চলচ্চিত্র নির্মাতা বিবেকরঞ্জন অগ্নিহোত্রীর (Vivek Agnihotri) ভুয়ো দাবি, আমেরিকার রোড আইল্যান্ড রাজ্য তাঁর তৈরি চলচ্চিত্র 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস'-এ (The Kashmir Files) কাশ্মীরে গণহত্যার তথ্য একটি শংসাপত্র মারফত স্বীকার করে নিয়েছে।
বুম দেখলো, অগ্নিহোত্রীর এই দাবিটি বিভ্রান্তিকর এবং ভুয়ো। কেননা শংসাপত্রে কেবল ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর রোড আইল্যান্ড কলেজে চলচ্চিত্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তি পাওয়ার কথা বলা হয়েছিল, কোথাওই রোড আইল্যান্ড রাজ্য কিংবা তার গণপ্রতিনিধিসভার দ্বারা কাশ্মীরে গণহত্যার স্বীকৃতির উল্লেখ ছিল না।
অগ্নিহোত্রী ২০২২ সালের ১৪ মার্চ সিনেমাটির মুক্তি সংক্রান্ত শংসাপত্রটির একটি ছবি টুইট করেন, যেটি ৯ ডিসেম্বর, ২০২১-এ রোড আইল্যান্ড কলেজ থেকে পাওয়া গিয়েছিল এবং তাতে কোথাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ড প্রদেশ কিংবা তার নির্বাচিত প্রতিনিধিসভার স্বীকৃতির তথ্য নেই।
অথচ অগ্নিহোত্রী দাবি করেন, খুব ছোট একটি ফিল্মের কারণে উদারনৈতিক মার্কিন প্রদেশ রোড আইল্যান্ড কাশ্মীরে গণহত্যার ঘটনা স্বীকার করে নেয়।
টুইটে তিনি লেখেন, ''দয়া করে এই শংসাপত্রটি পড়ুন এবং নিজেরাই স্থির করুন, গণহত্যার জন্য দায়ী কে এবং কারই বা শাস্তি পাওয়া উচিতl এটাই নয়া ভারতবর্ষ!''
সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' সিনেমাটি কাশ্মীর উপত্যকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসের মধ্যে কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের দুর্দশা নিয়ে তৈরি একটি চলচ্চিত্রl বিজেপির নেতারা এবং হিন্দু দক্ষিণপন্থীরা এই চলচ্চিত্রটিকে ব্যাপকভাবে সমর্থ করেছেন এবং বিজেপি-শাসিত কয়েকটি রাজ্য চলচ্চিত্রটিকে 'প্রমোদকর-মুক্ত' বলেও ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত ছবিটি নিয়ে কথা বলেছেন।
সিনেমাটির আনুষ্ঠানিক মুক্তির আগে বেশ কয়েকবার নানা জনকে সেটি দেখানো হয়েছে এবং তার সরব ও উচ্চকিত প্রতিক্রিয়া সোশাল মিডিয়াতে মুখরিত হয়েছে। তবে পাশাপাশি এই ছবিতে ভুল তথ্যের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমাবেশের বিষয়টিও অনালোচিত থাকেনিl সিনেমাটি দেখার সময় লালকৃষ্ণ আডবাণী এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ কেঁদে ফেলেছেন, এই মর্মে পুরানো ভিডিও সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, বুম যেগুলিকে 'ভুয়ো' বলে চিহ্নিত করে পর্দাফাঁস করেছেল।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ২০১৪ বিবৃতি ছড়াল 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস্' নিয়ে মন্তব্য বলে
তথ্য যাচাই
শংসাপত্রটি একটু নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করলেই বোঝা যায়, এটিতে কেবল চলচ্চিত্রটির প্রাথমিক মুক্তির (প্রিমিয়ার) উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে দাবি করা গণহত্যার তথ্যের কোনও সরকারি স্বীকৃতি নেই, যেমনটা নাকি পরিচালক বা চিত্রনির্মাতা দাবি করেছেন।
অগ্নিহোত্রীর টুইটের দাবিকে প্রথম 'ভুয়ো' বলে শনাক্ত করেন কাশ্মীরের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিক (অধুনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত) রাকিব হামিদ নায়েক।
