ভারতীয় জনতা পার্টির তথ্য প্রযুক্তি সেলের প্রধান অমিত মালব্য শনিবার একটি কাটছাঁট-করা ক্লিপ শেয়ার করেন। সেটিতে নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্যকে এক বয়স্ক শিখ কৃষকের সামনে লাঠি ঘোরাতে দেখা যাচ্ছে। মালব্য দাবি করেছেন যে, নিরাপত্তা কর্মী তাঁকে আঘাত করেননি।
কিন্তু ভিডিওটির একটি বড় সংস্করণে দেখা যায় যে, ওই বর্ষীয়ান কৃষক, একজন নয়, দু'জন নিরাপত্তা কর্মীর দ্বারা আক্রান্ত হন। এবং প্রথম জনই তাঁকে নিশানা করে।
বুম ওই প্রবীণ ব্যক্তিকে খুঁজে বার করে এবং সুখদেব সিংহ হিসেবে তাঁকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। সিং বর্তমানে দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে রয়েছেন। উনি বলেন, তাঁর হাতে, পিঠে ও পায়ের পেশিতে আঘাত লেগেছে।
"লাঠিটা আমার হাতে আঘাত করলে, সেই জায়গাটা কালচে-নীল হয়ে যায়। আমার পিঠেও আঘাতের চিহ্ন আছে। ওরা বলতেই পারে যে আমার আঘাত লাগেনি। কিন্তু আমি এখানেই আছি। তাঁরা চাইলে আমার আঘাতের চিহ্ন দেখে যেতে পারেন," বলেন কাপুরথালা জেলার সাঙ্গোজলা গ্রামের বাসিন্দা সুখদেব সিংহ।
২৭ নভেম্বর, ২০২০তে, দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তের সিঙ্গলুতে, প্রতিবাদী চাষি ও পুলিশ এবং আধা-সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে হরিয়ানা ও পঞ্জাব থেকে কয়েক হাজার কৃষক দিল্লির উদ্দেশে পদযাত্রা শুরু করেন।
প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া-র (পিটিআই) চিত্রসাংবাদিক রবি চৌধুরী ওই সংঘর্ষের ছবি তোলেন। ছবিটি অল্প সময়ের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায় এবং ওই প্রতিবাদ আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে। রাহুল গাঁধী সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা ছবিটির কথা উল্লেখ করেন ও সরকার আন্দোলন সামলাতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে দাবি করেন।
কিন্তু কিছু দক্ষিণপন্থী ওয়েবসাইট ওই ঘটনার একটি ভিডিও শেয়ার করে। তাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের এড়ানোর জন্য সুখদেব সিংহকে ছুটে যেতে দেখা যায়। 'পোলিটিক্যাল কিডা' ও 'অপইন্ডিয়া'র মত দক্ষিণপন্থী ওয়েবসাইটগুলি ভিডিওটির একটি কেটে নেওয়া ছোট অংশ দেখায়। কয়েক সেকেন্ডের ওই ক্লিপে নিরাপত্তা কর্মীকে লাঠি চালাতে দেখা যায়, কিন্তু তা সুখদেবের গায়ে লাগে না।
সম্পাদনা-করা ক্লিপটি অমিত মালব্য টুইট করেন। সেটি তৈরি করে পোলিটিক্যাল কিডা। তাতে দুটো ছবি একসঙ্গে দেখানো হয়। একটি হল ভাইরাল ছবিটি। আর দ্বিতীয়টি হল ওই কাটছাঁট করা ক্লিপ, যাতে ওই বয়স্ক কৃষককে ছুটতে দেখা যায় এবং তাঁর কোনও আঘাত লাগে না।
ভাইরাল ক্লিপটি সমেত মালব্যর করা টুইটে রাহুল গাঁধীর উল্লেখ আছে। তাতে মালব্য বলেছেন, "রাহুল গাঁধীর মতো অযোগ্য বিরোধী নেতা অনেককাল দেখেনি ভারত।"
টুইটটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে। টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
তার আগে দক্ষিণপন্থী টুইটার অ্যাকাউন্ট পোলিটিকাল কিডা থেকে ক্লিপটি টুইট করা হয়। আর বলা হয়, লাঠি দিয়ে ওই কৃষককে মারা হয়নি।
টুইটটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে। টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
টুইটটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে। টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
