সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যাতে এক দল ভারতীয় তরুণকে মাস্ক পোড়াতে দেখা যাচ্ছে। তাঁরা দাবি করছেন যে, কোভিড-১৯ ঠেকানর ক্ষেত্রে মাস্ক কোনও কাজে আসে না, উপরন্তু শরীরে কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে, যাকে বলা হয় হাইপারক্যাপনিয়া বা হাইপারকারবিয়া।
ভিডিওটির প্রস্তুতকারক বীর সাক্সেনা, নাম্মান ভাসিন ও নাবীল আহমেদ মিরাজকার বুমকে বলেন যে, মাস্কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা আসলে জনসাধারণকে মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রন করা ও তাদের মনে ভয় সৃষ্টি করার চেষ্টা। তাঁরা আরও বলেন যে, ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেলেও, তাঁরা ভ্যাকসিন নেবেন না।
বুম দেখে তাঁদের দাবিগুলি মিথ্যে। কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের হার কমানোর ক্ষেত্রে মাস্কের কার্যকারিতা নানান বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও তথ্যে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাছাড়া, একাধিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেছেন যে, যাঁদের নিশ্বাসের সমস্যা নেই, তাঁদের ক্ষেত্রে মাস্ক হাইপারকারবিয়া সৃষ্টি করে না। মুম্বাইয়ের একজন ফুসফুস বিশেষজ্ঞ, ডঃ জীনাম শাহ, বুমকে বলেন, অনেকক্ষণ মাস্ক পরে থাকলে, হাল্কা ধরনের হাইপারকারবিয়া, ক্লান্তি ও মাথার যন্ত্রণা দেখা দিতে পারে। কিন্তু কোভিড-১৯'র তুলনায় সেগুলির গুরত্ব নগন্য।
বুম ফেসবুক ও টুইটারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চায় যে, ওই ভিডিওটি তাঁদের নীতির পরিপন্থী কিনা? এর পরই ওই দুই কম্পানি সেটি ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্র্যাম থেকে সরিয়ে দেয়।
#মাস্কসেআজাদি ভিডিও
ভিডিওটিতে যাঁদের দেখা যাচ্ছে, বুম জানতে পারে যে, তাঁরা মুম্বাইয়ের বাসিন্দা। তাঁদের বীর সাক্সেনা, নাম্মান ভাসিন ও নাবীল আহমেদ মিরাজকার হিসেবে শনাক্ত করা হয়। তাঁরা জানান যে, তাঁদেরকেই ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে এবং সেটি তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে তৈরি করেন। ভাসিন, মিরাজকার ও সাক্সেনা হলেন অভিনেতা, যাঁদের বিজ্ঞাপন, টিভি ও সিনেমায় দেখা যায়।
ফেসবুক পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে
এখানে।
তাঁদের অ্যাকাউন্ট দেখে জানা যায় যে, ভাসিন তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেও ভিডিওটি পোস্ট করেন।
ভাসিনের ফেসবুক পোস্টের আর্কাইভ আছে
এখানে।
ভাইরাল ভিডিওটি এখানে দেখুন।
আমরা প্রখমে সাক্সেনার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি ভিডিওটিতে যে সব কথা বলেছেন, সেগুলিকেই সমর্থন করেন। জানতে চাওয়া হয়, ভিডিওটি তৈরি করার কথা উনি কেন ভাবলেন। জবাবে উনি বলেন, দু'মাস আগে, কাজের সময় প্রায় আট ঘন্টা মাস্ক পরে থাকার ফলে তাঁর নিশ্বাসের সমস্যা দেখা দেয়। সেই থেকে মাস্কের কার্যকারিতা সম্পর্কে তাঁর মনে সন্দেহ জাগে।
"আমি মুম্বাইয়ের একটি নাম করা হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করি। উনি আমায় মাস্ক না পরার পরামর্শ দেন। উনি আমায় বলেন, 'আমার ফুসফুসে সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং মাস্ক হল ক্ষতিকারক। তারপর আমি মাস্ক সম্পর্কে পড়াশোনা করি ও ভিডিও দেখি যা আমার বিশ্বাসকে দৃঢ় করে।" যে ডাক্তার ও হাসপাতাল তাঁকে মাস্ক ব্যবহার করতে বারণ করে, সাক্সেনা তাঁদের নাম জানাতে অস্বীকার করেন। উনি আরও বলেন, "অনেক ডাক্তার একই মত পোষণ করেন কিন্তু সত্যটা সাহস করে বলতে পারেন না।"
এর পর ভাসিন ও মিরাজকারের সঙ্গে কথা বললে, তারাও নিজেদের মত সমর্থন করেন। জানতে চাওয়া হয়, মাস্ক পরার ফলে তাঁরাও অসুস্থ বোধ করেন কিনা। উত্তরে ভাসিন বলেন, "আমার স্বাস্থ্যের কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু ২০-৩০ মিনিট মাস্ক পরে থাকলেই আমার অস্বস্তি হতে থাকে।" উনি বলেন, অনেক আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় ডাক্তার বলেছেন মাস্ক কোনও কাজে দেয় না। কিন্তু সেই ডাক্তারদের ভিডিওগুলি সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং চ্যানেলগুলি ব্লক করে দেওয়া হচ্ছে। উনি জানতে চান. "কেন টিউবারকুলোসিসের ক্ষেত্রে একই পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে না, যখন ওই অসুখে বহু মানুষ মারা গেছেন ও এখনও যাচ্ছেন?"
