অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল কাছে একটি আবেদন পেশ করা হয়েছে আদালতের বিরুদ্ধে কুৎসা করার দায়ে অভিনেত্রী স্বরা ভাস্করের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক আদালত অবমাননার মামলা শুরু করার জন্য।
ঊষা সেট্টি নামে ওই আবেদনকারীর অভিযোগ, ১ ফেব্রুয়ারি স্বরা ভাস্কর মুম্বই কালেক্টিভে বক্তব্য পেশ করার সময় রামজন্মভূমি নিয়ে শীর্ষ আদালতের রায় সম্পর্কে অবমাননাকর ও কুৎসামূলক মন্তব্য করেছেন, যা গোটা বিচারব্যবস্থা ও দেশের সংবিধানের প্রতি তার দায়বদ্ধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
ওই দিন এক আলোচনাসভায় স্বরা নাকি বলেছিলেন, "আমরা এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছি, যখন আদালতগুলি নিশ্চিত নয় তারা সংবিধানের প্রতি আস্থাশীল কিনা।
"আমরা এমন একটা দেশে বাস করি, যার সর্বোচ্চ আদালত রায় দেয়, বাবরি মসজিদ ধূলিসাৎ করা বেআইনি, অথচ একই রায়ে যারা সেই বেআইনি কাজটি করলো, তাদেরই পুরস্কৃত করে..."
এই উদ্ধৃতি দিয়ে ঊষা সেট্টির অভিযোগ, স্বরা ভাস্কর একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁর এই কুৎসামূলক বক্তব্য সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী করে তোলার অপচেষ্টা।
সেট্টির আবেদনটি দাখিল করা হয়েছে অ্যাডভোকেট অনুজ সাক্সেনা, প্রকাশ ভার্মা এবং মেহক মহেশ্বরী মারফত। প্রসঙ্গত, মধ্যপ্রদেশের গুনা-র বাসিন্দা এই মহেশ্বরীর আবেদনের উপরেই অ্যাডভোকেট প্রশান্ত ভূষণকে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর কয়েকটি টুইটের জন্য আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছে।
কোর্টের কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছে, এমন দুটি টুইটের জন্য ১৪ অগস্ট সুপ্রিম কোর্ট প্রশান্ত ভূষণকে দোষী সাব্যস্ত করে। তাঁর শাস্তির রায় ঘোষণার দিন ধার্য হয়েছে ২০ অগস্টl শীর্ষ আদালতের বক্তব্য, 'বিচারবিভাগকে যখন হেয় করা হচ্ছে, তখন তারা নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না।'
আদালত অবমাননা কী?
এটা হল বিচারবিভাগকে অনভিপ্রেত এবং অভিসন্ধিমূলক আক্রমণ থেকে রক্ষা করার একটা বন্দোবস্ত, যা বিচারবিভাগের কর্তৃত্ব খর্ব করার প্রয়াসকে শাস্তি দেয়।
১৯৭১ সালের আদালত অবমাননা আইন অনুযায়ী এই অবমাননা দেওয়ানি হতে পারে, আবার ফৌজদারিও হতে পারে। আদালতের কোনও নির্দেশ, রায়, ডিক্রি বা আদেশ ইচ্ছাকৃতভাবে অমান্য করলে সেটা দেওয়ানি অপরাধের মধ্যে পড়ে। আর যদি কোনও বলা কথা, লিখিত শব্দ, ইশারা বা ইঙ্গিত বা ক্রিয়াকলাপ আদালতের কুৎসা প্রচার এবং মর্যাদা হানি করে কিংবা বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন তাতে হস্তক্ষেপ করে, নিয়ন্ত্রণ বা বিকৃত করতে চায়, তাহলে সেটা ফৌজদারি অবমাননার পর্যায়ভুক্ত বলে গণ্যে হবে।
সাধারণত আদালত অবমাননার অপরাধে একটি ৬ মাসের কারাবাস কিংবা জরিমানা কিংবা একসঙ্গে উভয় শাস্তিই হতে পারে। আবার দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি যদি ক্ষমাপ্রার্থনা করেন এবং তাঁর বক্তব্য বিচারপতিদের সন্তুষ্ট করে, তাহলে তাঁর শাস্তি মকুবও হয়ে যেতে পারে।
এই আইনকে চ্যালেঞ্জ
গত ১ অগস্ট আইনের এই ধারাটিকেই চ্যালেঞ্জ জানান বিশিষ্ট সংবাদিক এন রাম, প্রাক্তন মন্ত্রী অরুণ শৌরি এবং অ্যাডভোকেট প্রশান্ত ভূষণ। তাঁরা বলেন, "সংশ্লিষ্ট আইনের এই ধারা ২(সি)(১) অস্পষ্ট, একতরফা এবং বাকস্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।
তাঁরা বলেন, আদালতের বিরুদ্ধে কুৎসাপ্রচারের ধারাটি ঔপনিবেশিক আমলের বিচারব্যবস্থার স্মৃতিবাহী এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক সাংবিধানিকতায় যার কোনও স্থান নেই।"
সপ্তাহ দুয়েক পরে অবশ্য এই চ্যালেঞ্জ জানানো পিটিশনটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, কারণ সুপ্রিম কোর্ট তার আবেদন নথিভুক্তকরণ দফতরের কাছে কৈফিয়ত চায় কেন, যে-বেঞ্চে এই অবমাননা সংক্রান্ত মামলা ইতিমধ্যেই রুজু হয়েছে, সেই অরুণ মিশ্রের বেঞ্চের পরিবর্তে অন্য বিচারপতির ঘরে আবেদনটি শুনানির জন্য অন্তর্ভুক্ত হল?
