এক দল লোকের মারের চোটে থেঁতো হয়ে যাওয়া এক মহিলার মুখের ছবি সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে। ছবিটি শেয়ার করা পোস্টগুলির দাবি— এটি আফগানিস্তানের বিমানবাহিনীতে নিযুক্ত দ্বিতীয় মহিলা পাইলট (Woman Pilot) ক্যাপ্টেন সফিয়া ফিরোজির (Safia Ferozi) ছবি, যাঁকে নাকি প্রকাশ্যে পাথর মেরে (Lapidation) হত্যা করছে তালিবান (Taliban)।
বুম দেখে এই দাবিটি ভুয়ো এবং ছবিটি ২০১৫ সালের একটি গণপ্রহারে হত্যার ছবি, যাতে কাবুলের রাস্তায় ইসলামি বিদ্যাচর্চার ২৭ বছর বয়স্কা ছাত্রী ফরখুন্দা মালিকজাদাকে কোরান পোড়ানোর দায়ে হত্যা করা হয়েছিল। তা ছাড়া, আমরা সফিয়া ফিরোজি বা তাঁর সম্পর্কে কোনও সাম্প্রতিক সংবাদ-প্রতিবেদনও দেখতে পাইনি।
আমরা ফিরোজির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি এবং তাঁর প্রতিক্রিয়া পেলেই এই প্রতিবেদনটিকে সেই অনুযায়ী হালনাগাদ করা হবে।
কুড়ি বছরের যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলির সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে তালিবান বাহিনী দ্রুত ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার প্রেক্ষাপটেই এই ছবিটি ভাইরাল করা হয়েছে। এটি তালিবান সম্পর্কে রকমারি ভুয়ো খবর ও ভিডিওর মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন।
ভুয়ো পোস্ট
ইউজিন সঙ্গীত সাগর বুধবার সন্ধ্যায় এই ভুয়ো পোস্টটি টুইটারে দিয়ে ক্যাপশন দিয়েছেন, "আজ সকালে আফগানিস্তানের ৪ জন মহিলা পাইলটের অন্যতম সফিয়া ফিরোজিকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়েছে।"
টুইটটির আর্কাইভ করা আছে এখানে। (সতর্কতা: ছবিটি অস্বস্তিকর)
'সফিয়া ফিরোজি' শব্দদুটি বসিয়ে খোঁজ করে আমরা ফেসবুকে সঙ্গীত সাগরের করা টুইটের অনেকগুলি স্ক্রিনশট পোস্ট হতে দেখেছি, যার প্রতিটিতেই ইংরেজি, হিন্দি বা তেলুগু ভাষায় নিজস্ব ক্যাপশন দেওয়া রয়েছে এবং ছবির মহিলাকে ফিরোজি বলে ভুয়ো দাবিও করা হয়েছে।
টুইটারেও একই ভুয়ো দাবি সহ পোস্ট ভাইরাল হয়েছে।
আমরা XYZ নামে একটি অজানা ওয়েবসাইটেও একটি প্রতিবেদন দেখেছি, যাতে ফিরোজিকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার বিস্তারিত রিপোর্ট দিতে সঙ্গীত সাগরের টুইটটি ব্যবহার করা হয়েছে।
তা ছাড়া, আমরা লক্ষ্য করেছি, ফিরোজিকে হত্যা করার এই সবকটি বিবরণই ভারতীয়দের পোস্টে তুলে ধরা হয়েছে, কোনও আফগানকে এই বিবরণ দিতে দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন: দিল্লি স্টেশনের ভবিষ্যৎ কল্পিত রূপরেখা ছড়াল অযোধ্যা স্টেশন বলে
তথ্য যাচাই
বুম এই ছবিটি রিভার্স সার্চ করে দেখে, 'ফরখুন্দাকে পিটিয়ে হত্যা' নামে প্রচুর পোস্ট পেশ হয়েছে। আরও অনুসন্ধান চালিয়ে আমরা দেখি, এটি ফরখুন্দা মালিকজাদাকে হত্যা করার বিষয়ে লেখা, যাকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে কোরান পোড়ানোর সন্দেহে এক ক্রুদ্ধ জনতা পাথর ছুঁড়ে হত্যা করেছিল।
মালিকজাদার অপরাধ, তিনি এক মোল্লার সঙ্গে তর্ক করেছিলেন ধর্মস্থান থেকে মহিলাদের জড়িবুটি বিক্রি করায় আপত্তি জানিয়ে। তর্কাতর্কির মধ্যেই ওই মোল্লা মালিকজাদার নামে কোরান পোড়ানোর অভিযোগ তোলে আর আশপাশের লোকেরা সেটা শুনে তাঁকে আক্রমণ করে। পুলিশ পরে দেখেছে যে ওই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল এবং সেই মিথ্যাচার ও খুনের দায়ে ১১ জন পুলিশ অফিসার সহ ৪৯ জনকে গ্রেফতারও করা হয়।
ঘটনাটির সংবাদ-প্রতিবেদন খোঁজ করতে গিয়ে আমরা নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে গণপ্রহারের একটি ভিডিও রিপোর্ট পাই। (সতর্কতা: দৃশ্যটি অস্বস্তিকর)
ভিডিওটির একেবারে শেষে আমরা একটি ফ্রেম দেখতে পাই, যেটি ভাইরাল হওয়া ফোটোর সঙ্গে হুবহু এক।
এতে আরও প্রমাণিত হয় যে, ঘটনাটি ২০১৫ সালের একটি পিটিয়ে মারার ঘটনা এবং নিহত মহিলাটি আফগান বিমানচালিকা সফিয়া ফিরোজি নন, বরং ইসলামি বিদ্যার ছাত্রী ফরখুন্দা মালিকজাদা।
কাবুল অধিকার করে সমগ্র আফগানিস্তানে তালিবান তার নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ফেলার পর থেকেই রকমারি ভুয়ো খবর, ছবি ও ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়ে চলেছে। বুম ইতিমধ্যেই এ ধরনের অসংখ্য ভুয়ো খবরের পর্দাফাঁস করেছে এবং দিন-দিন তার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
যদি আপনি তালিবান বিষয়ে কিংবা আফগানিস্তান নিয়ে এই ধরনের কোনও ভুয়ো বা ভিত্তিহীন খবরের সন্ধান পান, তাহলে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন নম্বরে (+৯১ ৭৭০০৯০৬৫৮৮)তা পাঠাতে ভুলবেন না।
আরও পড়ুন: হল্যান্ডে গণেশ চতুর্থী উৎসব বলে ছড়াল ২০১৮ সালের ফ্রান্সের ভিডিও