ইন্দোনেশিয়ার (Indonesia) একটি পুরনো ভিডিওতে এক ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে কিছু লোককে প্রশিক্ষণ দিতে কী ভাবে ধারালো অস্ত্রের আঘাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে হয়। এই ভিডিওটি প্রচার করে ভুয়ো দাবি জানানো হয়, ভিডিওটি নাকি ভারতীয় (India) এক মাদ্রাসার (Madrassa) দৃশ্য যেখানে পড়ুয়াদের মানুষ খুনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
বুম দেখে ভিডিওটি পুরনো এবং ভারতেও তোলা নয়। এটি ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব জাভা প্রদেশের জেম্বার শহরে মাবেস-আল-হাসবিতে তোলা, যাতে দেখানো হয়েছে ধারালো অস্ত্রের আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জাদু-পদ্ধতি।
ভিডিওটিতে দেখা যায়, মেঝেতে বসে থাকা দুই সারি লোকের মধ্য দিয়ে এক ব্যক্তি হেঁটে যাচ্ছে এবং ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাত থেকে কী ভাবে রক্ষা পেতে হয় তা দেখাচ্ছে। প্রশিক্ষণের অঙ্গ হিসাবেই ওই ব্যক্তিকে বসে থাকা লোকেদের ঘাড়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে দেখা যাচ্ছে। ভিডিওটি একটি হিন্দি ক্যাপশন দিয়ে শেয়ার করা হয়েছে, যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “এখানে মাদ্রাসাগুলোয় গলা কাটার চ্রেনিং দেওয়া হচ্ছে, অথচ আমরা এখনও ‘অহিংসা পরম ধর্মে’ পড়ে আছি!”
পোস্টটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
বুম-এর হোয়াট্স্যাপ হেল্পলাইন নম্বরেও (৭৭০০৯০৬৫৮৮) এই পোস্টটি পাঠানো হয়েছে সত্যতা যাচাইয়ের আর্জি সহ।
তথ্য যাচাই
ভিডিওটিকে কয়েকটি মূল ফ্রেমে ভেঙে নিয়ে রুশ সার্চ ইঞ্জিন ইয়ানডেক্স-এ খোঁজ করে আমরা দেখি ২০১৯ সালে সেটির আরও দীর্ঘ ও স্পষ্ট একটি অংশ ইন্দোনেশীয় ব্যবহারকারীরা আপলোড করেছে।
খুব নিবিড়ভাবে ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে আমরা একটি পোস্টার দেখতে পেলাম, যাতে তিনটি লোকের ছবি রয়েছে। ওই ছবিগুলি কেটে নিয়ে আলাদা করে অনুসন্ধান করে আমরা ২০১৯ সালের ইন্দোনেশিয়ায় একটি নির্বাচনী প্রচারের হদিশ পেলাম।
পোস্টারের বিবরণীতে লেখা, “২০১৯ প্রবয়ো প্রেসিডেন্ট আর আই”, যার অর্থ খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখলাম, পোস্টারের একজনের নাম প্রবয়ো সুবিয়ান্তো যিনি এখন ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।
এছাড়াও আমরা অনুসন্ধান চালিয়ে একই স্থান থেকে তোলা এই ধরনের আরও ভিডিও ইউটিউবে আপলোড হতে দেখি।
ইউটিউবে আপলোড হওয়া ভিডিওগুলি আরও খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে আমরা একটি ভিডিওতে দেখলাম সাইনবোর্ডে জায়গাটির নাম উল্লেখ রয়েছে ‘জাভা তিমুর’, অর্থাৎ এটি ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব জাভা প্রদেশ এলাকা।
একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টে এই ভিডিওগুলির একটি আপলোড করা হয়েছে, যার স্থান হিসাবে উল্লেখ রয়েছে মাদুরা, পূর্ব জাভা প্রদেশ।