ওই তিনজন যে সব গবেষণাপত্রের উল্লেখ করেন, বুম দেখে সেগুলির হয় 'পিয়ার রিভিউ' করা হয়নি বা নিজেদের দাবিগুলিকে সমর্থন করার মতো যথেষ্ট তথ্য হাজির করতে পারে নি। সাক্সেনা বলেন, "সকলেই দাবি করছেন যে, হু এ কথা বলেনি। কিন্তু হু'র অপেক্ষায় বসে থেকে লাভ নেই, কারণ অন্য ডাক্তাররা গবেষণা করছেন। আমি বিভিন্ন ডাক্তারের অন্তত ১০০টি লেখা পড়েছি, বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও বিভিন্ন জার্নাল দেখেছি। সবেতেই একই কথা বলা হয়েছে যে, মাস্কের কোনও কার্যকারিতা নেই। মিরাজকার বলেন, "কোভিড-১৯ যদি এতই বড় ব্যাপার, তাহলে পরীক্ষায় যাঁদের পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে, তাঁদের ৯০ শতাংশই কেন বড় বড় বাড়ির বাসিন্দা? যাঁরা বস্তি বা রাস্তায় থাকেন তাঁরা নন কেন, বিশেষ করে যখন তাঁদের ক্ষেত্রেই সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হওয়ার কথা?"
তথ্য যাচাই
ফেসবুকে দেওয়া সাক্সেনা, ভাসিন ও মিরাজকারের ছবির সঙ্গে ভাইরাল ক্লিপে যাঁদের দেখা যাচ্ছে তাঁদের ছবি মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয় যে, আরও দুজনের সঙ্গে এই তিনজন ওই ভিডিওটিতে অংশ নেন।
নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে তাঁরা জার্নালে প্রকাশিত অনেকগুলি লেখার একটা তালিকা দেন আমাদের। কিন্তু কোভিডের বিরুদ্ধে মাস্ক যে কার্যকর হয় না বা হাইপারক্যাপনিয়া সৃষ্টি করে, তা ওই লেখাগুলি প্রমাণ করে না।
মাস্কের কার্যকারিতা
মাস্কের কার্যকারিতা সম্পর্কে জোর বিতর্ক থকলেও, মাস্ক যে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের হার কমিয়ে আনতে পারে, সে ব্যাপারে চিকিৎসকরা একমত।
১) কোভিড-১৯'র ছড়িয়ে পড়ার বৈশিষ্ট্য, ২) মাস্কের ফিল্টার করার ক্ষমতা ও তার উপযোগিতা, ৩) জনসাধারণের ওপর মাস্ক ব্যবহারের প্রভাব, এবং ৪) মাস্ক পরার নীতির কার্যকারিতা যাচাই করার ক্ষেত্রে বিবেচ্য সামাজিক ফ্যাক্টার – এই সব বিষয়গুলি সংক্রান্ত যে গবেষণা হয়েছে, তা পর্যালোচনা করে দেখেছেন স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষকরা।
তাঁরা দেখেন যে, সবাই যখন নিয়ম মেনে চলেন তখন মাস্ক পরাটা ফলপ্রসু হয়। তাঁরা পরামর্শ দেন যে, "সরকার ও সরকারি কর্তাব্যক্তিদের ব্যাপক ভাবে মাস্ক ব্যবহার এবং নিয়মের সঠিক প্রয়োগের ওপর জোর দেওয়া উচিৎ"।
২৪ জুন, ওয়াশিংটন ইউনিভারসিটির ইনস্টিটিউট অফ হেল্খ ম্যাট্রিক্স ইভ্যালুয়েশন এই ভবিষ্যৎবাণী করে যে, ১ অক্টোবর পর্যন্ত কোভিড-১৯ সংক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৩৩,০০০ কম হতে পারে যদি জনসাধারণের ৯৫ শতাংশ মাস্ক ব্যবহার করেন।
