রিপোর্টে ক্রমতালিকায় বিভিন্ন দেশের স্থান প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতি বিষয়ে বিভিন্ন অন্তর্দেশীয় রিপোর্ট (২০১৯ সালের রিপোর্টটি যেমন) প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে দেশের প্রধান শহরগুলিতে ব্যবসা করার সুবিধা বিষয়ে অনুসন্ধান করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের নয়ডাও এ রকম রিপোর্টে স্থান পেয়েছে।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে (২০১৯ সালের) শুধুমাত্র মুম্বই এবং দিল্লির উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যান্য রাজ্যের মতোই উত্তরপ্রদেশেরও কোনও উল্লেখ নেই। বরং ভারতের র্যাঙ্কিং ১৪ ধাপ উঠে এসেছে, এবং ১৯০টি দেশের মধ্যে ভারতের র্যাঙ্ক এখন ৬৩।
তবে, ২০১৮ এবং ২০২০ সালের রিপোর্টে তথ্যর কারচুপি রয়েছে, বিশ্ব ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে এই অভিযোগে বিপুল তোলপাড় হয়। একাধিক বরিষ্ঠ আধিকারিক অভিযোগ করেন যে, নিজেদের দেশের র্যাঙ্কিং ভাল করার জন্য সৌদি আরব এবং চিনের মতো দেশ তথ্যে কারচুপি ঘটিয়েছে। এই অভিযোগের ফলেই এ বছর ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ব্যাঙ্ক ঘোষণা করে যে, তারা এই বছর ইজ অব ডুয়িং বিজনেস রিপোর্টটি প্রকাশ করছে না।
আরও পড়ুন: জল চাইলেন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, বিভ্রান্তি ছড়াল ভঙ্গিমার ছবি