কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী লকডাউন চলায় বায়ুদূষণের মাত্রা কমার ফলে মহাকাশ থেকে স্পষ্ট রামসেতু দেখা যাচ্ছে—এই ভুয়ো দাবি সহ ৪ বছরের পুরনো ভিডিও আবার ফেসবুকে জিইয়ে তোলা হয়েছে। মূল ভিডিওটি ডিসকভারির মালিকানাধীন আমেরিকার সায়েন্স চ্যানেলের, যেটি ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সম্প্রচার করা হয়েছিল।
২ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে প্রথমে নাসার পাঠানো উপগ্রহ চিত্র দেখানো হয়। যা ভারত মহাসাগরের অগভীর অঞ্চল শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মধ্যে জায়গাটিকে অর্ধনিমজ্জিত বস্তুর শৃঙ্খল হিসেবে দেখায়। ভিডিওতে এর পর ৩০ মাইল দীর্ঘ বেলে পাথরের(Sandbar) তৈরি সংযোগকারী সেতুর ভৌগলিক কাঠামোর মহাকাব্যিক প্রসঙ্গ ও ভূতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বর্ণনা করা হয়। স্যান্ড বার ভৈগলিক কারণে তৈরি হলেও তার উপরের পাথর সম্ভবত কোনওভাবে বয়ে আনা। ভৌগলিকরা দেখেছেন স্যান্ডবার ৭০০০ বছরের পুরনো। কিন্তু বালির উপরে থাকা পাথর মাত্র ৪০০০ বছরের পুরনো। আর অতীতে এটি তৈরি করা নিঃসন্দেহে এক অতিমানবিক কাজ।
আরও পড়ুন: হেলিকপ্টার থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের উপরে পুষ্পবৃষ্টি করার ছবিটি সম্পাদিত
ভিডিওটি ফেসবুকে শেয়ার করে ক্যাপশন লেখা হয়েছে, "পরিবেশ দূষণ কমতেই রামসেতু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে।"
তামিলনাডুর দক্ষিণ পূর্বের উপকূলে পাম্বান ও রামেশ্বরমের অ্যাডমস ব্রিজ বা রাম সেতু নামে পরিচিত এই ভৌগলিক অঞ্চলের ব্যাখা করা হয় ভিডিওটিতে।
আরও পড়ুন: ডুয়ার্সে ৩১ নং জাতীয় সড়কে জখম চিতাবাঘের ভিডিও জিইয়ে উঠলো
তথ্য যাচাই
বুম প্রথমে ইন্টারনেটে 'নাসা স্যাটেলাইট রাম সেতু' এই কী-ওয়ার্ড দিয়ে গুগুলে সার্চ করে। বুম বেশ কিছু সংবাদ প্রতিবেদনের হদিস পায় যেখানে এই ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ব্যবহার করা হয়েছে।
বুম দেখে ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর 'সায়েন্স চ্যানেল' এই ভিডিওটি টুইট করে। টুইটে লেখা হয়, "প্রাচীন হিন্দু পুরাণের ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে সংযোগকারী একটি স্থল সেতুর কাহিনী কি সত্যি? বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সেরকমই নির্দেশ করে। #হোয়াটঅনআর্থ"
(ইংরেজিতে মূল টুইট: "Are the ancient Hindu myths of a land bridge connecting India and Sri Lanka true? Scientific analysis suggests they are. #WhatOnEarth")
Are the ancient Hindu myths of a land bridge connecting India and Sri Lanka true? Scientific analysis suggests they are. #WhatonEarth pic.twitter.com/EKcoGzlEET
— Science Channel (@ScienceChannel) December 11, 2017
ভিডিওকে ইউটিউবে সায়েন্স চ্যানেলের আপলোড করে ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি। ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা হয়, "হোয়াট অন আর্থ? মঙ্গলবার তারি ৯ টা, ভগবান রাম সম্পর্কে প্রাচীন হিন্দু কথকতা এক আশ্চর্য প্রাচীন প্রকৌশলের উপর আলোকপাত করে"
(ইংরেজি ক্যাপশন: "What on Earth? | Tuesday 9p, Ancient Hindu lore about the god Rama sheds light on an incredible feat of ancient engineering.")
৪ বছর আগে ওই চ্যানেলে সম্প্রচারিত 'হোয়াট অন আর্থ' অনুষ্ঠানের একটি পর্বে 'অ্যানশিয়েন্ট ল্যান্ড ব্রিজ' (প্রাচীন স্থল সেতু) নামে একটি পর্বের জন্য প্রোমো হিসেবে রাম সেতু নিয়ে ভিডিওটি প্রকাশ করেছিল।
আরও পড়ুন: মিথ্যে: প্রধানমন্ত্রী মোদীর রাত ৯ টায় ৯ মিনিট সংহতির আলোকিত ভারতের ছবি
মহাকাশ চিত্র
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ২০০২, ২০১৬ ও ২০১৮ সালে তোলা পক প্রণালীর(Palk Strait) উপগ্রহ চিত্র দেখা যাবে এখানে, এখানে ও এখানে। ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ESA)-র ২০০৬ সাল থেকে রাম সেতু বা অ্যাডমস ব্রিজের মহাকাশ থেকে তোলা ছবি ক্যামেরাবন্দী করে আসছে। সংস্থার 'পৃথিবী প্রদর্শন' ওয়েবসাইটে ২০১৭ সালে তোলা অ্যাডমস ব্রিজ বা রাম সেতুর ছবিটি নীচে দেওয়া হল।
রামসেতু বা অ্যাডাম ব্রিজ তরজা
সায়েন্স চ্যানেলে সম্প্রচারিত ভিডিওটির বৈজ্ঞানিক তত্বের যৌক্তিকতা নিয়ে মতভেদ তৈরি হয়। ২০০৮ সালে ইউপিএ সরকারের সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া বয়ান নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরেও যথেষ্ট জলঘোলা হয়েছিল। ২০১৭ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ সংস্থা থেকে প্রক্তন ভারতীয় ভূতাত্বিক সর্বেক্ষণের প্রাক্তন কর্ণধার ও সমুদ্র প্রত্নতত্ত্ববিদ আলোক ত্রিপাঠীর নেতৃত্বে ২০ জন গবেষককে নিয়ে ফের গবেষণা শুরু করার কথা ওঠে। সে গবেষণার ফলাফল কোথাও প্রকাশিত হয়নি। ২০০৭ সালে আবশ্য নাসার তরফে কার্বন ডেটিং(পাথরের বয়স জানা যায়)-এর কথা অস্বীকার করা হয়।
হিন্দু মহাকাব্যে যেমন রাম সেতু বলা হয়েছে, একেশ্বরবাদী ধর্মেও একে আদিপিতা অ্যাডমের এক পায়ে ১০০০ বছর দাঁড়ানো সিংহলের চূড়া বলা হয়েছে। আর তা মিলে মিশে রাম সেতু বা অ্যাডমস ব্রিজ নামকরণ।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে বিষ প্রয়োগে বানর হত্যার ছবি ভারতে সাম্প্রদায়িক রং সহ ছড়ালো