১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে সুদর্শন টিভি দ্বারা সম্প্রচারিত একটি বুলেটিনের কিছু গ্রাফিক্স সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। সেই সঙ্গে বিভ্রান্তিকর দাবিতে বলা হয়েছে যে, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় মুসলমানদের বাড়তি সুবিধে দেওয়া হচ্ছে।
বুম দেখে 'ইউপিএসসি জিহাদ পর অব তক কা সবসে বড়া খুলাসা' (ইউপিএসসি জিহাদ সংক্রান্ত এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পর্দাফাঁস) শোতে ওই চ্যানেলের প্রধান সম্পাদকের বেশ কিছু দাবি মিথ্যে।
এর আগে, ২৮ অগস্ট ওই দক্ষিণপন্থী চ্যানেলে 'বিন্দাস বোল' নামের এক বিতর্কিত প্রোগ্রামের সম্প্রচার দিল্লি হাই কোর্ট বন্ধ করে দেয়। তাতে দাবি করা হয়েছিল সেটি 'ইউপিএসসি জিহাদ বা ভারতের আমলাতন্ত্রে মুসলমানদের অনুপ্রবেশের চক্রান্ত উদ্ঘাটন করেছে। জামিয়া মিলিয়া ইউনিভারসিটির ছাত্রদের করা আবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্ট ওই আদেশ দেয়। বিতর্কিত বলে চিহ্নিত ওই 'বিন্দাস বোল' এপিসোডটি সেদিন সন্ধ্যে ৮টার সময় সম্প্রচারিত হওয়ার কথা ছিল।
সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ৪৯ সেকেন্ডের ক্লিপের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট, এপিসোডটির ক্ষেত্রে সম্প্রচারের আগে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে রাজি হয় না। দশ পর্বের সিরিজের ওই এপিসোডটি ১১ সেপ্টেম্বর সম্প্রচারিত হয়। কিন্তু পরে, ১৫ সেপ্টেম্বর, সুপ্রিমকোর্ট বাকি ছ'টি পর্বের সম্প্রচার সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়।
ওই এপিসোডে সুরেশ চাভাঙ্কে অভিযোগ করেন যে, ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের কাজে স্বচ্ছতার অভাব আছে এবং পরীক্ষর্থীদের নির্বাচন করার ব্যাপারে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমান প্রার্থীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে।
ইউটিউব-এ সুদর্শন নিউজ চ্যানেলে ওই সিরিজের যে চারটি পর্ব রয়েছে, বুম সেগুলি দেখে এবং সেগুলির গ্রাফিক্সে দেওয়া তথ্য ও দাবিগুলির সত্যতা যাচাই করে।
দাবি-১
মুসলমান প্রার্থীদের বয়স সীমায় ছাড়
হিন্দিতে লেখা এই গ্র্যাফিক্সে বলা হয়েছে: "বয়স সীমার সুবিধে সংক্রান্ত প্রশ্ন: ইউপিএসসি-তে হিন্দুদের জন্যে ঊর্ধ্ব বয়স সীমা ৩২ বছর। ইউপিএসসি-তে মুসলমানদের জন্য ঊর্ধ্ব বয়স সীমা ৩৫ বছর।"
এ বছর ১২ ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া সিভিল সার্ভিসের (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি আমরা ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে দেখে নিই। ওই বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট বলা আছে যে, জেনারেল বা সাধারণ বিভাগের ঊর্ধ্ব সীমা হল ৩২ বছর (১ অগস্ট ২০২০ তারিখে)। বিজ্ঞপ্তিতে তফসিলি জাতি/উপজাতি ও ওবিসি বা অন্যান্য পিছিয়ে-পড়া গোষ্ঠীর জন্য বয়সের ঊর্ধ্ব সীমায় ছাড়ের কথা বলা আছে।
• তফসিলি জাতি উপজাতিদের জন্য ঊর্ধ্ব বয়স সীমা পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়ানর কথা বলা আছে। অর্থাৎ, ওই বিভাগের প্রার্থীরা ৩৭ বছর বয়স পর্যন্ত ওই পরীক্ষায় বসতে পারেন।
• ওবিসি-দের ক্ষেত্রে তিন বছর পর্যন্ত ছাড়ের কথা বলা আছে। তার মানে, ৩৫ বছর পর্যন্ত ওই ক্যাটেগরি বা বিভাগের প্রার্থীরা ওই পরীক্ষা দিতে পারবেন।