রাকিব একটি টুইটে জানান, তিনি রোড আইল্যান্ডের প্রতিনিধিসভার সদস্য ব্রায়ান কেনেডির সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বললে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, এই শংসাপত্রটি কেবল রোড আইল্যান্ড কলেজে চলচ্চিত্রটি দেখানোর তথ্য তুলে ধরেছে এবং কখনওই উপত্যকায় হিন্দুদের গণহত্যার তথ্যে স্বীকৃতি দেয়নি।
রাকিব আরও একটি টুইট করেছেন যে, ওই প্রতিনিধিসভার স্পিকার কে জোসেফ শেকার্চি তাঁকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন যে, প্রতিনিধিসভার সদস্যরা এই শংসাপত্রের ব্যাপারে সম্যক অবগতও নন।
"স্পিকার শেকার্চি এই শংসাপত্র বিষয়ে কিছু জানেন নাl এটা এমনকী প্রতিনিধিসভার সরকারি অবস্থানও নয়l সভাসদদের অনুরোধ করা সব ধরনের শংসাপত্রেই স্পিকার ও অন্য দুই নেতার নাম আগে থেকেই ছাপা থাকে" বলে রাকিবকে জানালেন সভার এক কর্মী।
বুম রাকিব হামিদ নায়েকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদের ব্রায়ান কেনেডির সঙ্গে তাঁর ই-মেল বার্তা শেয়ার করেন। আমরা সেই ই-মেল বার্তা যাচাই করে দেখেছি যে, শংসাপত্রটি আদৌ রোড আইল্যান্ড প্রদেশের প্রতিনিধিসভার স্বীকৃতি নয়।
ব্রায়ান কেনেডি বলেন—"২০২১ সালের ডিসেম্বরে ইস্ট গ্রিনউইচ-এর একজন ভারতীয়-আমেরিকান বিবেকরঞ্জন অগ্নিহোত্রীর তৈরি 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' ছবিটির জন্য একটি শংসাপত্র চান, যেটি ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ রোড আইল্যান্ড কলেজে প্রদর্শিত হবে। সেই শংসাপত্রে কেবলমাত্র ছবিটির প্রদর্শনীর কথা থাকবেl আমি নিজে ওই পরিচালককে দেখিনি, এমনকী তাঁর তৈরি ছবিটাও দেখিনি, যদিও আমাকে ছবির কিছু-কিছু খণ্ডদৃশ্য দেখানো হয়েছিল। আমার মনে হয়, রোড আইল্যান্ড কলেজের ওই প্রদর্শনীতে আড়াইশো জনের মতো দর্শক ছিলেন এবং ছবিটি তাদের ওপর বেশ প্রভাবও ফেলেছিল।"
কেনেডি লেখেন—"এ ধরনের শংসাপত্র আমরা কোনও ব্যক্তির বিশেষ কোনও অর্জনের জন্য দিয়ে থাকি। কোনও বয়-স্কাউট যদি ঈগল-স্কাউটের পদ পায়, তাকে দিয়ে থাকিl ছাত্রদের কোনও বিশেষ কৃতিত্ব বা খেলাধূলায় দক্ষতার জন্যও দিয়ে থাকিl এমনকী যারা অবসর নেয় কিংবা বিশেষ কোনও জন্মদিন উদযাপন করে, তাদেরকেও দিই। শংসাপত্র হল নিছক একটি স্বীকৃতি, এটা প্রতিনিধিসভার তরফ থেকে কাউকে কিংবা কোনও কিছুকে অনুমোদন করা নয়l এ ক্ষেত্রেও চিত্র-পরিচালককে তাঁর ছবির প্রদর্শনীর স্রেফ স্বীকৃতি হিসাবে এটা ইস্যু করা হয়েছিল, তার বেশি কিছু নয়, প্রাদেশিক প্রতিনিধিসভার অনুমোদন তো নয়ই।"
আবেদনকারী সিনেমার বর্ননা পাঠান
ব্রায়ান প্যাট্রিক কেনেডিকে বুম জানতে চেয়েছিল, শংসাপত্রের জন্য চলচ্চিত্রটির বিবরণটি কে তৈরি করেছিল? কেননা শংসাপত্রে লেখা হয়েছে—"কাশ্মীর ফাইলস ১৯৯০ সাল থেকে ঘটা সেই সব সন্ত্রাসবাদী ও উগ্রপন্থী আক্রমণের স্মৃতিমূলক আখ্যান, যার মাধ্যমে ইসলামি দুষ্কৃতীরা ৫ লক্ষ হিন্দুকে উপত্যকা থেকে তাড়িয়ে শরণার্থীর জীবনে ঠেলে দিয়েছিল..."
ব্রায়ান কেনেডি জানান— "যে-ভারতীয়-মার্কিন ব্যক্তি চলচ্চিত্রটির শংসাপত্রের জন্য আবেদন করেছিল, সে-ই এই বিবরণীটিরও রচয়িতা। রোড আইল্যান্ডে বসবাসকারী ওই ভারতীয়-আমেরিকানই গণমাধ্যমে বিষয়টি জানায় এবং আমার সঙ্গেও যোগাযোগ করে।"
এ ছাড়াও বুম ই-মেল মারফত প্রতিনিধি ব্লেক ফিলিপ্পি (সংখ্যালঘুদের নেতা), প্রতিনিধি ক্রিস্টোফার ব্লেজেউস্কি (সংখ্যাগুরুদের নেতা) এবং প্রতিনিধিসভার স্পিকার কে জোসেফ শেকার্চি-র সঙ্গেও এই বিষয়ে যোগাযোগ করেছে, শংসাপত্রে যাঁদের স্বাক্ষর রয়েছে। ওঁদের প্রতিক্রিয়া জানা গেলে সেই অনুযায়ী এই প্রতিবেদন হালনাগাদ করা হবে।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে ঘন্টা? ভাইরাল ছবিটি সম্পাদিত