এক মহিলার ছবি চুরি করে 'ডাঃ আইশা'র নামে একটি ভুয়ো টুইটার অ্যাকাউন্ট খুলে বলা হয় সেটি কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একজন সামনের সারির ডাক্তারের, যিনি মারা গেছেন ওই অসুখে। বুম দেখে দক্ষিণ আফ্রিকার এক মেডিকেল ছাত্রীর ছবি সেটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মহিলা বুমকে বলেন, তিনি খুব সম্প্রতি জেনেছেন যে, তাঁর ছবি একটি ভুয়ো অ্যাকাউন্টে ব্যবহার করা হচ্ছে। "আমি জীবিত কিনা জানতে চেয়ে আমার কাছে ফোন আসছে। ওই ছবিগুলি আমারই। কোনও এক ব্যক্তি যিনি আমার ও আমার পরিবারের অ্যাকাউন্টগুলি দেখেন, তিনিই সেগুলি তুলে নেন," বলেন ওই মহিলা। উনি ওয়াল্টার সিসুলু ইউনিভার্সিটির অমথাথা ক্যাম্পাসে মেডিকেলের একজন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। উনি বুমকে লিখে জানান যে, তাঁর নাম আইশা নয়। সেই সঙ্গে, তাঁর ছবিই যে ভুয়ো অ্যাকাউন্টে ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রমাণ করতে উনি তাঁর কলেজের আইডেন্টিটি কার্ডের ছবিও পাঠান।
একটি টুইটার হ্যান্ডেল এক মহিলার ছবি এই বলে পোস্ট করে যে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। ওই পোস্ট দেখে বিভ্রান্ত হলে, ১ অগস্ট 'ডাঃ আলিশা'র প্রতি সমবেদনা জানানর বার্তায় টুইটার ভরে যায়। সাংবাদিক সহ বেশ কিছু যাচাই-করা হ্যান্ডেলও @Aisha_must_sayz থেকে টুইট-করা ওই সংক্রান্ত খবর রিটুইট করেন। একজন কোভিড যোদ্ধা সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়ায় তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পরে অবশ্য ওই টুইটার হ্যান্ডেলটি ডিলিট করে দেওয়া হয়।
একজন প্রকৃত মেডিকেল ছাত্রীর ছবি ব্যবহার করে বলা হয় উনি মৃত
টুইটার
হ্যান্ডেল @Aisha_must_sayz থেকে ডাঃ আইশার শারীরিক অবস্থার ক্রমাবনতির কথা নতুন নতুন টুইটের মাধ্যমে জানানো হতে থাকে। তার সঙ্গে দেওয়া হয় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে-থাকা এক মহিলার ছবি। তাই দিয়ে এটাই বোঝানর চেষ্টা হয় যে, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার পর উনি সেই অসুখের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন। প্রথমে দাবি করা হয়, যে অ্যাকাউন্টটি ডাঃ আইশা নিজেই চালান। পরে বলা হয়, হাসপাতালে আইসোলেশনে থাকার ফলে, অ্যাকাউন্টটি নাকি ওই অস্তিত্বহীন ডাক্তারের বোন চালাচ্ছেন। ওই ভুয়ো অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয় কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ডাঃ আইশার মৃত্যুর খবরও। তার ফলে, আরও একপ্রস্ত টুইটের জোয়ার শুরু হয়, যাতে ওই মারাত্মক ভাইরাসের সংক্রমণে আরও একজন ডাক্তারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হতে থাকে।
কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই ওই অ্যাকাউন্টটি সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। কারণ, অনেকেই লক্ষ করেন যে, ডাঃ আইশা বলে যাঁর ছবিটি দেখানো হয়, সেটি আসলে এক ব্যক্তিকে দাঁতের অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার ছবি। অনেকে বলেন যে, ওই অ্যাকাউন্টটি হল একটি 'ক্যাটফিস' অ্যাকাউন্ট। ক্যাটফিস অ্যাকাউন্ট হল সোশাল মিডিয়ায় এমন একটি অ্যাকাউন্ট যেটি কোনও এক ব্যাক্তি অন্যের পরিচয় দিয়ে তৈরি করেন। ফলে, যিনি অ্যাকাউন্টটি খোলেন, তিনি ওই ধরনের অ্যাকাউন্টে নিজের ছবির বদলে অন্য কারওর ছবি ব্যবহার করেন।
