একটি ছবিতে শ্রীলঙ্কার একজন শিল্পীকে একটি ধাতুর পাত পরে থাকতে ও শাড়িতে কাঁটাতার জড়িয়ে রাখতে দেখা যাচ্ছে। পাঁচ বছরের পুরনো ছবিটি এই বলে ভাইরাল হয়েছে যে, উত্তরপ্রদেশের হাথরসে এক তরুণীর কথিত যৌন নিগ্রহের ঘটনার পর এক ভারতীয় মহিলা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।
পোস্টগুলিতে দাবি করা হয়েছে, মহিলা মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি তুলে ধরতে ও ভারতীয় জনতা পার্টি আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে, নিজের গায়ে কাঁটা তার জড়িয়ে নিয়েছেন।
বুম দেখে ছবিটি ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কায় তোলা হয়েছিল। আর ছবিতে যে মহিলাকে দেখা যাচ্ছে, বুম তাঁকে কলম্ববাসী পারফরম্যান্স আর্টিস্ট জননী কূরে হিসেবে সনাক্ত করে।
১৮ সেপ্টেম্বর দলিত সম্প্রদায়ের এক যুবতীকে মারধোর ও নির্যাতন সহ গণধর্ষণ করার অভিযোগ ওঠার কয়েক দিনের মধ্যেই ছবিটি ভাইরাল হয়। শরীরে গভীর ক্ষত সমেত মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও, ২৯ সেপ্টেম্বর সে মারা যায়। তার ঘোরতর আঘাতগুলির মধ্যে ছিল তার কাটা জিব। তাকে শ্বাসরোধ করে মারার চেষ্টা হলে, দাঁতের চাপ লেগে ওই ক্ষত সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনার ফলে উত্তরপ্রদেশ সরকার ও উত্তরপ্রদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ যে, তারা মৃতের মরদেহ পরিবারের হাতে তুলে না দিয়ে, নিজেরাই রাতের অন্ধকারে সেটি পুড়িয়ে দেয়। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ চার অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে আর সেই সঙ্গে সংবাদ মাধ্যমকে হাথরাসে ঢুকতে দিচ্ছে না।
ভাইরাল ছবিটির সঙ্গে দেওয়া হিন্দি ক্যাপশনে বলা হয়েছে, "ছবিটি প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি সরকারের গালে সপাটে চড় কষিয়েছে। তার শব্দ সারা বিশ্বে শোনা যাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছেন না কেবল বিজেপির সমর্থকরা। ভারতে ধর্ষণের সংখ্যা বাড়তে থাকায়, ওই মহিলা নিজের শরীরে কাঁটাতার জড়িয়ে নিয়ে এই বার্তা দিতে চাইছেন যে, বিজেপি সরকারের অধীনে মহিলারা নিরাপদ নয়।"
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
আরও পড়ুন: ভুয়ো স্ক্রিনশট: ইউপির মুখ্যমন্ত্রী বলেননি, 'ঠাকুররা ভুল করতে পারে'
তথ্য যাচাই
বুম দেখে ছবিটি ২০১৫ সাল থেকে রয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বক্তব্য সমেত শেয়ার করা হয়েছে সেটি। আমরা দেখি, ছবিটির উৎস শ্রীলঙ্কা। আর যে মহিলাকে দেখা যাচ্ছে, তিনি সে দেশের পারফর্ম্যান্স আর্টিস্ট জননী কূরে। বুমকে উনি বলেন, ছবিটি ভারতে তোলা নয় এবং ভাইরাল দাবিটি মিথ্যে।
