সোশাল মিডিয়ায় দুটি বই নিয়ে খুব তোলপাড় চলছে— ডিন কুনজ-এর লেখা "দ্য আইজ অফ ডার্কনেস" (১৯৮১) এবং সিলভিয়া ব্রাউনের লেখা "এন্ড অফ ডেজ" (২০০৮)। দুটি বইতেই নাকি করোনাভাইরাস মহামারীর ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল বলে দাবি।
১৯৮১ সালে লেখা বইটির বিভিন্ন পৃষ্ঠার প্রতিলিপি ফেসবুক, টুইটার ও হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করে বলা হচ্ছে, এ ধরনের একটি মহামারীর আক্রমণের কথা সেখানে আগাম জানানো হয়েছিল।
সম্প্রতি করোনাভাইরাস নিয়ে ভুল তথ্য ও গুজবের প্লাবন বইছে ইন্টারনেটে। তার মধ্যেই আবার ফিল্ম ও বইপত্রকে ঘিরে ছড়ানো গুজবগুলো সবচেয়ে চমকপ্রদ। কন্ট্যাজিয়ন ফিল্মটিকে শেয়ার করা হয়েছে এই ভাইরাস সংক্রমণের পূর্বাভাস হিসাবে। তারপর এখন কুনজ-এর থ্রিলার উপন্যাস এবং ব্রাউনের মনস্তাত্ত্বিক উন্মোচনের সঞ্চয়ন সেই বিবরণীতে অভিনব মাত্রা সংযোজন করেছে।
বুম তার হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইনে একাধিক অনুরোধ পেয়েছে এই বইগুলিতে করোনাভাইরাসের আগাম ইঙ্গিত সত্যি-সত্যিই রয়েছে কিনা যাচাই করে দেখতে। সম্প্রতি করোনাভাইরাস মার্কিন মুলুকে পৌঁছনর পর রিয়্যালিটি টিভির খ্যাতনাম্নী তারকা কিম কার্দাশিয়ান ওয়েস্ট তার টুইটারে সিলভিয়া ব্রাউনের ভবিষ্যদ্বাণী শেয়ার করেছেন।
Kourtney just sent this on our group chat pic.twitter.com/XyjGajY71d
— Kim Kardashian West (@KimKardashian) March 12, 2020
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
সিলভিয়া ব্রাউনের বইটি বিষয়ে এক বার্তায় ক্যাপশন দেওয়া হয়েছে: "আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী... যা যা ঘটছে, ঠিক সেটাই তিনি আগাম আভাস দিয়েছিলেন! একটি বই যার নাম এন্ড অফ ডেজ। এই মানবজাতি কী ভাবে নিঃশেষ হবে, তার পূর্বাভাস ও ভবিষ্যদ্বাণী। এই বইতেই করোনাভাইরাসের বিশ্ব জোড়া সংক্রমণ নিয়ে পূর্বাভাস দেওয়া আছে। ২০০৮ সালে প্রকাশিত এই বইটির প্রাসঙ্গিক অংশ বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে এবং সেই অংশগুলি এমনই রোমহর্ষক যে পড়তে-পড়তে আপনাকে নিজের ঘাম মুছতে টিস্যু পেপারের বাক্স হাতড়াতে হবে।"
বুম-এর হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন নম্বরে (৭৭০০৯০৬১১১) পাঠানো বার্তা এবং সেই সঙ্গে পাঠানো সিলভিয়া ব্রাউনের বইটির অংশবিশেষের প্রতিলিপি নীচে দেখুন।নীচে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন (৭৭০০৯০৬১১১) নম্বরে পাঠানো বার্তা ও বইয়ের প্রতিলিপি দেখতে পারেন।
হিন্দিতেও ভাইরাল হয়েছে ওই বার্তাটি।
(হিন্দিতে লেখা ক্যাপশন: "एक किताब है नाम the eyes of darkness 1981 को पब्लिश हुई थी इसमे लिखा है कि कॅरोना वायरस को चीन ने अपने शहर वुहानके एक लैब में सबसे छुपा कर बनाया था ,बाद में चीन इसको use करेगा अपनी गरीब लोगों की आबादी कम करने के लिए जिससे कि उसे सुपर पावर बनने में आसानी हो ,और इस बुक में कॅरोना वायरस का नाम वुहान 400 के नाम पर है इस किताब में पहले ही बता दिया है कि आगे चलकर चीन इस वायरस का उपयोग करेगा बायो लॉजिकल हथियार के रूप में लेखक का नाम Dean Koontz किताब के पेज 353 से 356")
দুটি বইয়েরই সারাংশ সোশাল মিডিয়ায় এই বলে ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছে যে, এগুলি করোনাভাইরাসের বর্তমান মহামারীর আশঙ্কা আগাম জানিয়ে রেখেছিল। একটা ব্যাপারে বুম নিশ্চিত হয়েছে যে, সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া উদ্ধৃত অংশগুলি সংশ্লিষ্ট বইগুলি থেকেই নেওয়া।
একই বিষয়ে করা টুইটগুলি নীচে দেখুন।
A Dean Koontz novel written in 1981 predicted the outbreak of the coronavirus! pic.twitter.com/bjjqq6TzOl
— Nick Hinton (@NickHintonn) February 16, 2020
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
A book entitled - End of days - by Sylvia Browne interestingly prophesied the 2020 COVID19 virus...…. pic.twitter.com/4MbANvDcPj
— DUTERTENOMICS (@Dutertenomics) March 8, 2020
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
সিলভিয়া ব্রাউনের "এন্ড অফ ডেজ" কি করোনাভাইরাস প্রকোপের ভবিষ্যৎ বাণী করেছিল?