ভিডিওটি সম্পর্কে আরও বিশদে জানতে বুম ইন্দোনেশিয়ার তথ্য যাচাইকারী সংস্থা ‘মাফিন্দো’ এবং ‘কাপানলাগি ইউনিভার্স’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে।
মাফিন্দোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং তথ্য যাচাইকারী আরিবোয়ো সাস্মিতো আমাদের নিশ্চিত করেন যে ভিডিওটি পূর্ব জাভা প্রদেশের জেম্বের শহরে মাবেস-আল-হাসবি পুসাতে তোলা হয়েছে।
গুগল স্ট্রিট ভিউতে তার সুনির্দিষ্ট স্থানটি নীচে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পোস্টারটি সম্পর্কে সাস্মিতোকে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রচারমূলক পোস্টারের দ্বিতীয় লোকটিকে সান্দিয়াগা সালাউদ্দিন উনো বলে শনাক্ত করেন। ২০১৯ সালে ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ নির্বাচনে প্রবয়ো সুবিয়ান্তো এবং সান্দিয়াগা সালাউদ্দিন উনো যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
পোস্টারে যে ‘০২’ নম্বরটি রয়েছে, তা হলো সুবিয়ান্তো এবং সালাউদ্দিনের প্রার্থীপদের নম্বর। নীচে মুদ্রিত ব্যালট পেপারটিতে চোখ বোলালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।
মাফিন্দোর তথ্য-যাচাইকারী আদি সিয়াফিতরা আমাদের জানালেন, অন্য যে ব্যক্তিটির ছবি পোস্টারে দেখা যাচ্ছে, তিনি হলেন হাবিব রিজিক, কট্টরপন্থী ইসলামি সংগঠন ফ্রন্ট পেম্বেলা ইসলাম-এর নেতা যার কার্যকলাপের জন্য ২০২০ সালে সংগঠনটিকে ইন্দোনেশিয়ায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
কাপানলাগি ইউনিভার্স-এর এলিন ইউনিতা আমাদের জানালেন, ভিডিওতে লোকগুলি সকলে বাহাসা ভাষাতেই কথাবার্তা বলছে। ভিডিওতে তাদের বলতে শোনা যায়, “এখন আমি তোমাকে সরাসরি এই তরবারি দিয়ে আঘাত করছি...এটা কোনও নকল হামলা নয়, সরাসরি আলহাবদির সদর দফতর থেকে আসা হামলা...আল্লাহর ধর্ম এবং স্বদেশকে রক্ষা করা ছাড়া আর কোনও অভিপ্রায় কিংবা উদ্দেশ্য নেই...এখানে ঔদ্ধত্যের কোনও জায়গা নেই... মনে রেখো, অহঙ্কারেরও কোনও প্রশ্ন নেই....আমরা সকলেই হাবিবের দেহরক্ষী...ইসলাম ধর্মের জন্য বলিপ্রদত্ত...ধর্ম ও দেশের জন্য আত্মোত্সর্গ করতে উন্মুখ!”
"অক্ষত থাকতে জাদুশক্তির ব্যবহার"
ইউনিতা জানিয়েছেন যে ভিডিওতে থাকা লোকেরা তাদের বিশ্বাস অনুসারে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করার সময় নিজেকে অক্ষত রাখতে 'রহস্যময়' শক্তি অর্জনের চেষ্টা করতে দেখা যায়। তিনি যোগ করে বলেন, অংশগ্রহণকারীরা ইসলামী ভাবধারার অনুগত ছিল।
ইউনিতা আরও ব্যাখ্যা করে জানান, "ভিডিওতে থাকা পুরুষরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের আঘাত করা হলে তাদের শক্তি যাতে অক্ষত থাকে সেই ক্ষমতা অর্জন করার চেষ্টা করছিল। সবুজ রঙের জামা পড়া লোকটি বলছিলেন, কার্যকলাপটি কোনও আকর্ষণ (মানুষকে বিনোদন দেওয়ার জন্য) অথবা একটি শক্তি জাহির করার অনুষ্ঠান ছিল না বরং ছিল "শক্তি পূরণের" এক অনুষ্ঠান। কার্যকলাপটিতে অংশগ্রহণকারীদের রাষ্ট্র, ধর্ম (ইসলাম) এবং ধর্মীয় নেতাদের রক্ষক হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছিল।"