সোমবার রাতে এক 'এক্সক্লুসিভ' সম্প্রচার করে টাইমস নাউ চ্যানেল দাবি করে যে, পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া নিয়ে তিস্তা শেতলবাদ এবং জিয়া নোমানির এই 'গোপনে রেকর্ড করা' কথাবার্তা তারাই প্রথম প্রকাশ্য নিয়ে এল। কিন্তু এটা চ্যানেলটির দাবি মতো দেশের নিরাপত্তা সংস্থার খুঁজে পাওয়া কোনও 'গোপন টেপ' নয়, বরং ওয়েবিনার-এ এটি সুলভ। ফেসবুক এটা জীবন্ত সম্প্রচার করেছিল, যাতে উভয় সমাজকর্মীকেই দেখা যাচ্ছে পিএফআই-এর কার্যকলাপের নিন্দা করতে।
ফেসবুকে সম্প্রচারিত মূল ওয়েবিনার-এর যোগসূত্রটি বুম খুঁজে পেয়েছে এবং তার সঞ্চালক পেডেস্ট্রিয়ান পিকচার্সের সঙ্গেও কথা বলেছে। তাঁরা বলেছেন, এর মধ্যে গোপন কোনও ব্যাপারই নেই। ওই সংযোগ বা লিংকটি এখনও ফেসবুকে রয়েছে এবং যে-কেউ সেটা খুলে দেখতেই পারে।
টাইমস নাউ এই সমাজকর্মীদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, যাঁরা একান্তে পিএফআই-এর ক্রিয়াকলাপের সমালোচনা করছেন আর প্রকাশ্যে উমর খালিদকে সমর্থ করেছেন, যে দিল্লিতে অশান্তি সৃষ্টির জন্য পিএফআই-এর কাছ থেকে টাকা তুলেছে বলে পুলিশের অভিযোগ।
টাইমস নাউ-এর প্রধান সম্পাদক রাহুল শিবশংকর সোমবার অনুষ্ঠানটি পেশ করেন, যার কিছুক্ষণ আগেই একটি বিশেষ আদালত 'ঘৃণার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ' নামক সংগঠনের নেতা উমর খালিদকে ১০ দিনের জন্য পুলিশি হেফাজতের শাস্তি দিয়েছেন ১৩ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে দিল্লি পুলিশ উমর খালিদকে দিল্লি-দাঙ্গার প্রধান পাণ্ডা হওয়ার অভিযোগ এনে গ্রেফতার করে, যে দাঙ্গায় অন্তত ৫৩ জন মানুষ প্রাণ হারান।
টাইমস নাউ চ্যানেলের বিতর্কমূলক অনুষ্ঠানটিতে বেশ কিছু চমকপ্রদ শিরোনাম ব্যবহার করা হয়, যেমন—'রোমাঞ্চকর গোপন রেকর্ডিং পাওয়া গেছে', '#উমর সমর্থকদের গোপন টেপ', ইত্যাদি। সঞ্চালক শিবশংকর অনুষ্ঠান চলা কালে বলতে থাকেন, এই ভিডিও ক্লিপগুলি একটা গোপন ব্যক্তিগত কথোপথনের রেকর্ড এবং তদন্তকারী গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কাছে এই ক্লিপগুলি ফাঁস হয়েছে, যা নাকি শুধু এই চ্যানেলই দর্শকদের জন্য সংগ্রহ করেছে।
আরও পড়ুন: দিল্লি দাঙ্গা: উমর খালিদের ১০ দিনের পুলিশি হেফাজত
'নিরাপত্তা এজেন্সির হাতে আসা টেপ', এই মর্মেও চ্যানেলটির ক্লিপ দেখানোর অনুষ্ঠানে লিখে দেওয়া হয়। উপরের ছবিতে সেই কথাগুলি লাল কালিতে হাইলাইটও করা হয়েছে।
সম্প্রচারিত ক্লিপটিতে স্বরাজ ইন্ডিয়া রাজনৈতিক দলের জিয়া নোমানি এবং সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদকে স্পষ্টভাবে পিএফআই-এর কাজকর্মের সমালোচনা করতে শোনা গেছে। নোমানিই প্রথম ব্যাঙ্গালোরের হিংসায় পিএফআই যে ভূমিকা পালন করছে, সেই প্রসঙ্গ তুলে বলছেন, "আমি অন্য একটি দক্ষিণপন্থী সংগঠনের দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যারা ব্যাঙ্গালোরে মুসলিমদের সঙ্গে সক্রিয় হয়েছেl আমি নিশ্চিত, ব্যাঙ্গালোরে যা ঘটছে, তা নিয়ে আপনারা সকলেই উদ্বিগ্ন এবং ওই সব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার ভিত্তিতে যে ধারণা তৈরি করা হচ্ছে, তাও উদ্বেগজনকl কিন্তু আমরা সবাই ভুলে যাচ্ছি দক্ষিণপন্থী সংগঠন সোশাল ডেমোক্রাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া (এসডিপিআই) এবং পিএফআই-এর উত্থানের কথা...."