সিলভিয়া একজন স্বঘোষিত আধিদৈবিক এবং প্রেতবিদ্যাবিশারদ, যিনি অতিন্দ্রীয় জগতে আত্মাদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করেন। সেই হিসাবে তাঁর দাবি, তিনি ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিতে পারেন। এই সূত্রে তিনি ইতিপূর্বে হারিয়ে যাওয়া শিশুদের সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য অভিভাবকদের বিরাগভাজনও হয়েছেন।
২০০৮ সালে প্রকাশিত তাঁর "এন্ড অফ ডেজ" বইটিতে লেখা রয়েছে: "২০২০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বে ভয়ংকর নিউমোনিয়া জাতীয় একটি রোগের প্রাদূর্ভাব ঘটবে, যা ফুসফুস ও শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করবে এবং যার কোনও চিকিত্সা নেই। যেমন বিস্ময়করভাবে রোগটির প্রাদূর্ভাব ঘটবে, তার চেয়েও বিস্ময়করভাবে সেটি আবার অদৃশ্যও হয়ে যাবে, আবার দশ বছর পর ফিরে আসার জন্য। তার পর এটি বরাবরের জন্যই অদৃশ্য হয়ে যাবে।"
সিলভিয়া ২০১৩ সালে প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু ২০২০ সালে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মহামারী বিষয়ে তাঁর পূর্বানুমান মিলে গেছে। করোনাভাইরাস নতুন কোনও জীবাণু নয়, কিন্তু তার যে বিশেষ প্রকরণটি এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, সেই কোভিদ-১৯ একটি নতুন ভাইরাস, যার কোনও চিকিত্সা বা প্রতিষেধক টিকা এখনও বের হয়নি। তবে ভাইরাসের আত্মপ্রকাশ বিস্ময়কর কিংবা এটি সহসা একদিন আপনা থেকেই অদৃশ্য হয়ে যাবে বলে তাঁর পূর্বানুমান চিকিত্সাশাস্ত্রজ্ঞরা মেনে নিচ্ছেন না। তাঁদের মতে কোভিদ-১৯ একটি মরসুমি অসুখ হিসাবে রয়ে যাবে। এন্ড অফ ডেজ-এর ভবিষ্যদ্বাণীটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালে, তার আগেই ২০০০ সালে তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ জনিত মহামারী সার্স-এর প্রকোপ থামার পর। সিলভিয়া হয়তো এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীটি করেছিলেন একটি বুদ্ধিদীপ্ত অনুমান হিসাবে।
আরও পড়ুন: রাজস্থানে করোনাভাইরাসের কবলে ছাগল? খাসির মাংস কতটা নিরাপদ
ডিন কুনজ-এর ''দ্য আইজ অফ ডার্কনেস''-এর ব্যাপারটা কী?
