২০১৭ সালের একটি মর্মস্পর্শী ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রাজস্থানের যোধপুরে এক পরিবারের সদস্যরা টিনের চাল থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দুটি শিশুও রয়েছে। এই ছবিটি পাকিস্তানে হিন্দু পরিবারের খুন হওয়ার ঘটনা বলে সোশাল মিডিয়ায় চালানো হয়েছে।
বুম অনুসন্ধান করে দেখে যে ওই ছবিটি এক ফরেন্সিক চিকিৎসকের তোলা। তিনি ২০১৭ সালে ওই দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তীব্র অভাব অনটনের কারণে ওই পরিবার আত্মহত্যা করে।
ছবিটিতে মধ্য বছর ত্রিশ বয়েসের স্বামী, স্ত্রী এবং তাদের দুই ছোট্ট শিশুসহ একই পরিবারের চারজনের দেহ তাঁদের বাড়ির একটি লোহার রড থেকে ঝুলতে দেখা যাচ্ছে। ছবিটি ভাইরাল হয়েছে এবং সঙ্গের ক্যাপশনে দাবি করা হয়েছে যে এটি খুনের ঘটনা, এবং তা পাকিস্তানে ঘটেছে। দাবি করা হয়েছে যে মৃতরা একটি হিন্দু জুতো প্রস্তুতকারীর পরিবার। তাঁদের খুন করা হয়েছে।
ছবিটি দর্শকের পক্ষে বিচলিতকর হতে পারে, তাই বুম এই ছবিটি এই প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করছে না।
ছবিটি ফেসবুকে হিন্দি এবং ইংরেজিতে লেখা ক্যাপশন দিয়ে মিথ্যে বর্ণনার সঙ্গে ভাইরাল হয়েছে। ইংরেজিতে একটি ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, "পাকিস্তানে হিন্দুদের মেরে ফেলা হচ্ছে। এই ছবিতে দেখুন পাকিস্তান হিন্দু জুতো প্রস্তুতকারী পরিবারকে খুন করেছে।"আরও পড়ুন: না, এই মর্মান্তিক ছবিগুলি পাকিস্তানে সংখ্যালঘু পরিবারকে খুনের ঘটনা নয়
তথ্য যাচাই
বুম রিভার্স ইমেজ সার্চ করে এবং এই চার জনের আত্মহত্যার ঘটনাটির ফরেন্সিক তদন্তের রিপোর্ট স্প্রিঞ্জার জার্নালে খুঁজে পায়। ২০১৯ সালে অনলাইন ফরেন্সিক বিজ্ঞান বিষয়ক এই জার্নালে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। বিশ্লেষণ প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল 'চার জনের ঝুলন্ত দেহ: নিজের সন্তানসমেত আত্মহত্যার একটি বিরল ঘটনা।' যোধপুরের অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্স (এআইআইএমএস) ফরেন্সিক মেডিসিনের চিকিৎসকরা এই লেখাটি লেখেন।
ওই কেস রিপোর্টটির লেখকদের অন্যতম নবনীত আতেরিয়ার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। তিনি এআইআইএমএস গোরখপুরের ফরেন্সিক মেডিসিন অ্যান্ড টক্সিকলজি বিভাগের সহকারী আধ্যাপক। আতেরিয়া নিশ্চিত ভাবে জানান যে, ২০১৭ সালের অগস্ট মাসে ওই ঘটনাটি ঘটে এবং ঘটনাস্থলে পুলিশের সঙ্গে উপস্থিত চিকিৎসকদল ওই ছবিটি তোলেন। আতেরিয়া জানিয়েছেন, ঘটনাটি যোধপুরের একটি গ্রামের ঘটনা। সেখানে ঋণে জর্জরিত, তীব্র দারিদ্রের শিকার এক কৃষক পরিবার আত্মহত্যা করে। যোধপুরের ভাকরি গ্রামে মাঠের কছে একটি ছোট ঘরে পরিবারটি থাকত।
জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সারাংশে বলা হয়, "এই পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ থেকে জানা যায় যে এই পরিবারের বাবা মা কৃষক হিসাবে কাজ করতেন এবং তাঁদের রোজগার দিন চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। ঋণ এবং তা শোধ করার অক্ষমতার ফলেই এই পরিবার এই ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ করে। ঘটনাস্থলে এমন কিছু পাওয়া যায়নি যা থেকে মনে হতে পারে যে বাইরের কেউ এই ঘটনায় জড়িত ছিল। এ ছাড়া ময়নাতদন্ত থেকে নিশ্চিত ভাবে জানা যায় যে সন্তানসমেত আত্মহত্যার এই বিরল ঘটনায় গলায় ফাঁসের কারনেই মৃত্যু হয়।"
কেস রিপোর্টে আরও বলা হয় যে পরিবারের বড় ছেলে বেঁচে যায় এবং সে সকালে ঘুম থেকে উঠে পরিবারের বাকিদের ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। সে সঙ্গে সঙ্গে কাছের মন্দিরে দৌড়ে যায় এবং সেখানকার কেয়ারটেকারকে ঘটনাটি জানায়। ওই কেয়ারটেকারই পুলিশে খবর দেন। এই ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক কোনও বিষয় জড়িয়ে থাকার সম্ভাবনা আতেরিয়া একেবারেই নস্যাৎ করে দেন।
পুলিশি তদন্ত থেকে পরে আরও জানা যায় যে ওই পরিবারের খাওয়ার জন্য বাড়িতে এর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরেও এই ঘটনার উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।আরও পড়ুন: পাকিস্তানের হিংসার ছবিকে পশ্চিমবঙ্গের তেলিনিপাড়ায় দাঙ্গার ঘটনা বলা হল