ছবিটির রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে, 'আর্টফার্মশ্রীলঙ্কা' নামের একটি ওয়ার্ডপ্রেস ব্লগ সামনে আসে। তাতে ব্লগার বা লেখক কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার-এ অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। এটিকে সূত্র হিসেবে ধরে আমরা ফেসবুকে সার্চ করি। তা থেকে জানা যায় যে, কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার চলা কালে, তীর্থ পারফরম্যান্স প্ল্যাটফর্ম নামের শিল্পীদের একটি গোষ্ঠীও একটি শো আয়োজন করেছিল। নির্দষ্ট কি-ওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করায়, তীর্থর ওয়েবসাইটের সন্ধান মেলে। তাতে 'ওসারিয়া – জননী কূরে' নামের একটি নিবন্ধ আপলোড করা হয়েছিল। কাঁটাতার জড়ানো ওই মহিলার ছবি দেখা যায় তাতে। সঙ্গে দেওয়া বর্ণনায় বলা হয়, "ওসারিয়া হল একটি সীমাবদ্ধ আচরণবিধির প্রতীক। ওসারিয়া পরলে শ্রীলঙ্কার মহিলারা ও আমিও সেই সীমাবদ্ধতার মধ্যে প্রবেশ করি। ক্ষমতাশালী নেত্রীরা কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে নিজেদের পদমর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝাতে এই ধরনের পোশাক পরেন।"
এর পর আমরা জননী কূরে নামটি দিয়ে সার্চ করি। তার ফলে জানা যায় যে, উনি একজন পারফরম্যান্স আর্টিস্ট। তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরে কোনও না কোনও সামজিক বিষয় সম্পর্কে বার্তা দিয়ে থাকেন। বুম ফেসবুক ও ভিডিও কলের মধ্যমে কূরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। উনি বলেন, ছবিটি ২০১৫ সালে তোলা। আমরা দেখি তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ওই ধরনের পোশাকে কূরের অন্য ছবিও আছে।
তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, কেন তিনি ধাতুর পাত আর কাঁটার তাঁর পরেন? কূরে বলেন, ওসারিয়া পোশাক যে মহিলাদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে, সে কথা সকলকে বোঝানই হল তাঁর উদ্দেশ্য। "শ্রীলঙ্কাজুড়ে মহিলারা ওসারিয়া পোশাক পরেন। এমনকি মহিলা রাজনীতিবিদ ও সরকারি আধিকারিকরাও তা পরেন। কিন্তু ওই পোশাকের সঙ্গে যুক্ত কিছু নির্দিষ্ট আচরণবিধি আছে, যা সীমাবদ্ধ করে দেয় তাঁদের আচরণকে । ওই পোশাক পরা মানে একজন মহিলা জোরে হাসতে পারবেন না, দৌড়তে পারবেন না, দ্রুত হাঁটতে পারবেন না, মদ খেতে পারবেন না ইত্যাদি। ওই পোশাক পরে ও তার সঙ্গে কাঁটাতার জড়িয়ে নিয়ে, আমি সেই সীমাবদ্ধতার প্রতিই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছি," বলেন কূ্রে।
কূরে আরও বলেন, ভাইরাল ফটোটি মার্চ ২০১৫ সালে তাঁর দ্বিতীয় প্রদর্শনীর সময় তোলা হয়। "কলম্বোর জেডিএ পেরেরা গ্যালারিতে আয়োজিত স্পেস প্রদর্শনীতে আমি প্রথম ওসারিয়া শাড়ির সঙ্গে কাঁটাতার লাগাই। তারপর মার্চ ২০১৫'য় কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে তীর্থমের অনুষ্ঠানে সেটি আবার পরি। সেটি ছিল একটি পথ প্রদর্শনী। ভাইরাল ছবিটি ওই দ্বিতীয় শো চলাকালে তোলা হয়।"
ভাইরাল পোস্টটিকে তিনি ভুয়ো বলে বর্ণনা করেন। তিনি আরও বলেন, ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে তা আদৌ ভারত সরকার বা কোনও রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়। "কাঁটাতারের প্রদর্শনীটা ২০১৫ সালের। ওটির উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র শ্রীলঙ্কায় ওসারিয়া শাড়ি পরার যে চল আছে, সে বিষয়ে একটি বার্তা দেওয়া। ভারতের সঙ্গে বা বর্তমানে ধর্ষণ ও মেয়েদের নিরাপত্তার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই," বলেন কূরে।
আরও পড়ুন: ফুলবাগান মেট্রো স্টেশনে বাংলা লেখা নেই ভুয়ো দাবি সব ছবি ভাইরাল