আদালত অবমাননা আইনের সমালোচনা
বিশেষজ্ঞদের মতে, অবমাননার দেওয়ানি অপরাধটি থাকা উচিত, কেননা না হলে আদালতের মর্যাদা ও কর্তৃত্বপরায়ণতা উবে যাবে। কিন্তু ফৌজদারি অবমাননার অপরাধটি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। দ্য হিন্দু পত্রিকায় এক নিবন্ধে প্রাক্তন হাইকোর্ট বিচারপতি এ পি শাহ লিখেছেন: 'ফৌজদারি অবমাননা অপরাধের পরিণাম একেবারে হাড়-হিম-করা।' উচ্চতর বিচারবিভাগে কর্মরত ১০ জন বিচারপতি সহ আরও ১৩৯ জন আইনজীবীর সঙ্গে যৌথভাবে অনুমোদিত এক বিবৃতিতে তিনি প্রশান্ত ভূষণকে সমর্থনও করেছেন।
যৌথ বিবৃতিতে জনসাধারণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনকারী সরকারের বাড়াবাড়ির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা ভুলে যাওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের কড়া সমালোচনাও করা হয়েছে।
অবমাননার দায়ে
প্রশান্ত ভূষণের মতো আদালত অবমাননার মামলা রুজু হয়েছিল বুকার পুরস্কার জয়ী প্রখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধেও । ২০০২ সালের ৬ মার্চ বিচারপতি জিবি পট্টনায়ক ও আর পি শেঠির বেঞ্চ অরুন্ধতীকে ফৌজদারি অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে তিহার জেলে এক দিনের হাজতবাসের শাস্তি দেয়। সেই সঙ্গে তাঁর ২০০০ টাকা জরিমানাও ধার্য হয়, যা তিনি না দিতে পারলে আরও ৩ মাস তাঁকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
অরুন্ধতী রায়কে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এর আগে ২০০১ সালে বিচারপতি পট্টনায়ক ও রুমা পালের বেঞ্চে অন্য একটি অবমাননার মামলায় দেওয়া রায়ের সমালোচনা করার অপরাধে।
২০১৫ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি এন সাইবাবার জামিনের আবেদন মুম্বই আদালত নাকচ করলে তার সমালোচনা করে অরুন্ধতী আরও একবার অবমাননার নোটিশ পেয়েছিলেন। হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চ মনে করেছিল, পুলিশ ও সরকারি প্রশাসনের বিরুদ্ধে অরুন্ধতীর মন্তব্য কুৎসামূলক। তবে এর দু'বছর পর ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টই অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে ওই মামলার শুনানিবন্ধ করে দেয়।
সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য তার নিজের লোককেও ছাড়েনি। ২০১৬ সালে কোচি ধর্ষণ মামলায় শীর্ষ আদালতের রায়ের সমালোচনা করার জন্য তারা প্রাক্তন বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজুকেও তলব করে। শুনানির সময় তাঁর সঙ্গে বিচারপতিদের তীব্র ও উত্তপ্ত বাদানুবাদ হয়, তারপর তাঁকে আদালতের বাইরে বের করে আনতে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিশও জারি করা হয়। তবে ২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর কাটজু নিঃশর্ত দুঃখপ্রকাশ করার পর এই অবমাননার মামলাটি নিয়ে আদালত আর এগোয়নি।
কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সি এস কারনানকে নিয়ে যে নাটকীয় ঘটনা ঘটে, সেটাও উল্লেখ্য। ২০১৭ সালের ৯ মে কারনানই হয়ে ওঠেন একমাত্র কর্মরত বিচারপতি, যাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা ওঠে। বিচারে তাঁর ৬ মাসের কারাদণ্ডও হয়।
কারনান উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ আনলে সুপ্রিম কোর্টের ৭ জন সবচেয়ে প্রবীণ বিচারপতির বেঞ্চ কারনানের বিচার করে। কারনানই আবার সুপ্রিম কোর্টের ৮ জন উচ্চপদস্থ বিচারপতির বিরুদ্ধে জাতপাতের বৈষম্য করার অভিযোগ এনে তাদের ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১ লক্ষ টাকা করে জরিমানার রায় দিয়েছিলেন। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরেই কারনান ফেরার হয়ে যান। এর মাসখানেক পরে এবং বিচারকের পদ থেকে অবসর গ্রহণের ৮ দিন পর পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে ২০১৭ সালের ২০ জুন।