মহারাষ্ট্র থেকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ব্যাপক শেয়ার হচ্ছে, যাতে দেখা যাচ্ছে, ধাতু-নির্মিত চামচ, মুদ্রা টিকা নেওয়া একটি লোকের গায়ে সেঁটে থাকছে এবং মহারাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সংবাদ-মাধ্যমও এই ছবি ভাইরাল করে দাবি করছে, কোভিড-১৯ টিকা নেওয়ার ফলে ব্যক্তিটির শরীরে যে চৌম্বক ক্ষেত্র (magnetic) তৈরি হয়েছে, তার ফলেই এমনটা ঘটছে।
ভিডিওটিতে অরবিন্দ সোনার নামে নাসিকের ৭১ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তিকে দেখানো হয়েছে, যাঁর পুত্র তাঁর শরীরে ধাতুর চামচ, প্লেট, মুদ্রা ইত্যাদি রাখলে সেগুলি গায়ে সেঁটে বসে যাচ্ছে। বিবিসি, নবভারত টাইমস, লাইভ হিন্দুস্তান, নিউজ-১৮-এর মতো সংবাদসংস্থা অরবিন্দ সোনারের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাঁকে চুম্বক মানুষ আখ্যা দিয়ে ভুয়ো দাবি জানাচ্ছে যে, কোভিড-১৯ টিকা নেওয়ার পরিণামেই তাঁর দেহে এই ব্যাপারটা ঘটছে।
অরবিন্দ সোনারের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা বলেন, তাঁরা কখনওই দাবি করেননি যে এই চৌম্বক আকর্ষণের সঙ্গে কোভিড-১৯ টিকার কোনও সম্পর্ক আছে। এটা পুরোপুরি সংবাদসংস্থার বানানো একটা গল্প। অরবিন্দর পুত্র জয়ন্ত আমাদের বলেন, একটি হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ড-এর ভিত্তিতে তিনি বাবা-মার শরীরে এই পরীক্ষাটি করে দেখেন, এর সঙ্গে টিকার কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকদের সঙ্গেও কথা বলেছি, যাঁরা টিকা নেওয়ার সঙ্গে এই বিষয়টির সংশ্রবের কথা উড়িয়ে দিয়েছেন।
বিবিসি হিন্দি প্রচারিত একটি ভিডিওতে সোনারকে বলতে শোনা যাচ্ছে, তিনি হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া একটি বার্তা অনুসরণ করছিলেন এবং জানতে চান কেন এই ধাতব জিনিসের গায়ে সেঁটে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটছে।
নবভারত টাইমস-এর গল্পে সোনার নাকি কোভিড টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেবার পর থেকেই ব্যাপারটা ঘটতে থাকে বলে দাবি করেছেন এবং চিকিৎকরাও নাকি এর কারণ নিয়ে গবেষণা করছেন।
ফেসবুকেও সোনারের এই দাবিটি ভাইরাল করা হয়েছে, যেখানে দেখানো হচ্ছে তাঁর শরীরে সেঁটে থাকা ধাতুর চামচ ও মুদ্রার ছবি।
সোশাল মিডিয়া এমন পোস্টে ভরে গেছে, যেখানে টিকা-নেওয়া লোকেরা নিজেদের গায়ে ধাতুর জিনিস রেখে দেখছে সেগুলো সেঁটে থাকে কিনা।
আরও পড়ুন: ভুয়ো দাবি: পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাজ পড়ে মৃতদের কোনও অর্থ সাহায্য করেনি
তথ্য যাচাই
বুম অরবিন্দ সোনারের পরিবারের লোকেদের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁরা বলছেন ধাতুর জিনিসপত্র গায়ে সেঁটে যাওয়ার পিছনে কোভিড টিকার ভূমিকা বিষয়ে কোনও দাবি তাঁরা করেননি, ভিডিওটি বানানোর সময় কেবল কেন এমন হচ্ছে, তা জানার কৌতূহল থেকেছে। অরবিন্দর পুত্র জয়ন্ত সোনার বললেন, টিকা নিয়ে মানুষের মনে দ্বিধা তৈরি করার কোনও উদ্দেশ্য তাঁদের ছিল না, তাঁরা শুধু একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা অনুসারে একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে দেখছিলেন।
"আমার বাবার দেহে ধাতুনির্মিত জিনিস আটকে যাওয়ার জন্য কোভিডের টিকা দায়ী, এ ধরনের কোনও কথা আমরা বলিনি। উনি টিকা নেবার আগে আমরা কখনও এমন পরীক্ষা করেও দেখিনি। আমি শুধু সোশাল মিডিয়ায় একটা বার্তা দেখেছিলাম যে, কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর নাকি দেহে এ ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে যা ধাতুর জিনিসপত্রকে আকর্ষণ করছে। তাই বাবা আর মাকে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে বলেছিলাম।" বললেন জয়ন্ত। তাঁর আরও বক্তব্য—তাঁর বাবার শরীরে চামচ বা মুদ্রা আটকে গেলেও মায়ের বেলা সে রকম কিছু হয়নি। তাই তিনি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে চাইছিলেন।
