এ'বছর ফেব্রুয়ারি মাসে, উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, সেই সংক্রান্ত মামলায় দিল্লি পুলিশের বিশেষ সেল ১৬ সেপ্টেম্বর চার্জশিট দাখিল করে। ১৭,৫০০ পাতার চার্জশিটে একটি ষড়যন্ত্রের ছকের বিবরণ দেওয়া হয়েছে, যেটি নাকি ওই দাঙ্গার মূল কারণ। ২৩ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারির ওই দাঙ্গায় ৫৩ জন প্রাণ হারান ও জখম হন আরও বহু মানুষ।
ছ' মাস ধরে চলে ওই তদন্ত। তারই মধ্যে ২৮ জুলাই ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা কপিল মিশ্রকে তাঁর ২৩ ফেব্রুয়ারির ভাষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায় ওই বিশেষ সেল। কারণ অভিযোগ হল, তাঁর সেদিনকার ভাষণ হিংসার সূত্রপাত ঘটায়।
মিশ্র হলেন দাঙ্গাপীড়িত কারওয়ান নগরের একজন প্রাক্তন বিধায়ক। চার্জশিটে তাঁর যে প্রতিক্রিয়া নথিভুক্ত করা হয়েছে, তা থেকে জানা যায় যে, উনি পুলিশকে বলেন যে, উনি কোনও ভাষণ দেননি। মিশ্র দাবি করেন, অবরোধের জন্য স্থানীয় মানুষ বিশেষ অসুবিধের মধ্যে পড়েন আর সেই সমস্যার সমাধান করতেই তিনি সেখানে গিয়ে ছিলেন।
যে ভিডিওটি সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে দেখা ও শোনা হয়, তা থেকে এটা মনে হতে পারে যে, সিএএ (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী বিক্ষোভকারী বলে যাঁদের চিহ্নিত করা হয়, তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য মিশ্র পুলিশকে আলটিমেটাম দেন। রাজধানী দিল্লিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সফরে আসার আগের দিন, পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (ডিসিপি) ভেদ প্রকাশের সামনেই মিশ্র তাঁর বক্তব্য রাখেন।
সাম্প্রদায়িক হিংসা উস্কে দিয়েছেন বলে মিশ্রর বিরুদ্ধে
অভিযোগ [] পুলিশ ধামাচাপা দিচ্ছে বলে
রিপোর্টে যা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে পুলিশের দ্বারা নথিভুক্ত করা মিশ্রর বয়ানের সামঞ্জস্য নেই। ১৩ জুলাই, দিল্লি হাইকোর্টকে পুলিশ জানায়, ফেব্রুয়ারির দাঙ্গায় কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ভূমিকা সম্পর্কে "পদক্ষেপ নেওয়ার মতো কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।
"কোনও ভাষণ দিইনি, পুলিশকে অবরোধ সরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম
সাম্প্রদায়িক হিংসা উস্কে দেওয়ার অভিযোগে মিশ্রর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার একাধিক আবেদন কোর্টে জমা পড়লে, ঘটনার পাঁচ মাস পর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পুলিশ কর্তারা তাঁকে তলব করেন।
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কি ২৩/০২ তারিখে উত্তরপূর্ব দিল্লিতে কোনও ভাষণ দিয়ে ছিলেন? যদি দিয়ে থাকেন, আপনার ভাষণের বিষয় কী ছিল? উত্তরে মিশ্র কোনও ভাষণ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। উনি বলেন, উনি কেবল পুলিশকে তিন দিনের মধ্যে অবরোধ তুলে দেওয়ার অনুরোধ (মিনতি) করেন। আর তা না করলে, তিনি ও তাঁর অনুগামীরাও রাস্তায় ধর্নায় বসতে বাধ্য হবেন, বলে জানান।
জানতে চাওয়া হয়, কেন উনি সেখানে গিয়ে ছিলেন। উত্তরে মিশ্র বলেন, উনি ওই এলাকারই বাসিন্দা। এবং সাধারণ মানুষের অসুবিধে দেখে উনি বিচলিত বোধ করেন। "আমি দেখি, (সিএএ বিরোধীদের বিক্ষোভের কারণে) যে অবরোধ চলছিল, তার জন্য কিছু মানুষ তাঁদের ভোগান্তির কথা পোস্ট করেছিলেন ফেসবুকে।"
