জনপ্রিয় পাকিস্তানি অভিনেত্রী সায়রা ইউসুফ ও ভারতের এক ভোজপুরি গায়কের ছবি বিভ্রান্তিকর দাবি সহ ভাইরাল হল। ওই ছবিতে সায়রা ইউসুফকে সন্ত্রাসবাদী ওসামা বিন লাদেনের মেয়ে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং দাবি করা হয়েছে যে ভারতের এক হিন্দু যুবককে বিয়ে করে তিনি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছেন।
ভাইরাল হওয়া ছবিটি খবরের ক্লিপিং হিসাবে দেখানো হয়েছে এবং তাতে দাবি করা হয়েছে যে সায়রা ইউসুফ লাদেনের মেয়ে জোয়া এবং তিনি ভারতের উত্তরপ্রদেশের প্রদীপ মৌর্য নামের এক যুবককে বিয়ে করেছেন।
বুম অনুসন্ধান করে দেখেছে ছবির ভদ্রমহিলা পাকিস্তানি অভিনেত্রী সায়রা ইউসুফ এবং আমরা ভোজপুরি সঙ্গীতশিল্পী প্রদীপ মৌর্যের এক পরিচিতের সূত্র থেকে নিশ্চিত হয়েছে যে এই শিল্পীর লাদেনের মেয়ে বা তাঁর পরিবারের কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।
ফেসবুক এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ছবিটি বিগত বেশ কিছু বছর ধরে ভাইরাল হচ্ছে। এমনকি আইনজীবী প্রশান্ত প্যাটেল উমরাও ২০১৪ সালে এই ছবিটি শেয়ার করেছিলেন। প্যাটেলকে এর আগেও বিভিন্ন ভুয়ো সাম্প্রদায়িক খবর ছড়াতে দেখা গেছে। তাঁর টুইটে তিনি লিখেছেন, "ওসামা বিন লাদেনের মেয়ে জোয়া উত্তরপ্রদেশের ভোজপুরি গায়ক প্রদীপ মৌর্যকে বিয়ে করতে চলেছেন।"
টুইটটির আর্কাইভ করা আছে এখানে।
আমরা এরপর একই ক্যাপশন দিয়ে ফেসবুকে সার্চ করি এবং গত বৃহস্পতিবারের পোস্ট দেখতে পাই। সেই সঙ্গে পুরানো কিছু পোস্ট চোখে পড়ে, যেগুলি ২০১৫ সালের।
ওই পোস্টের সঙ্গে ক্যাপশন দেওয়া হয়, "এটা কি সত্যি খবর যে সন্ত্রাসবাদী ওসামা বিন লাদেনের মেয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছে?" ((क्या यह खबर सत्य है कि आतंकी लादेन की बेटी हिन्दू स्वीकार कर ली) এবং সঙ্গে একটি অজ্ঞাতপরিচয় খবরের কাগজের তারিখহীন ক্লিপিং দেওয়া হয়েছে, যাতে হেডলাইন দেখা যাচ্ছে, "ওসামা বিন লাদেনের মেয়ে জোয়া এবং সঙ্গীতশিল্পী প্রদীপ মৌর্যের বিয়ে হচ্ছে আগামী মাসে।" (মূল হিন্দিতে: ओसामा बिनलादेन की बेटी जोया और सिंगर प्रदीप मौर्या की शादी अगले महीने)।
ওই প্রতিবেদনে ইউসুফ এবং মৌর্যের ছবি দেওয়া হয়েছে এবং দাবি করা হয়েছে যে ছবিতে যাঁদের দেখা যাছে তাঁরা জোয়া বিন লাদেন এবং মৌর্য। সঙ্গে আরও বলা হয়েছে যে তাঁরা মুম্বইয়ের আর্য সমাজ মন্দিরে বিয়ে করেছেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে জোয়া হিন্দু ধর্ম গ্রহণের পর ইসলামের নিন্দা করেছেন এবং হিন্দু ধর্মের প্রশংসা করে বলেছেন এই ধর্ম "নারীদের সম্মান দেয়।" ওই ক্লিপিং-এ এর পর বলা হয়েছে যে জোয়া ওসামা বিন লাদেনের প্রথম স্ত্রীর বড় মেয়ে।
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
২০১৪ সালে এই একই ক্লিপিং একই মিথ্যে দাবির সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছিল।
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
এই একই দাবি ছবি ছাড়াও শেয়ার করা হয়েছে।
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
বুম তার হোয়াসটসঅ্যাপ টিপলাইনে এই মেসেজটি পেয়েছে।
আরও পড়ুন: কৃষক বিক্ষোভের সমর্থনে দীপিকা পাড়ুকোনের ভাইরাল ছবিটি সম্পাদিত
তথ্য যাচাই
বুম অনুসন্ধান করে দেখেছে যে ভাইরাল হওয়া ক্লিপিং-এ যাকে দেখা যাচ্ছে তিনি জোয়া নন, তিনি পাকিস্তানের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সায়রা ইউসুফ। ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে ইউসুফের কোনও পারিবারিক সম্পর্ক নেই। আমরা ভোজপুরি সঙ্গীতশিল্পী প্রদীপ মৌর্যের এক পরিচিতের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এই সমস্ত দাবি উড়িয়ে দিয়ে জানান যে, এটি ভুয়ো খবর এবং মৌর্য বিন লাদেনের পরিবারের কাউকে বিয়ে করেননি।
