জোন্সটাউন হত্যাকান্ডের পুরনো ছবিকে করোনাভাইরাসে মৃতদের শায়িত লাশ বলা হল
বুম যাচাই করে দেখেছে মূল ছবিটি ১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বর মাসে তোলা দক্ষিণ আমেরিকার জোন্সটাউন গণহত্যাকান্ডের লাশের ছবি।
কোভিড-১৯ শঙ্কার আবহে সত্তরের দশকে আমেরিকার কুখ্যাত জোন্সটাউন হত্যালীলার একটি ছবিকে নুতনভাবে বিভ্রান্তিকর দাবি সহ সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল করা হয়েছে। ফেসবুকে বলা হয়েছে 'ঘরে থাকো' নাহলে এরকম অবস্থা হতে পারে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে ভারত সহ সারা বিশ্বেই লকডাউন পালন করতে সামিল হয়েছে। তার তা মানতেই সবাইকে এখন ঘরের মধ্যে থাকতে বলা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের নভেম্বরে চিনের উহানের সুমাদ্রিক প্রাণীর বাজার থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ এর প্রকোপে ইতিমধ্যে মারা গেছেন ৯৫,০০০ এর বেশি মানুষ। এবং এপর্যন্ত বেঁচে ফিরেছেন ৩৫৫,৫১৪ জন।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সারি সারি মানুষের মৃতদেহ একটি জমিতে ছড়িয়ে আছে। মৃতদের মধ্যে শিশু ও নারী রয়েছে। ছবিতে জমির পাশে সম্ভবত চালের খুঁটি দেখা যাচ্ছে। ওই চালার ভেতরেও মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। ছবিটির উপরে বাংলাতে লেখা আছে, "ঘরে থাকো, না হয় মরো।"
বুম যাচাই করে দেখেছে ছবিটি ১৯৭৮ সালের, দক্ষিণ আমেরিকার গুয়ানা ও ভেনিজুয়েলার সিমান্ত প্রদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংগঠিত হওয়া একটি কুখ্যাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার। ওই ঘটনায় প্রায় ৯০০ মানুষের অপ্রাকৃতিকভাবে মৃত্যু হয়েছিল। এগুলি কোনও দেশেরই কোভিড-১৯ এর জেরে মারা যাওয়া লাশের ছবি নয়।
আরও পড়ুন: কন্টাজিয়ন সিনেমার দৃশ্যকে ইতালিতে করোনাভাইরাসে মৃতদের গণকবর বলা হল
ফেসবুক পোস্টে ছবিটি শেয়ার করে ক্যাপশন লেখা হয়েছে, "শুধু ছবিটা সেয়ার করলাম...বাকিটা বুঝে নাও।'' পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
ফেসবুকে একই ক্যাপশনে সহ ছবিটি ভাইরাল হয়েছে।
তথ্য যাচাই
বুম রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ভাইরাল হওয়া ছবিটির ব্যাপারে আসল ঘটনা জানতে পারে। দৃশ্যমান সারি সারি মৃতদেহের ছবিটি প্রায় পাঁচ দশক আগের।
দক্ষিণ আমেরিকার গুয়ানা ও ভেনিজুয়েলার সীমান্ত অঞ্চলের দুর্গম এক স্থানে ১৯৭৮ সালের ১৮ ই নভেম্বর ছবিতে বর্ণিত ঘটনাটি ঘটে। ছবিটি তুলেছিলেন পুলিৎজার পুরষ্কার প্রাপ্ত চিত্রসাংবাদিক ডেভিড হিউম ক্যানারলি। গেট্টি ইমেজের সংগ্রহে থাকা ছবিটি দেখা যাবে এখানে।
ছবিতে ক্যাপশনে লেখা হয়েছিল, ''জোন্সটাউন, গুয়ানা – নভেম্বর ১৮ : ১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বর, পিপলস টেম্পলের প্রাঙ্গন জুড়ে পরে আছে অনেকগুলো মৃতদেহ, প্রায় ৯০০ এর উপর মানুষ তাদের শিক্ষক জিম জোন্সের উন্মোচনায় সায়ানাইড মিশ্রিত পানীয় খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন; তারা আধুনিক ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গণআত্মহত্যার অংশ ছিলেন। (ছবি ডেভিড হিউম ক্যানারলি/গেট্টি ইমেজেস)।"
[ইংরেজিতে লেখা মূল ক্যাপশন: "JONESTOWN, GUYANA - NOVEMBER 18: (NO U.S. TABLOID SALES) Dead bodies lie around the compound of the People's Temple cult November 18, 1978 after the over 900 members of the cult, led by Reverend Jim Jones, died from drinking cyanide-laced Kool Aid; they were victims of the largest mass suicide in modern history. (Photo by David Hume Kennerly/Getty Images)]
বুম ডেভিড হিউম ক্যানারলির নিজস্ব ওয়েবসাইটেও ভাইরাল হওয়া ছবির মূল ঘটনা নিয়ে একটি ব্লগ খুঁজে পায়, যেখানে জোন্সটাউন ঘটনার বিবরণ এবং এই ছবির সম্পর্কে তিনি নিজে লিখেছেন। ব্লগটি পড়া যাবে এখানে।
আরও পড়ুন: কোভিড-১৯ এর মৃত্যুর জেরে ইতালিয়রা কী রাস্তায় তাদের টাকা ছুড়ে ফেলছে?
জোন্সটাউন গণহত্যাকাণ্ড
শেতাঙ্গ রেভারেন্ড জিম জোন্স চার্চের বিপ্রতীপে গিয়ে কৃষি ভিত্তিক 'পিপলস টেম্পল' নামে কাল্ট ধর্মের প্রবর্তন করেন দক্ষিণ আমেরিকার গুয়ানার জোন্সটাউন অঞ্চলে। 'পিপলস টেম্পল'-এর কর্মীদের বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে তার অনুগামীদের মধ্যে। ১৯৭৮-এর নভেম্বরে আমিরিকান সাংসদ লিও রিয়ান জোন্সটাউনের 'পিপলস টেম্পল' এলাকা পরিদর্শনে আসেন। অনেক অনুগামী যারা 'পিপলস টেম্পল' ছেড়ে আসতে চেয়েছিলেন তারা রিয়ানের পাঠানো গাড়িতে ফিরে আসতে থাকে। ফেরার পথে রিয়ান ও তার সঙ্গীরা রানওয়েতে টেম্পল অনুগামীদের হাতে আক্রান্ত হয়। গুলিতে মারা যায় রিয়ান সহ আরও তিনজন গণমাধ্যমকর্মী। আহত হয় ১১ জন।
এক রেডিও বার্তায় জোন্স টেম্পল সদস্যদের মেরে ফেলার নির্দেশ দেয়, 'গণ আত্মহত্যা'র ছক কষে। ফলের রসে মারণ ঘুমের ওষুধ ও সায়নাইড বিষ মিশিয়ে হত্যা করে। পাণীয় ও সিরিঞ্চির মাধ্যমে প্রথমে শিশুদের ও পরে বড়দের এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। জোন্সও নিজে গুলির আঘাতে মারা যায়। এই হত্যাযজ্ঞে মারা যায় প্রায় ৯০০ জন যার মধ্যে ৩০০ জনের বয়স ছিল ১৭ বছরেরও কম। বিস্তারিত পড়ুন ব্রিটানিকা ও দ্য গার্ডিয়ানে। এই ঘটনার আরও ছবি দেখতে পারেন এখানে।
আরও পড়ুন: না, এই ছবিগুলি ইতালিতে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়