শুক্রবার তাঁর ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন যে, তিনি যখন ২২ বছরের এক তরুণ, তখন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে আয়োজিত এক জনসভায় অংশ নেন এবং তার জন্য জেলেও যান। ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে তাঁর এই উক্তি এক রাজনৈতিক কোন্দলের সূত্রপাত ঘটায়। বিরোধী শিবিরের বেশ কিছু সদস্য মোদীর দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আর ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসে।
দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে মোদী দু'দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরে যান। সেখানে তিনি বলেন, "আমার জীবনের প্রথম আন্দোলনটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। সেই সময় আমার বয়স ২০-২২ ছিল। আমি ও আমার সহকর্মীরা বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য সত্যাগ্রহ করি। আর তার জন্য কারাবাসও করতে হয়..."
তাঁর ওই উক্তির পর. কংগ্রেস নেতা শশী থারুর তাঁর ওই দাবির সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন এবং 'ভুয়ো খবর' বলে অভিহিত করেন।
থারুর তাঁর টুইটে বলেন, "আন্তর্জাতিক শিক্ষা: আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় 'ভুয়ো খবর'-এর নমুনা দেখালেন বাংলাদেশকে। হাস্যাস্পদ ব্যাপার হল, সবাই জানে কে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছিল।"
থারুর অবশ্য পরে আবার টুইট করে নিজের ভুল শুধরে নিয়ে বলেন যে, না, মোদী ইন্দিরা গাঁধীর অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। তার ওই ভুলের জন্য উনি দুঃখ প্রকাশ করেন।
থারুরের টুইটের প্রতিক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন বিজেপি সদস্য পাল্টা টুইট করেন। তাতে তাঁরা ২০১৫ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ীকে দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের সম্মানপত্রের উল্লেখ করেন। তাছাড়া তাঁরা প্রধানমন্ত্রী মোদীর লেখা একটি বইয়ের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যেখানে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে এক আন্দোলনে অংশ নেওয়া ও তিহার জেলে আটক হওয়ার কথা লেখেন।
বাংলাদেশের সমর্থনে কি জনসঙ্ঘ সত্যাগ্রহ করেছিল?
আমরা বাজপায়ীকে দেওয়া সম্মান পত্রটির সন্ধান করি। দেখা যায়, ২০১৫-র জুনে, বাংলাদেশ বাজপায়ীকে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ 'মুক্তি যুদ্ধ সম্মাননা' প্রদান করে। সেই সময় বাজপেয়ী অসুস্থ ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে মোদী উপস্থিত থেকে তাঁর হয়ে ওই সম্মানপত্র গ্রহণ করেন।
ওই সম্মানপত্রে বাজপেয়ীকে একজন অত্যন্ত সম্মানীয় রাজনৈতিক নেতা বলে বর্ণনা করা হয় ও ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের প্রতি তাঁর সক্রিয় সমর্থনের কথা স্বীকার করা হয়। তাতে আরও বলা হয় যে, জনসঙ্ঘ (ভারতীয় জনতা দলের আগের সংস্করণ) অগাস্ট ১-১১ একটি সত্যাগ্রহের আয়োজন করে। সেটি ১২ অগস্ট, ১৯৭১-এ ভারতের সংসদের সামনে সমর্থকদের একটি সভা করার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়।
সম্মানপত্রে বলা হয়, "বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থনের কাজটি ত্বরান্বিত করার দাবিতে ১-১১ অগাস্ট জনসঙ্ঘ একটি গণসত্যাগ্রহ সংঘটিত করে। এবং ১২ অগাস্ট, ১৯৭১-এ তাঁদের স্বেচ্ছাসেবীরা ভারতের সংসদের সামনে একটি বিরাট জনসভা করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে, বাংলাদেশের ও তার সংগ্রামী মানুষের স্বার্থে শ্রী বাজপেয়ী সব সময় দৃঢ় অবস্থান নেন..."