ভাইরাল হওয়া পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে, জোয়া ওসামা বিন লাদেনের প্রথম স্ত্রীর বড় মেয়ে। এই সূত্র ধরে আমরা লাদেনের প্রথম স্ত্রী নাজমা ঘানেমের নাম দিয়ে সার্চ করি এবং তাঁদের সন্তানদের সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া যায় কি না তা খুঁজতে থাকি। আমরা নাজমা এবং লাদেনের সন্তানদের নামের উপর কোনও নির্ভরযোগ্য সংবাদ প্রতিবেদন দেখতে পাইনি, তবে আমরা জানতে পারি এই দম্পতির চার কন্যা এবং সাত পুত্র রয়েছে।
ইন্টারনেটে এই দম্পতির সন্তানদের যে অপরীক্ষিত তালিকা রয়েছে তাতে জোয়া নামে কারও উল্লেখ নেই। আমরা ইন্টারনেটে লাদেনের কোনও মেয়ের কোনও ছবিও পাইনি।
বুম গার্ডিয়ানেরএকটি প্রতিবেদন খুঁজে পায়, যেখানে ওসামা বিন লাদেনের পরিবারের তালিকা রয়েছে কিন্তু তাতেও জোয়া নামের লাদেনের কোনো মেয়ের উল্লেখ নেই। ২০০২ সালে সিএনএন'র একটি প্রতিবেদনে বলা হয় লাদেনের ২৬ জন সন্তান সন্ততি রয়েছে কিন্তু সেখানে তাঁদের কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।
আমরা এর পর ওই ক্লিপে যাদের জোয়া বিন লাদেন এবং ভোজপুরি ভাষার শিল্পী প্রদীপ মৌর্য বলে দাবি করা হচ্ছে, তাঁদের ছবি যাচাই করার চেষ্টা করি।
"জোয়া বিন লাদেন"
ওই পোস্টে যে ভদ্রমহিলার ছবি আছে তা দিয়ে আমরা গুগল এবং ইয়ানডেক্সে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখতে পাই বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে সায়রা ইউসুফ বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তিনি পাকিস্তানের এক জন খ্যাতনামা মডেল এবং অভিনেত্রী।
ওই ভুয়ো পোস্টে যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে তা এই অভিনেত্রীরপ্রোফাইলে ব্যবহৃত ছবির দর্পণ বিম্ব। এরপর ইউসুফের বিবাহিত জীবন সম্পর্কে বিশদে খোঁজ করতে গিয়ে আমরা একটি প্রতিবেদন দেখতে পাই, যাতে বলা হয়েছে যে ইউসুফ শাহরোজ সবজওয়াড়ি নামের পাকিস্তানের এক অভিনেতাকে ২০১২ সালে বিয়ে করেন এবং পারস্পরিক অসমঝোতার কারণে ২০২০ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
এই অভিনেত্রী হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছেন বা কোনও ভারতীয় ভোজপুরি গানের শিল্পীর সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক আছে, সে বিষয়ে কোনও সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।
প্রদীপ মৌর্য
ক্লিপে যে ছবি আছে তার উপর রিভার্স ইমেজ সার্চ করে আমরা দেখতে পাই যে ছবিটি ভোজপুরি গায়ক এবং অভিনেতা প্রদীপ মৌর্যর। আমরা দেখতে পাই ওই একই ছবি একটি ব্লগস্পটে আপলোড করা হয়েছে এবং তাতে মৌর্যকে একজন অভিনেতা এবং গোরক্ষপুর ফিল্ম সিটির মালিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মৌর্য সন্দীপ এস দ্বিবেদীর সঙ্গে গোরক্ষপুর ফিল্ম সিটি নামের উত্তরপ্রদেশের একটি ভিডিও প্রোডাকশন কোম্পানি চালান। সন্দীপ এস দ্বিবেদী নামের ব্যক্তি নিজেকে গোরক্ষপুর ফিল্ম সিটির ব্যবসায়িক অংশীদার বলে উল্লেখ করেছেন।
গোরক্ষপুর ফিল্ম সিটির ইউটিউব চ্যানেলে যে নম্বর দেওয়া আছে বুম সেখানে ফোন করে এবং দ্বিবেদীর সঙ্গে কথা বলে। মৌর্য ওসামা বিন লাদেনের কন্যাকে বিয়ে করেছেন, দ্বিবেদী এই দাবি একেবারে উড়িয়ে দেন। দ্বিবেদী বলেন, "এটা ভুয়ো খবর। প্রদীপ বিবাহিত, তবে ওসামার মেয়ের সঙ্গে নয়।"
মৌর্য আমাদের ফোনের কোনও উত্তর দেননি। তাঁর প্রতিক্রিয়া পেলে এই প্রতিবেদনটি সংস্করণ করা হবে।
আরও পড়ুন: বিশ্বের ধনী রাজনীতিকদের তালিকায় সোনিয়া গাঁধী, জিইয়ে উঠল ভুয়ো দাবি