গেরুয়া পতাকা হাতে এক ব্যক্তির ছবি ভাইরাল হয়েছে এই মিথ্যে দাবি সমেত যে, তিনি বিহারে ২০ বছর বয়সী গুলনাজ খাতুনের হত্যার সঙ্গে যুক্ত। ৩০ অক্টোবর ২০২০ বিহারের বৈশালী জেলায়, গুলনাজকে পুড়িয়ে মারা হয়।
বুম দেখে, ভাইরাল ছবির ব্যক্তিটি, গুলনাজ হত্যার সঙ্গে যুক্ত নন। যদিও ওই ব্যক্তি একই জেলাতে জুলাই মাসের অন্য আরেকটি খুনের ঘটনার অভিযুক্ত।
৩০ অক্টোবর ২০২০ তে, বিহারের বৈশালী জেলার রসুলপুর হাবিব গ্রামে, গুলনাজ খাতুনের গায়ে কেরসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় তিন ব্যক্তি। বলা হচ্ছে, তারা বেশ কয়েক দিন ধরে গুলনাজকে অনুসরণ করছিল ও হুমকি দিচ্ছিল। ১৫ নভেম্বর, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে যান গুলনাজ। স্থানীয় পুলিশ বুমকে জানায় যে, অভিযুক্তদের মধ্যে একজন গ্রেফতার হয়েছে। বাকি দু'জন এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এফআইআর-এ অভিযুক্ত হিসেবে যাদের নাম আছে তারা হলো সতীশ রাই, চন্দন ও বিজয় রাই।
নির্যাতিতার একটি রেকর্ড-করা জবানবন্দি প্রকাশ্যে আসায়, সোশাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে। গুলনাজের ছবি ও ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়। টুইটারে #জাস্টিসফরগুলনাজ (গুলনাজের জন্য ন্যায়বিচার চাই) বলে শেয়ার করা হতে থাকে সেগুলি। অন্য দিকে, আততায়ীদের গ্রেফতারি দাবি করে, মৃতের পরিবারের সদস্যরা ধর্নায় বসেন।
লোকটির ছবিসহ ভাইরাল পোস্টগুলির হিন্দি ক্যাপশনে যা বলা হয়েছে, তা এই রকম, "গুলনাজ আজ মারা গেল। সতীশ কুমার ও চন্দন কুমার বিহারের গুলনাজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়, কারণ সে তাদের কাউকেই বিয়ে করতে রাজি হয়নি। অপরাধীরা আজও বেঁচে আছে। পোশাক দেখেই ধর্ষণকারীদের চিহ্নিত করা যায়।"
(হিন্দিতে লেখা ক্যাপশন: बिहार के वैशाली जिले की गुलनाज़ जिसे सतीश_कुमार और चंदन_कुमार ने शादी से इंकार करने पर अपने साथियों के साथ मिलकर मिट्टी का तेल छिड़क कर जला डाला था वह ज़िन्दगी की जंग हार गई और उनका निधन हो गया ,अपराधी अभी भी आज़ाद है बलात्कारी की पहचान आप कपडे से कर सकते है। #JusticeForGulnaz)
ভাইরাল পোস্টটি নীচে দেখুন। পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
বেশ কয়েকটি টুইটার হ্যান্ডেল থেকেও ছবিটি শেয়ার করা হয় আর দাবি করা হয় যে, গেরুয়া জামা-পরা লোকটি অভিযুক্তদের একজন।
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
আরও পড়ুন: ট্রেনে থুতু ফেলায় ফ্রান্সে মুসলিমরা গ্রেফতার? ছড়াল রোমানিয়ার ভিডিও
তথ্য যাচাই
ওই ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বুম বৈশালী জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পুলিশ সুপার মনীশ জানান যে, প্রধান অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এবং এফআইআর-এ আরও যে দু'জনের নাম রয়েছে, তাদের খোঁজ চলছে।
"অভিযুক্তকে ধরার জন্য একটি বিশেষ দল গঠন করা হয়েছিল। সে কোনও রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয়," বুমকে বলেন পুলিশ সুপার।
এর পর আমরা ছবিটির রিভার্স ইমেজ সার্চ করি। তার ফলে, ১১ অগস্ট ২০২০ তে করা একটি টুইট দেখতে পাই আমরা। তাতে ওই একই ছবি শেয়ার করা হলেও, ক্যাপশনটি ছিল অন্য রকম।
@মুসলিমআওয়াজ থেকে হিন্দিতে করা টুইটে দাবি করা হয়, "গনতন্ত্রের দেশে (বৈশালী) মহনার একটি মুসলমান মেয়েকে প্রকাশ্য দিবালোকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করে তার দেহ একটি কুয়োর মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযুক্তকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি।"
