দক্ষিণপন্থী হিন্দু সংগঠন আরএসএস-এর (RSS) লেটারহেডে (Letterhead) লেখা একটি চিঠি (letter) এই ভুয়ো দাবি সহ অনলাইনে ভাইরাল করা হয়েছে যে, হিন্দু পুরুষদের আরএসএস (RSS) নির্দেশ দিয়েছে মুসলিম মহিলাদের লোভ দেখিয়ে তাদের হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে।
চিঠিতে হিন্দুদের জন্য ১৫ দিনের একটি প্রশিক্ষণ নেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে, যাতে মুসলিম মহিলাদের সনাতন ধর্মকে বরণ করে নিতে উৎসাহী করে তোলা যায়। কী ভাবে মুসলিম মেয়েদের প্রলুব্ধ করা হবে, সেই সব উপায়ও বাতলে দেওয়া হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়ায় হিন্দু-মুসলিম যৌথ সংসার পাতলে ৫ লক্ষ টাকা করে পুরস্কার দেওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়েছে।
বুম দেখে আরএসএস-এর নামে ছড়ানো এই বিজ্ঞপ্তিটা ভুয়ো। বুম অখিল ভারতীয় প্রচার প্রমুখ সুনীল আম্বেকারের সঙ্গেও কথা বলেছে, যিনি জানিয়েছেন, হিন্দু পুরুষদের উদ্দেশে এ ধরনের কোনও বিজ্ঞপ্তি আরএসএস দেয়নি।
বেশ কয়েকজন সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারী এই ভুয়ো চিঠি শেয়ার করে দাবি করেছে যে, আরএসএস মুসলিম মহিলাদের ধর্মান্তরিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
ফেসবুক পোস্টটি দেখুন এখানে ও এখানে।
তথ্য যাচাই
বুম প্রথমেই আরএসএস-এর লেটারহেডটি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে আর তাতেই বেশ কিছু অসঙ্গতি নজরে পড়ে। ভাষা ব্যবহারে যে ধরনের ভুলত্রুটি রয়েছে, জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সংগঠনের কোনও বিবৃতিতে সচরাচর তা দেখা যায় না। এই ভুয়ো লেটারহেডটিতে কোনও তারিখও দেওয়া নেই, বিবৃতি জারি করা ব্যক্তির নাম কিংবা স্বাক্ষরও নেই। বিবৃতির শেষে কেবল লেখা রয়েছে, “এর প্রতিলিপি নিখিল ভারত হিন্দু সমাজ, বজরং দল, হিন্দুসেনা, হিন্দু যুব বাহিনী এবং সমস্ত হিন্দু সমাজকে পাঠানো হলো।”
আমরা দেখলাম, বয়ানটিতে বেশ কিছু বানান ভুল, ব্যাকরণগত ত্রুটি এবং অসম্পূর্ণ বাক্যও রয়েছে। যেমন ‘উস লড়কি’-র জায়গায় ‘ইস লড়কি’ লেখা হয়েছে। গোটা বিজ্ঞপ্তিটাই ‘প্রথম পুরুষ’-এ লেখা। ‘বজরং দল’-এর বানান লেখা হয়েছে ‘বজরং দিল’।
বিজ্ঞপ্তির ৪ নম্বরে লেখা হয়েছে—“আরও কিছু তথ্য জানতে পারলে আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নেব এবং লোকটির নম্বর নিয়ে নেব”। এখানে হিন্দিতে লেখা এই চিঠি বা বিজ্ঞপ্তির ব্যাকরণের সঠিক ব্যবহার হবে—“মেয়েটির নম্বর নিয়ে নাও।”
লেটারহেডের বয়ানে মুসলিম মহিলাদের প্রলুব্ধ করার অদ্ভূত সব উপায় বা পন্থার কথা বলা হয়েছে। যেমন ৮ নম্বর পয়েন্টে লেখা হয়েছে, “বিবাহিত মুসলিম মহিলাদের তাদের মুসলিম স্বামীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনতে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করতে হবে, যাতে তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।”
৯ নম্বর পয়েন্টে লেখা হয়েছে—“মুসলমান মহিলাকে প্রেম নিবেদন করার জন্য হিন্দুদের উপযুক্ত সুযোগ খুঁজতে হবে এবং তাকে বোঝাতে হবে যে কোনও চাপ নেই...।”
ভাইরাল হওয়া চিঠে বা বিজ্ঞপ্তিটির গোলমেলে অংশগুলো আমরা নীচের ছবিতে শনাক্ত করতে চেষ্টা করেছি।
তা ছাড়া, আরএসএস-এর সরকারি লেটারহেড-এর সঙ্গে এই লেটারহেডটির কিছু অসামঞ্জস্যও বুম-এর নজরে এসেছে।
যেমন আসল লেটারহেডে ‘ওম্’ এই প্রতীকটি লেটারহেডের উপরের বাঁদিকে থাকে একটি গেরুয়া বৃত্তের মাঝখানে এবং তার নীচেই লেখা থাকে ‘সঙ্ঘে শক্তিঃ কলযুগে’।
ভাইরাল হওয়া চিঠি বা নির্দেশিকায় এই কথাগুলি লেখা নেই এবং প্রতীকটাও গেরুয়া বৃত্তের মধ্যে নয়, একটা শাদা বৃত্তের মধ্যে স্থাপিত।
আরএসএস-এর আসল লেটারহেডে ‘ভারত’ শব্দটি তার ঠিকানার মধ্যে বন্ধনীর মধ্যে লেখা থাকে, যা এই চিঠিতে নেই।
আমরা এর আগে আরএসএস প্রচারিত অন্যান্য বিজ্ঞপ্তি খতিয়ে দেখেছি, তাতে অখিল ভারতীয় প্রচার প্রমুখের নাম ও স্বাক্ষর থাকে। ভাইরাল হওয়া এই চিঠিতে সে সব কিছুই নেই।
এর পর বুম আরএসএস-এর প্রচার দফতরের কর্মকর্তা রাজীব তুলির সঙ্গে যোগাযোগ করে এই ভাইরাল বিজ্ঞপ্তির ব্যাপারে আরও বিশদে জানতে। তিনি বুমকে জানান—“এই চিঠিটা ভুয়ো। আরএসএস কখনও এ রকম ভাষা ব্যবহার করে না। এতে যে সব কথা লেখা আছে, সেগুলো আরএসএস-এর মতামত নয়। এতে অনেক ভুলও রয়েছে। শীঘ্রই আমরা এ নিয়ে এফআইআর করব।”
বুম আরএসএস-এর অখিল ভারতীয় প্রচার প্রমুখ সুনীল আম্বেকারের সঙ্গেও এ ব্যাপারে যোগাযোগ করে। তিনি একটি টুইট করে জানান—“আরএসএস-এর নামে সমাজ-মাধ্যমে প্রচারিত এই বিজ্ঞপ্তিটা সর্বৈব ভুয়ো।”
অন্য দিকে আমরা আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সাম্প্রতিক সব বক্তৃতা ও বিবৃতি খুঁটিয়ে পড়ে দেখেছি, কোথাও প্রতি বছর ১০ লক্ষ করে মুসলমান মহিলাকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করার কথা বলা হয়নি।