"আমরা এটা বুঝেছিলাম যে টিকার সঙ্গে এই চৌম্বক আকর্ষণের কোনও যোগ নেই, কেননা তাহলে মায়ের দেহেও একই ভাবে চামচ-মুদ্রা সেঁটে থাকত। আসলে ব্যাপারটা ঠিক কী ঘটছে এবং কেন, আমরা সেটা বুঝতে চাইছিলাম। আমার বাবার ডায়াবেটিস আছে, স্বভাবতই আমি বিচলিত হয়ে এটা নিয়ে কথাবার্তা বলছিলাম। মিডিয়া কোনও ভাবে সেটা শুনে নিজের মতো করে গল্প বানিয়ে নিয়েছে।"
নাসিক মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের মেডিক্যাল অফিসার বাপুসাহেব নগরগজে বুম-কে জানালেন, "৪ লক্ষেরও বেশি লোককে এখানে কোভিশিল্ড টিকা দেওয়া হয়েছে, টিকা নেবার পরে একজনও এ ধরনের কোনও চৌম্বক আকর্ষণের লক্ষণ দেখাননি।"
"বিষয়টা খতিয়ে দেখতে কর্পোরেশন সোনারদের বাড়িতে একটি তদন্ত দলও পাঠিয়েছে। অনুসন্ধানের ফল রাতারাতি মিলবে, এমন নয় l তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত যে, টিকার সঙ্গে এই চৌম্বক ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই," জানালেন ডঃ নগরগজে।
ভুল তথ্য নস্যাৎ করতে চাইছি: সোনার
জয়ন্ত সোনার বুমকে জানালেন, যখনই তিনি দেখলেন তাঁর বাবার শরীরের এই চৌম্বক-ধর্মকে কোভিড টিকার পরিণাম হিসাবে দেখানোর চেষ্টা চলছে, তখনই তিনি নরেন্দ্র দাভোলকর প্রতিষ্ঠিত অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করেন যাতে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি ও গুজব ছড়ানো বন্ধ করা যায়।
সমিতির সদস্য প্রশান্ত পোদ্দার-এর সঙ্গেও বুম যোগাযোগ করে, যিনি সোনারদের বাড়ি গিয়েছিলেন বিষয়টি খতিয়ে দেখতে। তিনি বলেন: "কোভিশিল্ডের টিকা যেখানে দেওয়া হয়, সেই হাত থেকে রক্তের শিরা মারফত গোটা দেহেই তা ছড়িয়ে পড়ে । তাই যদি এই টিকার ওষুধে কোনও চৌম্বক-ধর্ম সৃষ্টির ক্ষমতা থাকে, তাহলে সারা শরীরেই তা সঞ্চারিত হবে । সে ক্ষেত্রে গোটা দেহটাই চুম্বকে রূপান্তরিত হবে। আমরা দেখতে গিয়েছিলাম কোনও আঠা জাতীয় কিছু দেহে লাগানো ছিল কিনা।"
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে এটা ভুল বা অসত্য বলেই মনে হয়। কোভিশিল্ডের কারণে কারও দেহে চৌম্বক-ধর্ম দেখা দেবে না। তবে বিজ্ঞানে কোনও একটি ঘটনা দিয়ে কিছু প্রমাণ হয় না, আরও অনেক অনুসন্ধান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। এটাও ঠিক যে চুম্বক কিন্তু সর্বদা কোনও স্টেনলেস স্টিলকে আকর্ষণ করে না।
সংস্থার তরফে আমাদের কিছু ছবিও দেওয়া হয়, যাতে টিকা দেওয়া হয়নি এমন অনেকের দেহেই কীভাবে স্টেনলেস স্টিলের বাসনপত্র আটকে রয়েছে, তা দেখানো হয়েছে। কুসংস্কার এবং ভুয়ো তথ্যের মোকাবিলা করার জন্য এই সব ছবি ওঁরা ব্যবহার করেন।
বিভিন্ন বস্তু দেহে আটকে যায় কেন?
বুম বিজ্ঞানী শংকরন কৃষ্ণস্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তিনি বায়োইনফর্মেটিক্স-এর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং ইন্ডিয়ান সায়েন্টিস্ট রেসপন্স টু কোভিড-১৯-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এই রহস্য উন্মোচনে আমরা তাঁর অভিমত জানতে চাই।
তিনি বলেন, "ব্যাপারটার সঙ্গে টিকার কোনও সম্পর্ক নেই। ছোটবেলায় আমরা অনেকেই নিজেদের কপালে মুদ্রা সাঁটিয়ে রাখতাম। সেগুলো সেঁটে থাকত তাদের প্রশস্ত তল এবং আমাদের ত্বকের আঠালো ঘামের কারণে। ত্বক যদি তৈলাক্ত হয়, তাহলে অপেক্ষাকৃত ভারী কোনও জিনিসও ওভাবে সাঁটিয়ে রাখা যায়। কিন্তু তার জন্য মানুষের শরীর কোনও চৌম্বক-ধর্ম অর্জন করে ফেলে না।"
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদি সমিতির তরফ থেকেও বিষয়টির হাতে কলমে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
২০১১ সালে বেশ কয়েকটি সংবাদ-প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় সার্বিয়ার একটি ৭ বছরের বালকের চৌম্বক-ধর্ম নিয়ে। স্কেপটিকাল এনকোয়ারার পত্রিকার ম্যানেজিং এডিটর বেঞ্জামিন রাডফোর্ড সে সময় বলেছিলেন, "ছেলেটি নাকি কাচকেও (যার চৌম্বক আকর্ষণ নেই) আকর্ষণ করতে পারে। এই লোকগুলির চৌম্বক আকর্ষণ ক্ষমতা নেই, শুধু যে সব বস্তুর তল মসৃণ, সেগুলো ত্বকের সঙ্গে সেঁটে থাকতে পারে। প্রায়শই দেখা যায়, এই সব লোকের ত্বক খুব মসৃণ হয় এবং বুকে লোম-টোমও থাকে না।"
আরও পড়ুন: না, ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরকে রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত করেনি তৃণমূল