চারটি ছবির একটি সেট শেয়ার করা হয়েছে ওই টুইটে। তাতে রয়েছে একটি খবরের কাগজের ক্লিপিং, একটি মেয়ে, ভাইরাল হওয়া গেরুয়া জামা-পরা যুবক আর কুয়োর মধ্যে পড়ে থাকা একটি নারীদেহের ছবি।
(কিছু ছবি স্পর্শকাতর, নিজের দায়িত্বে দেখবেন)
আমরা জুলাই মাসের কিছু ফেসবুক পোস্টও দেখতে পাই। ওই পোস্টে অন্য ক্যাপশন সহ ওই একই যুবকের ছবি শেয়ার করা হয়।
খবরের কাগজের ক্লিপিংটির সূত্র ধরে আমরা কয়েকটি হিন্দি শব্দ দিয়ে (शाहजहां खातून की बेटी सोमी परवीन ও शालू कुमार सिंह) কিওয়ার্ড সার্চ করি। তার ফলে, ওই ঘটনাটি সম্পর্কে কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন সামনে আসে।
নিউজ১৮ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯ জুলাই ২০২০ তে ঘটনাটি ঘটে। মহনার পৌরসভার প্রাক্তন সভাপতি শাহজাহান খাতুনের মেয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে, একটি কুয়ো থেকে তার দেহ উদ্ধার হয়। মৃতের পরিবার তাদের প্রতিবেশি আমন সিং ওরফে শালু কুমারের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনেন।
এরপর, একই কি-ওয়ার্ড দিয়ে আমরা ফেসবুকেও সার্চ করি। তার ফলে, ওই ঘটনা সংক্রান্ত এফআইআর-এর একটি ছবি আমরা দেখতে পাই। তাতে মৃতের ভাই মহম্মদ সাবিরের ফোন নম্বর দেওয়া ছিল। এ বিষয়ে আরও জানতে, আমরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি।
ছবিতে যে ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে, সাবির তাঁকে আমন কুমার সিংহ ওরফে শালু কুমার সিংহ বলে শনাক্ত করেন।
সাবির বুমকে বলেন, "সে দু'টি ফেসবুক প্রোফাইল তৈরি করেছে – একটি রাজপুত আমন প্রিয়দর্শী নামে আর অন্যটি শালু কুমার সিংহ নামে। ও আমার বোনকে খুন করেছে। আমি দেখেছি, গুলনাজ খাতুন হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে শালু কুমার সিংহের ছবি শেয়ার করা হচ্ছে। কিন্তু এটি সঠিক নয়।"
আমন ওরফে শালুকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে, সাবির বলেন, সে এখনও গ্রেফতার হয়নি।
বুম মহনার থানার সঙ্গে যোগাযোগ করলে, সংশ্লিষ্ট আধিকারিক কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
এর পর আমরা আমন কুমার সিংহের ফেসবুক প্রোফাইলের খোঁজ করি মৃতার ভাই সাবিরের আমাদেরকে পাঠানো স্ক্রিনশট থেকে। যাদিও আমরা প্রোফাইলটি দেখতে পাইনি। সম্ভবত সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আমরা অবশ্য বজরং দল মহনার নামের একটি অ্যাকাউন্টের সন্ধান পাই। তাতে আমন সিংহ ওরফে শালু সিংহ-এর ছবি শেয়ার করা হয়েছিল।
ছবিতে যে ফোন নম্বর দেওয়া ছিল, তাতে যোগাযোগ করা যায়নি।
এরপর বুম বজরং হল মহনার ফেসবুক পেজ থেকে আরও কিছু ব্যক্তির নাম ও ফোন নম্বর বের করে। ভাইরাল ছবিটি সম্পর্কে আরও জানতে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে বুম।
অন্তত দু'জনের সঙ্গে আমরা কথা বলে জানতে পারি ভাইরাল ছবিটি যে আমন ওরফে শালুর, সে বিষয়ে তাঁরা নিশ্চত করেন আমাদের।
ফেসবুক পেজ বজরং মহনার-এ যে ছবি রয়েছে এবং গুলনাজের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে যে ছবিটি শেয়ার করা হচ্ছে, তাদের মুখ সফটওয়্যারের সাহায্যে মিলিয়ে দেখি। তাতে দেখা যায় যে, মুখের গঠনে ৯৯.২% মিলে যাচ্ছে।
তবে আমন সিংহ ওই প্রাক্তন পৌর প্রধানের মেয়ের খুনের সঙ্গে যুক্ত ছিল কিনা, বুম তা স্বাধীনভাবে যাচাই করেনি।
আরও পড়ুন: কর্নাটকে ভয়াবহ অগ্নিদ্বগ্ধ এক যুবতীর দেহ উত্তরপ্রদেশের ঘটনা বলে ভাইরাল