এই সময়েই শেতলবাদকে বলতে শোনা যায়, "আমি আপনার সততার প্রশংসা করছি, তবে আমি এর সঙ্গে শুধু দুটো কথা যোগ করতে চাই...আর তা হলো, যখনই মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দেখা দেয়, তখন তার মোকাবিলা করার কোনও প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় না, আর সেটা মোটেই ঠিক নয় l আমি শুধু এই কথাটাই বলব যে, পিএফআই এবং এসডিপিআই-এর মতো সংগঠন আমাদের কাজের ক্ষেত্রে অসুবিধা সৃষ্টি করছে, আমরা মানে 'কমিউনালিজম কমব্যাটস', 'সিজেপি', 'সবরঙ ইন্ডিয়া' প্রভৃতি এবং প্রকাশ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ওদের সঙ্গে অভিন্ন কোনও মঞ্চে আমরা অংশীদার হব না l যারা নিজেদের বামপন্থী মনে করে, তাদেরও ওদের সংশ্রব এড়়িয়ে চলাই উচিত l"
ভিডিও ক্লিপটির আর্কাইভ করা আছে এখানে।
আরও পড়ুন: পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী কঙ্গনা? ভাইরাল ভুয়ো খবর
তথ্য যাচাই
বুম দেখেছে, টাইমস নাউ প্রচারিত ক্লিপটি কোনও গোপন কথোপকথন বা তার রেকর্ডিং নয়। এবং গত ১৬ অগস্ট ফেসবুকে এটি সরাসরি সম্প্রচার করেছিল পেডেস্ট্রিয়ান পিকচার্স নামে একটি ওয়েবিনার। ওই ওয়েবিনার এবং ফেসবুক লাইভ-এ তার সম্প্রচার এখনও জনসাধারণ ইচ্ছে করলে দেখে নিতে পারেন।
টাইমস নাউ প্রচারিত ক্লিপটি আসলে দীর্ঘ তিন ঘন্টার একটি আলোচনার অংশ, যার শিরোনাম ছিল—'তীব্র রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের সময় বাক-স্বাধীনতাকে রক্ষা করার উপায়'l ওয়েবিনারটি পেশ করে পেডেস্ট্রিয়ান পিকচার্স নামে একটি মিডিয়া সক্রিয়তা গোষ্ঠী, যারা বিভিন্ন সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে তথ্যচিত্র বানায় এবং যাতে মুস্কান রাজ, আবদুল আজিজ, কে পি শশী, অ্যাডভোকেট এস বালান ছাড়াও তিস্তা শেতলবাদ এবং নোমানিরা অংশগ্রহণ করেন।
নোমানি ও শেতলবাদের আলোচনাটা ক্লিপটির ২ ঘন্টা ৪০ মিনিট ৫২ সেকেন্ড থেকে ২ ঘন্টা ৪৯ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড পর্যন্ত টাইমস্ট্যাম্পে শোনা যাবে। নীচে ওই একই ওয়েবিনার-এর ফেসবুক লাইভ লিংকটি দেওয়া হলঃ
বুম পেটেস্ট্রিয়ান পিকচার্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রদীপ কে পি-র সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি টাইমস নাউ-এর দাবিটি খারিজ করে দেন। বলেনঃ ক্লিপটি ১৬ অগস্টের একটি অনুষ্ঠানের, যাতে একজন পিএফআই নিয়ে কথা বললে তিস্তা তার জবাব দেন। তিনি বলেন, ওয়েবিনারটি আদৌ প্রাইভেট নয় এবং যে-কেউ যাতে আলোচনায় অংশ নিতে পারেন, সে জন্য ফেসবুকে একটি লিংকও দেওয়া হয়। "আমরা ফেসবুকে এটি জীবন্ত সম্প্রচার করি এবং যে-কোনও ব্যক্তি তাতে সরাসরি যোগ দিতে পারেন l আমরা সে কারণেই একটি প্রকাশ্য আমন্ত্রণও জানিয়েছিলাম, যেটা এখনও ফেসবুকের পাতায় দেখা যাচ্ছে" l