আরও পড়ুন: ২০১১'র গুজরাতে মোদীকে শুভেচ্ছা জানানের ছবি জুড়ল বাংলাদেশ সফরের সঙ্গে
আমরা দেখি, ভারতের বিদেশ মন্ত্রক ওই সম্মানপত্রটি তাঁদের ওয়েবসাইটে পোস্ট করেছেন।
আমরা ১৯৭১-এর সংবাদ প্রতিবেদনগুলিরও খোঁজ করি। দেখা যায়, জনসঙ্ঘের সত্যাগ্রহ সম্পর্কে অনেকগুলি কাগজে রিপোর্ট বেরিয়ে ছিল সেই সময়। 'ইকনমিক টাইমস'-এ প্রকাশিত একটি ছবিতে, অগাস্ট ১৯৭১-এ বাজপায়ীকে একটি জনসভায় ভাষণ দিতে দেখা যায়। সেই সভায় ভারত সরকার দ্বারা বাংলাদেশকে সত্ত্বর স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলেন বাজপেয়ী। সেই সময় বাজপেয়ী জনসঙ্ঘের সভাপতি ও একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। ছবিটি 'টাইমস অফ ইন্ডিয়া'র সংগ্রহশালায় রয়েছে।
পড়তে ক্লিক করুন এখানে।
এমনকি ২ ও ১২ অগাস্ট ১৯৭১-এ, সংবাদ সরবরাহকারী সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এর তোলা ওই সত্যাগ্রহের ভিডিও আমরা দেখতে পাই।
তাছাড়া, 'টাইমস অফ ইন্ডিয়া', নিজেদের আর্কাইভ থেকে নিয়ে, তাদেরই ১২ অগাস্ট, ১৯৭১ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আবার প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, 'রেকগনাইজ বাংলাদেশ সত্যাগ্রহ'-এর (বাংলাদেশ সত্যাগ্রহের স্বীকৃতি) শেষ দিনে ১০,০০০ জনসঙ্ঘ সমর্থক দিল্লিতে গ্রেফতার হন।
প্রকাশিত রিপোর্ট আর ছবির তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, জনসঙ্ঘের দ্বারা বাংলাদেশে স্বীকৃতির দাবিতে সংঘটিত জনসভায় হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী আর সমর্থক অংশ নেন। তবে নরেন্দ্র মোদী সেই সভায় ছিলেন কিনা তা যাচাই করে দেখা বুমের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলনে যোগদানের কথা মোদী আগেও বলেছেন
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কথা প্রধানমন্ত্রী মোদী এই প্রথম বললেন, তা নয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, বাজপেয়ীকে দেওয়া সম্মানপত্র আনতে মোদী যখন ২০১৫ তে বাংলাদেশ যান, তখনও তিনি বাংলাদেশের পক্ষে জনসঙ্ঘের জনসভার কথা বলেছিলেন। এবং তিনি এও বলেছিলেন যে, তাঁর নিজের শহরের বাইরে সেই প্রথম তিনি কোনও প্রতিবাদী জমায়েতে সামিল হন। সেই অনুষ্ঠানে মোদী বলেন যে, তিনি রাজনীতি করতে আসেন একটু দেরিতে। অল্পবয়েসে তিনি নানা ধরনের ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
উনি আরও বলেন যে, ১৯৭১-এ বাজপেয়ীর ডাকে বহু তরুণ কর্মী বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে সংঘটিত সত্যাগ্রহে যোগ দিতে দিল্লিতে আসেন। ১৬ মিনিট সময় চিহ্নের মাথায় মোদীকে বলতে শোনা যায়, "জীবনে সেই প্রথম আমি আমার গ্রাম ছেড়ে, বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায়ের উদ্দেশ্যে জনসঙ্ঘের দ্বারা আয়োজিত সত্যাগ্রহে যোগ দিতে দিল্লি আসি। একজন সত্যাগ্রহী হওয়ার সুযোগ পাই। সেটাই ছিল আমার রাজনৈতিক কাজে প্রথম অংশগ্রহণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সামনে ভাষণ দেওয়ার সময়, মোদী ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন।