ভুয়ো অ্যাকাউন্টের টুইটগুলির কালক্রম
ডাঃ আইশার অ্যাকাউন্টের আর্কাইভ সংস্করণ থেকে জানা যায় যে সেটি ২০১৯-এর অক্টোবরে খোলা হয় এবং সেটির ছিল ৩,০২৬ 'ফলোয়ার' বা অনুগামী। ওই অ্যাকাউন্টটি এখন ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চলাকালে, সেটি দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী একজন সত্যিকারের ও জীবিত ভারতীয় বংশোদ্ভূত মেডিকেল ছাত্রীর ছয়টি ছবি ব্যবহার করে। আর মিথ্যে দাবি করে যে, উনি হলেন ডাঃ আইশা।
৩০ জুলাই থেকে ওই ভেকধারি অ্যাকাউন্ট হাসপাতালে এক মহিলার ছবি পোস্ট করতে শুরু করে আর বলে যে, উনি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন "এবং তাঁকে ভেন্টিলেটারে দেওয়া হবে।"
অল্প সময়ের মধ্যেই, টুইটটি ভাইরাল হয়ে যায়। যাচাই-করা হ্যান্ডেল থেকেও ওই হালনাগাদ-করা টুইটটি রিটুইট করে, একজন ডাক্তারকে হারানর ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। ২ অগস্টের মধ্যে, ডাঃ আইশার কথা টুইটারে ছড়াতে থাকে এবং নিধি রাজদান ও রাণা আয়ুবের মত সাংবাদিকও ওই ভেকধারী অ্যাকাউন্টের দ্বারা বিভ্রান্ত হন।
রাজদান পরে যখন বুঝতে পারেন যে টুইটটি মিথ্যে, তখন উনি সেটি
ডিলিট করে দেন।
পরীক্ষায় ডাঃ আইশার কোভিড পজিটিভ পাওয়া গেছে বলে মিথ্যে দাবি করার কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যুর খবর পোস্ট করা হয়। বলা হয়, কাল্পনিক ওই ডাঃ আইশার বোন – ডাঃ সরকার – তিনও নাকি একজন ডাক্তার। এবং তিনিই অ্যাকাউন্টটা এখন চালাচ্ছেন। তিনি বলেছেন যে "হাঁপানি, শ্বাসনালির ওপরের দিকে জটিলতা এবং হাইপারটেনশন"-এর মতো অসুখ থাকার ফলে আইশা মারা গেলেন।
পরে, সেই দিনই, কাল্পনিক আইশার সেই তথাকথিত বোন ডাঃ সরকার এক মহিলার ছবি শেয়ার করে বলেন যে, একটি "সিল-করা কফিনে" ডাঃ আইশার মরদেহ পেয়েছে পরিবার। এবং তাঁর অনুরোধে, ডাঃ আইশার সব সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট খুব তাড়াতাড়ি ডিলিট করে দেওয়া হবে।
টুইটটিতে বলা হয়, "উনি অনুরোধ করেছিলেন যে, তাঁর যদি কিছু হয়, তা হলে তাঁর সোশাল মিডিয়ার বন্ধুদের যেন সে কথা জানানো হয়। ভাইরাসের কারণে, আমরা তাঁর মরদেহ একটি সিল-করা কফিনে পাই। আমি তাঁর সব সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দেব।"
তথ্য যাচাই
মুখের চেহারা যাচাই করার একটি সরঞ্জাম ব্যবহার করে বুম নিশ্চিত হয় যে, টুইট-করা ছয়টি ছবি একই ব্যক্তির। তারপর আমরা ছবি থেকে পাওয়া কিছু ক্লু বা ইঙ্গিত ধরে সার্চ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় একজন মেডিকেল ছাত্রীর সন্ধান পাই। টেক্সটের মাধ্যমে উনি আমাদের জানান যে, ওগুলি তাঁরই ছবি। এবং তিনি আরও বলেন যে, তাঁর কোনও কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয়নি এবং তিনি জীবিতই আছেন।
আমরা প্রথমে সব ক'টি ছবি বিশ্লেষণ করে কিছু ক্লু'র সন্ধান করি, যাতে ডাঃ আইশা বলে যাঁর ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই ব্যক্তিকে খুঁজে বার করা যায়। ওই ভুয়ো অ্যাকাউন্ট থেকে যে সেল্ফি পোস্ট করা হয়েছিল, তাতে 'ডাব্লিউএসইউ', এই তিন অক্ষরের একটি লোগো দেখা যায়। এবং যেহেতু ওই অ্যাকাউন্টে সেটির লোকেশন বা স্থান দক্ষিণ আফ্রিকা হিসেবে দেখানো ছিল, আমরা 'ডাব্লিউএসইউ + সাউথ আফ্রিকা' দিয়ে সার্চ করি। দেখা যায়, লোগোটি হল দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়াল্টার সিসুলু ইউনিভারসিটির। এবং ছবিতে যে পোশাক দেখা যাচ্ছে, সেটি সেখানকার হেল্থ সায়েন্স বিভাগের পড়ুয়ারাই পরে থাকে।