"লোকজন অফিস যেতে পারছিলেন না। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছিল না। অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা দেওয়া যাচ্ছিল না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা পুলিশকে জানাতে এবং অবরোধ সরিয়ে দেওয়ার দাবি করতেই আমি সেখানে গিয়ে ছিলাম। তার আগে, আমি ডিসিপি সূর্যর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম," মিশ্র এমনটাই বলেছিলেন বলে লিপিবদ্ধ করা আছে চার্জশিটে।
আমরা আপনাদের কথা শুনব না, মিশ্র পুলিশকে বলছেন ভিডিওতে
"ইউটিউবে একটি ভিডিও আছে। তাতে আপনি বলেছেন 'ট্রাম্পকে যানে কে বাদ' (ট্রাম্প চলে যাওয়ার পর)। ওই কথা বলে, কী বোঝাতে চেয়েছেন আপনি?" পুলিশের তরফ থেকে প্রশ্ন করা হয় তাঁকে।
উত্তরে মিশ্র বলেন, "এর মানে হল, আমি ডিসিপি সূর্যকে বলি যে, রাস্তা অবরোধমুক্ত না করলে আমরাও ধর্নায় বসব...এই নিয়েই আমি ডিসিপি সূর্যকে বলি, যিনি ওখানে উপস্থিত ছিলেন, ট্রাম্প ফিরে যাওয়ার পর অবরোধ সরিয়ে দিতে হবে। আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি। আমি এটাই বলি। ইউটিউবে মিলিয়ে নিতে পারেন।"
কিন্তু ভিডিওটি সেখানেই শেষ হয় না। ৪১ সেকেন্ডের ক্লিপটিতে মিশ্র আরও বলেন ট্রাম্প রাজধানীতে থাকা অবধি তাঁরা শান্তি বজায় রাখবেন। তার পরে যদি রাস্তা অবরোধমুক্ত না হয়, তা হলে তাঁরা পুলিশের কথাও শুনবেন না। হিন্দিতে উনি যা বলেন, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, "রাস্তা খালি না হলে আমরা আপনাদের কথাও শুনব না। ট্রাম্প ফিরে যাওয়ার মধ্যে আপনারা জাফরাবাদ ও চাঁদবাগ খালি করিয়ে নিন। এখন আমরা আপনার কাছে মিনতি করছি। পরে আমাদের রাস্তায় নামতে হবে।" এর পরে উনি 'ভারত মাতা কি জয়' ও 'বন্দে মা তারম' ধ্বনি তোলেন।
তাঁর ৪১ সেকেন্ডের বার্তাটি তিনি টুইটারে টুইটও করেন। যে টুইটে দিল্লি পুলিশের টুইটার হ্যান্ডেল ট্যাগ করা ছিল, পরে সেটি ডিলিট করা হয়। টুইটটির আর্কাইভ করা আছে
এখানে।
বার্তার এই অংশটি সম্পর্কে পুলিশ এবং মিশ্র উভয়ই নিশ্চুপ।
মিশ্রর গ্রেপ্তারি দাবি
হিংসার ঘটনার পরেই, তাঁর উস্কানিমূলক ভাষণের জন্য মিশ্রর গ্রেপ্তারি চেয়ে নগর কোর্ট ও হাইকোর্টে একাধিক আবেদন জমা পড়ে। ২৬ ফেব্রুয়ারি, ভারতের সলিসিটার জেনেরাল ও উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকরা ভিডিওটি দেখেননি বলে দাবি করায়, দিল্লি হাইকোর্ট মিশ্রর ক্লিপটি সহ আরও চারটি ভিডিও তাঁদের দেখায়।
সেই সময়, শুনানি চলাকালে হাইকোর্ট তার "
সাংবিধানিক যন্ত্রণার" কথা বলে এবং কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য পুলিশকে তিরস্কার করে।
স্পেশ্যাল কমিশনার অফ পুলিশ পরবেশ রঞ্জন
আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেন, "আসলে, ওই দিন, কিছু বিক্ষোভকারী জোর করে জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনের নীচের জায়গাটা দখল করে নেয়। তার ফলে মূল লিঙ্ক রোডটি বন্ধ হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা স্থানীয়দের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ সৃষ্টি করে। রবিবার [কপিল] মিশ্র হঠাৎ জানিয়ে সেখানে চলে আসেন। ডিসিপি তাঁকে না আসার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তবুও মিশ্র ভাষণ দেন। এর পর ডিসিপি মিশ্রকে সরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন, কিন্তু তাঁর অনুগামীরা বসে থাকে। তার ফলে এক নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর পর পুলিশ দলগুলিকে সরানো চেষ্টা করে এবং এখনকার পরিস্থিতি তৈরি হয়।"