১৯৮১ সালের এই উপন্যাসটি মার্কিন লেখক ডিন কুনজ-এর রচনা। সিলভিয়ার মতো কুনজ কখনও দাবি করেননি যে তাঁর উপন্যাসে বর্ণিত ঘটনাবলী একদিন বাস্তব হবে। থ্রিলারধর্মী এই উপন্যাসে উহান শহরের একটি গবেষণাগারে চিনা সামরিক বাহিনীর তরফে একটি জৈব মারণাস্ত্র তৈরির কথা আছে, যার নাম কাকতালীয়ভাবে "উহান-৪০০"। চিনের বিখ্যাত উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি উহান প্রদেশেই অবস্থিত এবং এই ইনস্টিটিউটে করোনাভাইরাস নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষাও চলেছে।
কিন্তু কুনজ-এর উপন্যাসের উহান-৪০০ আর কোভিদ-১৯-এর মধ্যে যা কিছু সাদৃশ্য, তা এটুকুতেই সীমাবদ্ধ:
১) উপন্যাসে যে নতুন ও বিপজ্জনক ভাইরাস জৈব মারণাস্ত্র হিসাবে তৈরি করা হচ্ছে, তা দুর্ঘটনাবশত কিছু অসামরিক ব্যক্তিকে মাত্র ৪ ঘন্টার মধ্যেই সংক্রামিত করে ফেলে। সেখানে কোভিদ-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে ১ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সংক্রামিত হওয়ার গড় সময় ৫ দিন।
২) উপন্যাসের উহান-৪০০ ভাইরাসে আক্রান্ত সকলেই ব্যতিক্রমহীনভাবে মারা যায় এবং তা ঘটে সংক্রামিত হওয়ার ১২ থেকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে মারা যায় মটে ৩ থেকে ৪ শতাংশ মানুষ।
৩) সাহিত্যের ভাইরাস উহান-৪০০-র থেকে বাস্তবের ভাইরাস কোভিদ-১৯-এর সংক্রমণের লক্ষণগুলি আলাদা। উহান-৪০০য় সংক্রামিতদের শরীরে এক বিষাক্ত রস নিঃসৃত হয় যা মস্তিষ্কের রোষগুলিকে খেয়ে ফেলে, ফলে শরীরের বিভিন্ন ক্রিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। সংক্রামিত ব্যক্তির নাড়ি স্তব্ধ হয়ে যায়, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং শ্বাস নেওয়ার ইচ্ছা চলে যায়।
আর কোভিদ-১৯-এর লক্ষণগুলি হলো—জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট। সংক্রমণ মৃদু হলে সাধারণভাবে ঠাণ্ডা লাগার লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে, আর তা অতিশয় তীব্র হয়ে উঠলে নিউমোনিয়া, তীব্র শ্বাসকষ্ট, কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়া এবং মৃত্যুও ঘটতে পারে।
৪) উপন্যাসের ভাইরাস উহান-৪০০কে জৈব মারণাস্ত্র হিসাবে পরীক্ষাগারে তৈরি করা হয়েছে বলে গল্পে দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোভিদ-১৯-এর ভাইরাস সর্বপ্রথম দেখা যায় গত বছরের শেষ দিকে উহানের একটি সামুদ্রিকখাদ্য বিক্রির বাজারে, যেখানে বেআইনিভাবে বন্য জন্তুর মাংস বিক্রি করা হতো। এবং বিজ্ঞানীরা এখনও ভাইরাসটির উৎস আবিষ্কার করতে পারেননি।
৫) সাহিত্যের ভাইরাস উহান-৪০০কে "ইবোলা"র চেয়েও মারাত্মক জীবাণু রূপে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু কোভিদ-১৯ তত মারাত্মক নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, ইবোলায় আক্রান্তদের মৃতের হার গড়ে ৫০ শতাংশ, এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে ২৫ থেকে ৯০ শতাংশও হতে দেখা গেছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবেই কোভিদ-১৯-এ আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হার শতকরা ৪ থেকে ৫ ।
মজার ব্যাপার হলো, ডিন কুনজ-এর ১৯৮১ সালের উপন্যাস দ্য আইজ অফ ডার্কনেস-এর প্রথম সংস্করণে ভাইরাসটির নাম ছিল "গোর্কি-৪০০", যা গোর্কি নামক রুশ লোকালয়ের কথা বলে। গল্পের অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয়ও গোর্কিকে ঘিরেই বোনা হয়েছিল। যেমন গোর্কি জনপদের বাইরেই এটি তৈরি করা হয়েছিল এবং এটি ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার তৈরি গোটা দশকের সবচেয়ে ভয়ংকর জৈব মারণাস্ত্র। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইলে গুগল বুকস-এ বইটির পিডিএফ পাণ্ডুলিপি খুঁজে দেখতে পারেন, যার একটি স্ক্রিনশট নীচে দেওয়া হলো।
১৯৮৯ সালে ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের পর প্রকাশিত সংস্করণে ভাইরাসটির নাম ও প্রেক্ষাপট পাল্টে দেওয়া হয়l। এ ব্যাপারে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এর একটি প্রতিবেদন পড়ে দেখতে পারেন, যেখানে প্রথমদিকের সংস্করণটির কথা ও ছবি রয়েছে। প্রথম সংস্করণটি লেই নিকলস ছদ্ম নামে প্রকাশিত হয়েছিল, যে নামটি কুনজ গ্রহণ করেছিলেন।
বুম উপন্যাসটির লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে, তবে এখনও কোনও সাড়া পায়নি।
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক বেরিয়ে গেছে দাবিটি মিথ্যে