আমরা আরও নিশ্চিত হই যে, ছবিতে যে মহিলাকে দেখা যাচ্ছে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকেন। কারণ, আমরা দেখি যে, ছবিতে যে হাসপাতালের বিছানা দেখা যাচ্ছে সেটির বালিশে যে লোগোটি লাগান আছে, সেটি 'লাইফ হেল্থ কেয়ার' হাসপাতালের। সারা দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়েই ওই হাসপাতালের শাখা রয়েছে। এরপর আমরা সেই হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তার মুখপাত্র তান্য়া বেনেটস ই-মেইলে জানান যে, ছবিটা তাঁদের হাসপাতালের, কিন্তু তার সঙ্গে যে কথা জুড়ে দেওয়া হয়েছে তা "ফেক নিউজ" বা মিথ্যে খবর।
যখন আমরা নিশ্চিত হই যে, ভুয়ো অ্যাকাউন্টে যে মহিলার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিন্দা, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়াল্টার সিসুলু ইউনিভারসিটির বিভিন্ন ক্যাম্পাসের যে সব ছাত্রছাত্রীরা ফেসবুকে রয়েছেন, আমরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করি।
ওই ইউনিভারসিটির অমথাথা ক্যাম্পাসের ছাত্র সংগঠনের প্রেসিডেন্ট সিফেসিলহে আয়ান্ডা অমসোমি ছাত্রীটিকে শনাক্ত করেন। কিন্তু তিনি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, সেই দাবি উনি মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেন। অমসোমি বলেন, ছবিতে যাঁকে দেখা যাচ্ছে, তিনি অমথাথা ক্যাম্পাসে মেডিকেলের (এমবিসিএইচবি) ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। এবং তিনি খুবই সুস্থ ও "জীবিত" আছেন।
ওই ইউনিভারসিটির শিক্ষক ননসেকা মাবেনা একই কথা বলেন।
"আমি মারা গেছি কিনা জানতে চেয়ে ফোন আসছে"
বুম নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ছাত্রীটির সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি নিশ্চিত করেন যে, ভাইরাল টুইটের ছবিগুলি তাঁরই। খুব সম্প্রতি উনি ওই ভুয়ো অ্যাকাউন্টটি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং সেই থেকে বিচলিত বোধ করছেন। বুমকে উনি বলেন, "কেউ যে আমার সম্পর্কে এমন জঘন্য গুজ্ব ছড়াতে পারে, তা জেনে আমি খুবই বিচলিত বোধ করছিলাম। আমার ব্যক্তিগত ও আমার পরিবারের সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে কেউ একজন ছবিটি তুলে নেয়। এটা আমাকে আঘাত করা ও ব্যক্তিগত রাগ মেটানর চেষ্টা।"
তিনি আরও বলেন যে, সম্প্রতি আয়োজিত তাঁর জন্মদিনের একটি ভিডিওও টুইট করেছিল ওই অ্যাকাউন্ট।
তাঁর পরিচয় সম্পর্কে যাতে কোনও রকম সন্দেহ না থাকে, তার জন্য ডাব্লিউএসইউ থেকে তাঁকে দেওয়া আইডেন্টিটি কার্ডের একটি ছবি উনি পাঠিয়ে দেন আমাদের। আমরা যে ছবিটা প্রকাশ করেছি তাতে ওই ছাত্রীর ফটো ও নাম অস্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
আইডেন্টিটি কার্ডটি থেকে প্রমাণ হয় যে, ওই মহিলা ডাব্লিউএসইউ-র অমথাথা ক্যাম্পাসে মেডিসিন ও সার্জারির স্নাতক স্তরের ছাত্রী।
উনি জানান যে, হাসপাতালে তাঁর ছবিগুলি তোলা হয় যখন একটি বিশেষ সমস্যার জন্য তাঁকে কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। উনি বলেন, এখন তিনি পরীক্ষা দিচ্ছেন, কিন্তু ঘটনাটি তাঁকে সন্ত্রস্ত ও উৎকন্ঠিত করে তুলেছে।
"আমার পরীক্ষা আছে আর আমি এখন লোকের ফোন পাচ্ছি, যাঁরা জানতে চাইছেন আমি জীবিত কিনা। এটা তো মানুষকে উত্যক্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেউ কারওর সঙ্গে এমন আচরণ করে না," বলেন ছাত্রীটি।