আমরা ফুসফুস বিশেষজ্ঞ ডঃ জীনাম শাহর সঙ্গে যোগাযোগ করি। মাস্ক কোনও কাজের নয়, তিনি এই দাবি সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেন। "এখন যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে, ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়া রোধ করার ক্ষেত্রে মাস্ক যথেষ্ট কার্যকর হয়। এই তথ্যও আছে যে, দু'জন মানুষ যদি মাস্ক পরে থাকেন, তাহলে তাঁদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানর সম্ভাবনা ১০ শতাংশেরও কম।"
হাইপারক্যাপনিয়ার বিষয়টি
অনেকক্ষণ মাস্ক পরে থাকলে শরীরে কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিষক্রিয়া হতে পারে (যাকে বলা হয় হাইপারক্যাপনিয়া বা হাইপারকারবিয়া), এই দাবিটি মে মাস থেকে ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু সংবাদ সংস্থা এএফপি সেটিকে ইতিমধ্যেই খণ্ডন করেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় স্টেলেসবশ ইউনিভারসিটির মেডিক্যাল ভাইরোলজি ডিভিশনের প্রধান উলফগঙ প্রেইসার
ওই সংবাদ সংস্থাকে বলেন, "মেডিক্যাল মাস্ক বা ভাল ভাবে তৈরি কাপড়ের মাস্ক কোনওটাই সেটি (হাইপারক্যাপনিয়া) সৃষ্টি করে না।"
হাইপারকারবিয়া হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে ডঃ শাহ বলেন, "স্বাভাবিক অবস্থায়, মাস্ক কোনও সমস্যা সৃষ্টি করে না। কিন্তু অনেকক্ষণ (দিনে ৮ ঘন্টার বেশি) পরে থাকলে, আপনার প্রাণ রক্ষা করার বিনিময়ে হাল্কা হাইপারকারবিয়া, হাল্কা ক্লান্তি ও মাথা ব্যাথা দেখা দিতে পারে। এবং এটা এন-৯৫ মাস্কের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সাধারণ মানুষ যে চালু মাস্ক পরেন, তাতে এই সমস্যা দেখা দেয় না।"
ভিডিওটি সরানো হয়েছে
বুম ফেসবুক ও টুইটারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। জানতে চাওয়া হয়, কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ভুল তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে তাদের যে নিযম আছে, এই ভিডিও সেটির পরিপন্থী কিনা? এর পরই ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্র্যাম থেকে ভিডিওটি সরিয়ে দেওয়া হয়।
টুইটারের এক মুখপাত্র বুমকে বলেন, "মাস্ক পরা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠিত সূত্র থেকে পাওয়া যে নির্দেশাবলী দেওয়া হয়েছে, সেগুলিকে যদি কোনও টুইট সরাসরি বিরোধিতা করে ও মানুষের স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে আমরা সেই টুইটের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিই। 'কোভিড-১৯ মিসইনফো পলিসি'-তে আমাদের কাজের ধারার একটা স্পষ্ট ছবি পাওয়া যাবে।"
ফেসবুকের মুখপাত্র বলেন, "কোনও শারীরিক ক্ষতি করতে পারে, সে রকম কোনও ভুল তথ্যকে আমরা আমাদের প্ল্যাটফর্মে জায়গা দিই না। আর জানুয়ারিতে কোভিড-১৯ অতিমারি ঘোষিত হওয়ার পর থেকে, আমরা ৭০ লক্ষ ক্ষতিকর ভুয়ো তথ্য সরিয়ে দিয়েছি। তার মধ্যে আছে ভুয়ো চিকিৎসা পদ্ধতি, করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব নেই ও মদ খেলে কোভিড-১৯ সেরে যায়, এমন সব দাবি।"