নীচে ফেসবুকের ওই রেজিস্ট্রেশনটি দেখা যেতে পারেঃ
এখানে ক্লিক করুন।
বুম তিস্তা শেতলবাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করে, যিনি এই কথোপকথনের গোপনীয়তার বিষয়টি সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেন। "অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক দীপু (প্রদীপ) একজন তথ্যচিত্র নির্মাতা এবং সে-ই কয়েকজন সমাজকর্মীকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানায় l স্বরাজ ইন্ডিয়ার নোমানিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনিই ব্যাঙ্গালোরের ঘটনায় পিএফআই-এর ভূমিকার প্রসঙ্গটি তোলেন l উনি যখন কথা বলছিলেন, তখনই আমি বলি যে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা আমরা যখন আরএসএস ও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার মতো বৃহত্তর বিপদের মোকাবিলা করছি, তখন কোনও-কোনও গোষ্ঠীর মধ্যে যে জঙ্গি মনোভাব ও প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সে বিষয়েও আমাদের কথা বলা দরকার" l
শেতলবাদ বলেন, "এর আগেও তিনি পিএফআই-এর বিরুদ্ধে বক্তব্য পেশ করেছেন এবং পিএফআই-এর সঙ্গে উমর খালিদের সংযোগ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য—এটা সম্পূর্ণ একচোখোমি...কারণ কে না জানে রাহুল শিবশংকর কি কোনও তদন্তকারী গোয়েন্দা? আপনারা যদি খালিদের বিভিন্ন বক্তৃতা, অনুষ্ঠান অনুসরণ করেন, দেখবেন ও কেবল ভারতীয় সংবিধান নিয়ে কথা বলছে l আমি বিশ্বাস করি না যে খআলিদ পিএফআই-এর সঙ্গে যুক্ত l আমার মতে, এটা এই চ্যানেলের তরফে খালিদকে ডাইনি-খোঁজা করারই নামান্তর" l
টাইমস নাউ-এর দাবিকে নস্যাত্ করে স্বরাজ ইন্ডিয়া টুইট করেছে, "ওহে টাইমস নাউ! তোমাদের হতাশ করার জন্য দুঃখিত l তোমরা যাকে সুপার এক্সক্লুসিভ স্টোরি বলে দাবি করছো, তা বহু দিন ধরেই প্রকাশ্য আলোচনায় রয়েছে !"
বুম খালিদের আইনজীবীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে, তাঁর জবাব পাওয়া গেলেই প্রতিবেদনটি সেই অনুযায়ী হালনাগাত করা হবেl
আরও পড়ুন: ভিন্ন ধর্মে বিবাহিত দস্পতির ছবিকে মিথ্যে করে কপিল মিশ্রর বোন বলা হল