২০১৫ তে ইকনমিক টাইমস-এ প্রকাশিত নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখাও আমাদের নজরে আসে। তাতে উনি লেখেন যে, জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনে মোদীর অংশগ্রহণই ছিল রাজনীতিতে তাঁর প্রথম পদক্ষেপ। মুখোপাধ্যায় মোদীর জীবনীকার। তিনি লিখেছেন, "জরুরি অবস্থা বিরোধী সংগ্রামে অংশ নেওয়া ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।" তাছাড়া মোদী যে কিছুদিন তিহার জেলে কাটিয়ে ছিলেন, তারও উল্লেখ করেন শ্রী মুখোপাধ্যায়। "প্রাপ্তবয়সে মোদীর প্রথম রাজনৈতিক কার্যকলাপ ছিল বাজপায়ীর নেতৃত্বে দিল্লিতে আয়োজিত জনসঙ্ঘের সত্যাগ্রহে যোগ দেওয়া ও যুদ্ধে যাওয়ার জন্য নাম লেখানো। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানানোর ক্ষেত্রে সরকারের নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায়, অল্প কিছু দিনের জন্য মোদীকে তিহার জেলে আটকে রাখা হয়," লিখেছেন নীলাঞ্জন।
বুম লেখকের সঙ্গে কথা বলে। উনি জানান যে, ইকনমিক টাইমস-এ তাঁর লেখায় ও তাঁর বইতে যে তথ্য আছে, সেগুলি মোদী নিজেই তাঁকে দেন। "ওই উদ্ধৃতিগুলি তাঁরই আর উনি 'অন-রেকর্ড' সে সব কথা আমায় বলেন," জানান শ্রী মুখোপাধ্যায়।
বাংলাদেশ সত্যাগ্রহে অংশ নিয়ে গ্রেফতার হওয়া সম্পর্কে মোদী কি কিছু লিখেছেন?
বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতা ও কিছু সাংবাদিক একটি বইয়ের ব্লার্ব বা সংক্ষিপ্ত বিবরণী টুইট করেন। বইটির নাম 'সংঘর্ষ মা গুজরাত (সংগ্রামের সময় গুজরাত) মোদী বইটি লেখেন ১৯৭৮-এ। টুইটটিতে বইটির মলাটের পেছনের দিকের ছবি ছিল। তাতে ওই ব্লার্বে বইটির বিষয়বস্তুর একটা সারাংশ দেওয়া হয়। যেমন, বইটিতে মোদীর ছোটবেলা, শিক্ষা, জনসঙ্ঘে তাঁর ভূমিকা ও পার্টির কার্যকলাপ সম্পর্কে লেখা হয়েছে বলে জানানো হয়।
ওই সারাংশের শেষের আগের অনুচ্ছেদের শেষ লাইনে বলা হয়, "আগাউ বাংলাদেশ সত্যাগ্রহ সময় তিহাড জেল যাই অভেলা চে"। বাংলায় তার মানে দাঁড়ায়, "এর আগে তিনি বাংলাদেশ সত্যাগ্রহের সময় তিহার জেলে যান"।
'সংগ্রামের সময় গুজরাত' বইটি সার্চ করে বুম। সেটির একটি পিডিএফ সংস্করণ পাওয়া যায় নরেন্দ্র মোদীর ওয়েবসাইটে। ওই সংস্করণটি হল বইটির তৃতীয় মুদ্রণ, যেটি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই বইয়ের পেছনের মলাট ও সারাংশ, শেয়ার করা মলাট ও সারাংশ থেকে আলাদা।
আমরা এই সংস্করণটি পড়ে দেখি। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের কোনও উল্লেখ ছিল না। বইটিতে ১৯৭৫-৭৭ সময়কালে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে জনসঙ্ঘের কর্মসূচীগুলিই আলোচিত হয়।
আমরা সাংবাদিক দীপল ত্রিবেদীর সঙ্গে কথা বলি। ওই বইটি সম্পর্কে তাঁর একটি লেখা 'আমদাবাদ মিরর'-এ প্রকাশিত হয়। ত্রিবেদী বুমকে বলেন, ওই বইটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সংঘটিত আন্দোলনে মোদীর যোগদান বা সে দেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে কোনও উল্লেখ নেই।
তবে এটা স্পষ্ট নয় যে, বইটির আগের সংস্করণে তার কোনও উল্লেখ ছিল কিনা।
অতিরিক্ত রিপোর্টিং চার্মি ত্রিবেদিয়া।
আরও পড়ুন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী গোপনে নন্দীগ্রামের দরগায় গিয়েছিলেন? না ঠিক নয়