সম্পাদন-করা ক্লিপটির ভিত্তিতে অপইন্ডিয়া 'তথ্য যাচাই' করে জানায় যে, বিক্ষোভকারীর শরীরে লাঠি লাগেনি।
অপইন্ডিয়ার দ্বারা ছড়ানো বহু ভুয়ো খবর বুম আগে খণ্ডন করেছে।
প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে।
আরও পড়ুন: সেপ্টেম্বরে পাঞ্জাবে কৃষকদের জাতীয় সড়ক বন্ধের ছবি ছড়াল দিল্লির বলে
তথ্য যাচাই
বুম ভাইরাল ক্লিপের ওই ব্যক্তিকে ৫৭ বছর বয়সী সুখদেব সিংহ হিসেবে সনাক্ত করে। উনি সঙ্গোজলার বাসিন্দা। বর্তমানে দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে কৃষকদের জমায়েতে রয়েছেন। বুমকে তিনি নিশ্চিত করে বলেন তাঁকে লাঠি দিয়ে মারা হয়।
"আমরা সবাই ছুটছিলাম। উর্দি-পরা নয়, এমন যে কোনও ব্যক্তিকেই পুলিশ মারছিল। তারা কাঁদানে গ্যাস শেলও ফাটাচ্ছিল। আমার মনে আছে, আমি এক দিক থেকে অন্য দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। রাস্তার এক দিকের গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা পুলিশ আটকে রেখে ছিল। আমি দেখি, ওরা লাঠি চালাচ্ছে। আমি হাত দিয়ে ওদের লাঠির বাড়ি আটকানর চেষ্টা করি। কিন্তু আমার কব্জির নীচে লাগে লাঠিটা," বলেন সিংহ।
"আমার পায়ে, পিঠে, হাতে আঘাত আছে: সুখদেব সিংহ"
ভাইরাল ফটো ও ক্লিপে দেখা যায়, সুখদেব সিংহয়ের পায়ে আঘাত লাগে। সে সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে, উনি বলেন, "লাঠিটা আমার গোড়ালিতে লাগে। কিন্তু সেখানের আঘাতটা তেমন গুরুতর নয়। তার কারণ, ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্য আমি আমার প্যান্টের নীচে মোটা কাপড় পরেছিলাম।"
নীচের ভিডিওতে সিংহ তাঁর আঘাতের বিষয়ে বলছেন।
আমরা আরও ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণ করি। অনেকের সঙ্গে কথাও বলি। তা থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, পোলিটিক্যাল কিডা-র তৈরি ক্লিপ, যেটি অমিত মালব্য শেয়ার করেন, সেটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই ফেলে দেওয়া অংশে দেখা যায় যে, ছুটে যাওয়ার সময় সিংহ একজন নয়, দু'জন নিরাপত্তা কর্মীর দ্বারা আক্রান্ত হন।
ভয়েস অফ অ্যামেরিকার নিউজের তোলা একটি বড় ভিডিওতে দেখা যায় যে, দ্বিতীয় এক নিরাপত্তা আধিকারিক সিংহকে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন।
আমরা চিত্র সাংবাদিক রবি চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি বলেন, ওই দিন কয়েকজন কৃষক ও বিক্ষোভকারী, পুলিশের তৈরি ব্যারিকেড ভাঙ্গেন। এবং যেখানে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন ছিলেন, সেখানে ঢুকে পড়েন।
"পুলিশ আর বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। পাথর ছোঁড়া হচ্ছিল, ব্যারিকেড ভাঙ্গা হয়েছিল ও একটি বাস ভাঙচুর করা হয়। এরপর ব্যারিকেডের ওপারে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে লাঠি চালায়। ছবিতে যে বয়স্ক লোকটিকে দেখা যাচ্ছে, তাঁর ওপরও লাঠির বাড়ি পড়ে। যে দিকে সব কৃষকরা সমবেত হয়ে ছিলেন, সেই দিকে যাওয়ার সময় তিনি মার খান," বলেন চৌধুরী।
তিনি তাঁরই তোলা আরও একটি ছবির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ইনস্টাগ্রামে আপলোড-করা ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একজন পুলিশ সিংহের পা নিশানা করে লাঠি চালাতে চলেছেন। এই দৃশ্যটি বড় ভিডিওটিতেও দেখা যায়।
এই কৃষক আন্দোলন নিয়ে অসম্পর্তিক ছবি ও ভিডিও ভুয়ো খবর বুম আগেও খণ্ডন করে।