সোশাল মিডিয়ায় দুটি ছবির মধ্যে যোগসাজস খোঁজা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে মুজাফরনগর এক আহত মৌলানার ছবি, যাঁকে পুলিশ মারধর করেছে বলে অভিযোগ, এবং অনেকটা একই রকম দেখতে আর এক জন লোকের ছবি, যিনি কানপুরে বিক্ষোভের সময় পাথর ছুঁড়েছিলেন, তারা নাকি অভিন্ন ব্যক্তি এরকম মিথ্যে দাবি ছড়াচ্ছে। বুম অনুসন্ধান করে দেখেছে যে ছবিদুটিতে যে দু'জন লোককে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা ভিন্ন ব্যক্তি।
যে প্রতিবাদী পাথর ছুঁড়ছেন, তিনি কানপুরের। আর অন্য ছবিটি মৌলানা আসাদ হুসেইনির। তিনি মুজাফরনগরের। দ্বিতীয় শহরটি কানপুর থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে। অভিযোগ, সহিংস প্রতিবাদীদের দমন করতে গিয়েই পুলিশ মৌলানা হুসেইনিকে মারধর করে।
Oyevivekk নামে এক টুইটার ব্যবহারকারী ছবিদুটি টুইট করে লেখেন, "নিউটনের তৃতীয় সূত্র: প্রতিটি ক্রিয়ার সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।" মুজাফরনগরের মৌলানা সৈয়দ রাজা হুসেইনির ওপর পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ করে করা একটি টুইটের উত্তরেই তিনি এই টুইটটি করেন।
Newton's third law: For every action, there is an equal and opposite reaction. https://t.co/p53dWz10z0 pic.twitter.com/sCX3UUhMGL
— Vivekk | विवेक | বিবেক | விவேக் | (@oyevivekk) December 29, 2019
আরও অনেকেই এই একই ছবি শেয়ার করেন। একটি একটি সংবাদপত্রের ছবি, যেখানে এক প্রবীণকে পাথর ছুঁড়তে দেখা যাচ্ছে। আর অন্য ছবিটি আহত মৌলানার।
Meet this Peaceful Mullah
— Praveen Agarwal😊🇮🇳🇮🇳 (@PRAVEENGUNA) December 30, 2019
Maulana Syed Raja Hussaini 82
He was spreading terror, doing riots, pelting stones on the name of Jehad
When beaten by police, he now making PIG like face and PLAYING VICTIM VICTIM
This is Radical Islamic Terror #IStandWithUpPolice #ISupportCAA_NRC pic.twitter.com/vkGhsABN77
তথ্য যাচাই
বিক্ষোভকারীর পাথর ছোঁড়ার ছবি
তাঁর ছবি রিভার্স ইমেজ সার্চ করে আমরা ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখের হিন্দুস্তান টাইমস সংবাদপত্রের লখনউ সংস্করণের একটি প্রতিবেদনের সন্ধান পাই। ছবিটি সেই প্রতিবেদনটির সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল "Kanpur erupts again with pitched battle"
প্রতিবেদনটি কানপুর এলাকায় হিংসাত্মক বিক্ষোভ সম্বন্ধে। ছবিটির ক্যাপশনে লেখা হয়েছিল, "শনিবার কানপুরে এক বিক্ষোভে এক প্রবীণ পাথর ছুঁড়ছেন।"
যে চিত্রসাংবাদিক ছবিটি তোলেন, বুমের তরফে তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান যে ছবিটি সত্যিই ২২ ডিসেম্বর "কানপুরের কর্নেলগঞ্জ এলাকায় এতিমখানা রোডে তোলা।"
ছবিতে যে প্রবীণকে দেখা যাচ্ছে, তাঁর পরিচয় পাওয়া সম্ভব হয়নি।
আহত ব্যক্তির ছবি
দ্বিতীয় ছবিটিতে যে আহত ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে, তাঁকে আমরা শিয়া ধর্মগুরু মৌলানা আসাদ রাজা হুসেইনি বলে শনাক্ত করতে পারি। বুম জানতে পারে যে ২০ ডিসেম্বর রাতে পুলিশ যখন দরিদ্র ছেলেদের জন্য আবাসিক মাদ্রাসা সাদাত হস্টেলে ঢোকে, তখন তারা প্রবল অত্যাচার চালায় বলে অভিযোগ। জানা গিয়েছে, মৌলানা সেই ঘটনাতেই গুরুতর আহত হন। তিনি শয্যাশায়ী, সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলা করতে পারছেন না।
রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে আমরা ক্যারাভ্যান ডেইলির একটি সংবাদ প্রতিবেদনের সন্ধান পাই, যেখানে এই একই ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রতিবেদনটি মুজাফরনগরে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনে হিংস্রতার প্রসঙ্গে ছিল। সেই বিক্ষোভে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। মুজাফরনগরের প্রতিবাদীরা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই পুলিশি নিষ্ঠুরতার অভিযোগ করেছেন।
বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে মৌলানা হুসেইনি সাদাত হস্টেল চত্বরে ছিলেন, যখন বেশ কিছু পুলিশকর্মী "সেই হস্টেলে ঢুকে সম্পত্তি তছনছ করে, এবং হাতের সামনে যাদের পায় তাদের বেধড়ক পেটায়।" নিউজক্লিকের একটি সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, বিক্ষোভকারীদের খোঁজেই পুলিশ হস্টেলে ঢুকেছিল। যে সংগঠনটি আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ছেলেদের জন্য এই হস্টেলটি চালায়, হুসেইনি তার প্রধান। তিনিই এই হস্টেলের কেয়ারটেকার। প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়েছে, "৬৫ বছর বয়স্ক হস্টেল কেয়ারটেকারমৌলানা আসাদ রাজা হুসেইনিকে নির্মম ভাবে প্রহার করা হল। হস্টেলে যতজন ছেলে ছিল তাদের টেনে বার করা হয়, মারধর করার পর মৌলানা আসাদের সঙ্গে তাদেরও পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হল।"
দ্য টেলিগ্রাফের একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে যে মৌলানাকে ২৪ ঘণ্টা পুলিশি হেফাজতে রাখা হয়। তাঁকে জোর করে বিবস্ত্র করা হয় এবং তাঁর ওপর অত্যাচার করা হয় বলেও অভিযোগ। প্রতিবেদনটিতে মৌলানার পরিবারের এক সদস্যকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে, তাঁকে২১ ডিসেম্বর রাত্রে ছাড়া হয়।
যে বিক্ষোভকারীর পাথর ছোঁড়ার ছবিটি শেয়ার করা হচ্ছে, সেই ছবিটি তোলা হয়েছিল ২২ ডিসেম্বর।
বুম মৌলানার ছেলে মহম্মদ হুসেইনির সঙ্গেও কথা বলে। তিনি জানান যে মৌলানা গুরুতর আহত, এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। শুধুমাত্র ডাক্তার দেখাতে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও সময় তিনি নিজের ঘর থেকে বেরোতে অস্বীকার করছেন। "বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যাওয়ার সামর্খ্যও তাঁর নেই। তিনি কী ভাবে কানপুরে বিক্ষোভে অংশ নিতে যাবেন। যারা এই ছবি শেয়ার করছে, আমার বাবার অবস্থা সম্বন্ধে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।"
আমরা মাদ্রাসার এক শিক্ষক নইম আলমের সঙ্গেও যোগাযোগ করি। তিনিও একই কথা জানান। সঙ্গে বলেন, "২০ ডিসেম্বর হস্টেলটি তছনছ করা হয় এবং মৌলানাকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়। তিনি ছাড়া পান ২১ ডিসেম্বর, এবং পুরো রাত নিজের পরিবারের সঙ্গে ছিলেন। ২২ ডিসেম্বর তাঁর আঘাতের চিকিৎসা চলছিল।"
এক লোক নন
হিন্দুস্তান টাইমসের চিত্রসাংবাদিকের থেকে বুম সেই বিক্ষোভকারীর বেশ কয়েকটি হাই রেজোলিউশন ছবি পেয়েছে, এবং মৌলানার ছবির সঙ্গে তার তুলনা করে দেখেছে।
পাশাপাশি রেখে মিলিয়ে দেখলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে দুটি ছবির মধ্যে বিস্তর ফারাক। দু'জনের উচ্চতা এবং শারীরিক গঠনে অমিল রয়েছে। দুটি ছবির দুই ব্যক্তির মধ্যে ফারাকগুলি আরও স্পষ্ট ভাবে বোঝার জন্য আমরা প্রতিবাদকারীর ছবিতে তাঁর মুখের ওপর ম্যাগনিফায়ার ব্যবহার করেছি (ওপরের ছবিতে দেখুন)।