এককালে লন্ডন থেকে বাসে চড়ে আসা যেত খোদ কলকাতায়। এমনই রূপকথার যাত্রাপথ নিয়ে বাঙালি নেটিজেনদের বিস্ময় আর থামছে না। অথচ প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন এমনটা নাকি সত্যিই সম্ভব ছিল এই সেদিনের ষাট-সত্তরের দশকেই। বিশ হাজার মাইল দুর্গম যাত্রাপথ পাড়ি দেওয়া যেত বাসে সাওয়ার হয়েই।
ইংরেজিতে বাসের গায়ে ''লন্ডন-ক্যালকাটা-লন্ডন'' লেখা এরকমই একটি বাসের ছবি নেটিজেনরা তথ্য-যাচাইয়ের জন্য পাঠিয়েছে বুমের হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইনে। সঙ্গে পাঠানো হয়েছে আলবার্ট ট্যুরস নামে এক ভ্রমন সংস্থার টিকিটের ছবি। লন্ডন কলকাতা যাত্রাপথের পথনির্দেশের পাশাপাশি এই ভ্রমণ টিকিটের মূল্য ছাপা রয়েছে ১৪৫ পাউন্ড।
ছবিদুটি টুইট করে এক টুইট ব্যবহারকারী লিখেছেন, ''আমি শুধু জানতে পারলাম লন্ডন ও কলকাতার মধ্যে একটি বাস পরিসেবা চলত। এর বেশি কিছু কেউ জানে কি, এব্যাপারে আরেকটু বেশি?'' (মূল ইংরেজিতে টুইটের বয়ান:'I just learnt that there used to be a BUS service between London and Calcutta. Has anyone else heard of it, knows anything more?')
I just learnt that there used to be a BUS service between London and Calcutta. 😯😯 Has anyone else heard of it, knows anything more? pic.twitter.com/eAdQCDhJ0B
— Samarpita Mukherjee Sharma 🇮🇳 (@BookLuster) June 29, 2020
তথ্য যাচাই
বুম ছবির সন্ধানের পাশাপাশি প্রত্যক্ষদর্শীরও হদিস পেল। আর এই লন্ডন-কলকাতা বাস সফরের কথা ফলাও করে ছাপা হয়েছিল দেশ ও বিদেশের পত্র-পত্রিকায়।
'কলকাতাগামী বাস' এই শিরোনামে ছবির দেখা মেলে গেট্টি ইমেজেস-এর ওয়েবসাইটে।
সেই ছবির ক্যাপশনে লেখা, '১৯৫৭ সালের ১৫ এপ্রিল লন্ডনে, ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনে প্রথম পৃথিবীর দীর্ঘতম বাস রাস্তায় যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। ৮৫ পাউন্ডের একবারের ভাড়ায় কলকাতা যেতে এই যাত্রা ৫ দিন সময় নেবে। যাত্রীদের মধ্যে দু'জন প্রাক্তন দমকল কর্মী যারা অস্ট্রেলিয়া অভিবাসী, সঙ্গে ভারতীয়রাও রয়েছে এবং অস্ট্রেলিয়ার লোকজন বাড়ি ফিরছে। ফক্স ফটো/হালটন আর্কাইভ/গেট্টি ইমেজেস)'' (ক্যাপশনে ৫ দিন সময় লাগার বিষয়টি সম্ভবত তথ্য বিভ্রাট)
(মূল ইংরেজিতে ক্যাপশন: ''Bus To Calcutta. Passengers at Victoria Coach Station, London, boarding the first run of the world's longest coach route, between London and Calcutta, 15th April 1957. The journey to Calcutta takes five days and the single fare is 85 pounds. Passengers include two ex-firemen emigrating to Australia, as well as Indians and Australians returning home. (Photo by Fox Photos/Hulton Archive/Getty Images)''
বুম নিউইয়র্ক টাইমসের ডিজিট্যাল আর্কাইভের ৩ অগস্ট ১৯৫৭ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন দেখে। ওই প্রতিবেদনে ২০, ৩০০ মাইল পাড়ি দেওয়া লন্ডন-কলকাতা বাস পরিসেবার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার আর্কাইভ প্রতিবেদন বলে ১৯৫৭ সালে লন্ডন থেকে আসা বাস আবার লন্ডন ফিরে যায় জুন মাসে।
প্যাডি গ্যারো ফিসার ছিলেন ওই বাসের চালক। তার বাস চালানের অভিজ্ঞতাও প্রকাশ করেছিল টাইম অফ ইন্ডিয়া। সাটারস্টকে জ্বলজ্বল করছে সেই বাস চালকের ছবি।
বুম জেনেছে ষাটের দশক পেরিয়ে সত্তরের দশকেও ওই বাস পরিসেবা চালু ছিল। অস্ট্রেলিয়া থেকে ইংল্যান্ড অ্যালবার্ট ভ্রমণ পরিবহন সংস্থার টিকিটের ছবিটি দেখা যাবে হাইরোড ফর রোজ নামের ওয়েবসাইটে।
১৯৭৪ সালের ৩ মার্চ লস এঞ্জেলস টাইমসে লেসমা হোসাক এই বাস যাত্রার ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেছেন। ৬০ থেকে ৭০ দিন সময় লাগত লন্ডন থেকে কলকাতা আসতে। অবশ্য তা নির্ভর করতো কোন পথে যাচ্ছে বাসটি।
কলকাতায় কেউ দেখেছেন কি বাস চলাচল? বুম সূত্র মারফত হদিস পায় ব্যারাকপুরের বাসিন্দা ৬৯ বছর বয়সী অম্লান সেনগুপ্তের। সত্তর দশকে কলেজ পড়ুয়া অম্লান সেনগুপ্তের স্মৃতির ভাঁড়ারে এই বাস পরিসেবা দেখার স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে। এমন বাসের দেখা মিলতো ধর্মতলা চত্বরে।
অম্লান সেনগুপ্ত বুমকে বলেন, ''আমি ৫৭ সালের বাস দেখিনি তবে ১৯৬৮-৬৯ সালে ধর্মতলায় কলেজে যাতায়তের পথে এই লন্ডন-কলকাতা বাস দেখেছি। সম্ভবত ব্রিটিশ কোনও সংস্থা এই বাস চালাত। পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে সীমান্ত সমস্যায় বন্ধ হয়ে যায় এই পরিসেবা।''
১৯৫৭ সালের লন্ডন থেকে কলকাতা বাসযাত্রার আরও বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি দেখা যাবে সাটারস্টক আর্কাইভে। বুমকে আর্কাইভ সংবাদপত্রের বিশেষ ছবিগুলি দিয়ে সাহায্য করেছেন অম্লান সেনগুপ্তের ছেলে নিউইয়র্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত অভিরূপ সেনগুপ্ত। অভিরূপ কয়েকদিন ধরে সোশাল মিডিয়ায় বাসের ছবিগুলি দেখে উৎসাহী হয়ে পুরনো পত্রপত্রিকার ছবিগুলি সংগ্রহ করে।