তাছাড়া তফসিলি জাতি/উপজতি ও ওবিসি, যাঁরা অন্য তালিকার মধ্যেও পড়েন, যেমন প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রাক্তন সদস্য বা প্রতিবন্ধী, তাঁরা ঊর্ধ্ব বয়স সীমার ক্ষেত্রে 'কিউমুলেটিভ' ছাড় পা্বেন।
যে সব প্রার্থীরা একাধারে মুসলমান ও ওবিসি, তাঁদের জন্য আলাদা করে কোনও কিউমুলেটিভ ছাড়ের কথা বলা নেই ওই বিজ্ঞপ্তিতে। ধর্মের ভিত্তিতে বয়স সংক্রান্ত কোনও সুবিধ দেওয়ার কথা বলা নেই তাতে।
দাবি-২
প্রশিক্ষণের অঙ্গ হিসেবে মেকি ইন্টারভিউতে প্রশ্নকারক বলছেন মুসলমাদের প্রতি 'আলাদা আচরণ' করা হয়
প্রথম পর্বের ২০ মিনিটের মাথায়, সুরেশ চাভাঙ্কে একটি মেকি ইন্টারভিউ দেখান, যেটি সিভিল সার্ভিস-এর জন্য প্রশিক্ষণের অংশ।
হিন্দিতে উনি বলেন, "আমি আপনাদের একটি মেকি ইন্টারভিউর ভিডিও দেখাব। এটি একটি সাজান ইন্টারভিউ। আমি একবারও দাবি করছি না যে এটি আসল। প্রস্তুতির জন্য এই রকম একাধিক ইন্টারভিউর আয়োজন করা হয়। সে রকমই একটি ইন্টারভিউ এটি, যেটি সোশাল মিডিয়ায় রয়েছে। এটা আমার নয়। যদি আমি এই ইন্টারভিউ নিতাম তাহলে আপনারা বলতেন আমি ব্যাপারটা সাজিয়েছি।
(হিন্দি বয়ান:एक मॉक इंटरव्यू का मैं आपको वीडियो दिखाता हूँ | ये मॉक है, मैं दावा नहीं कर रहा हूँ की ये कोई असली इंटरव्यू है | तैयारी के लिए ऐसे तमाम इंटरव्यूज लिए जाते हैं ऐसा ही एक सोशल मीडिया पर इंटरव्यू है, मेरा नहीं है, अगर मैं लेता तो आप कहते की ये मैनेज किया हुआ है। )
ওই সাজানো ইন্টারভিউর ভিত্তিতে সুরেশ চাভাঙ্কে আবার প্রশ্ন তোলেন। উনি জানতে চান যে, কেন প্রার্থীকে বলা হচ্ছে যে তাঁর ইন্টারভিউ স্পেশ্যাল হবে? "এটি কি কোনও এক সম্প্রদায়কে বেশি নম্বর দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত," উনি জানতে চান।
রিভার্স সার্চ করলে দেখা যায় যে, ওই একই মেকি ইন্টারভিউ আইএএস কোচিং সেন্টার 'দৃষ্টি আইএএস' ইউটিইব চ্যানেলে এবছর ২২ অগস্ট আপলোড করা হয়। সেটি আইএএস পরীক্ষার প্রশীক্ষণ দেওয়ার একটি বেসরকারি অ্যাকাডেমি।
ইন্টারভিউর শেষের দিকে, ৩০.৪৩ সময়চিহ্নের মাথায়, প্রার্থীকে পরামর্শ দেওয়ার সময়, প্রশ্নকর্তা সেই একই কথা বলেন যা চাভাহাঙ্কের শোতে বলতে শোনা গিয়েছিল।
এই হল প্রশ্নকর্তার বক্তব্যের পুরো বয়ান, "আপনার ইন্টারভিউ কোনও সহজ ইন্টারভিউ নয়। আপনার ইন্টারভিউ কোনও সহজ সাধারণ ইন্টারভিউ নয়, এ কথা মনে রেখেই প্রস্তুত হন। এর কিছু কারণ আছে। প্রথমত আপনার বয়স আর দ্বিতীয়ত আপনার ধর্ম। খুব কম মুসলমান প্রার্থী আছেন, আর প্রত্যেককে একই কথা বলি। এর সুবিধে, অসুবিধে দুইই আছে। এ কথা জেনেই যাবেন।"
দাবি-৩
একাধিকবার পরীক্ষায় বসার প্রশ্ন
হিন্দিতে লেখা গ্রাফিক্সটি অনুবাদ করলে মানে দাঁড়ায়, "একধিকবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ: ইউপিএসসি-তে হিন্দুদের জন্য ৬ বার। মুসলমানদের জন্য ৯ বার।
এ বিষয়ে, ফেব্রুয়ারি মাসে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিটি বুম আবার দেখে নেয়।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে:
• সাধারণ তালিকার প্রার্থীরা ৬ বার পরীক্ষা দিতে পারবে
• তফসিলি জাতি/উপজাতির প্রার্থী যাঁরা এই পরীক্ষায় বসার যোগ্য, একাধিকবার পরীক্ষায় বসার ক্ষেত্রে এই সীমাবদ্ধতা তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়
• ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত প্রার্থীরা ৯ বার পরীক্ষায় বসতে পারবেন
সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় একজন প্রার্থী কতবার বসতে পারবেন তা ঠিক করার ক্ষেত্রে ধর্মের বিষয়টি বিবেচিত হয়নি।
দাবি-৪
ইউপিএসসি পরীক্ষা পাস করার ব্যাপারে সরকারী সাহায্য
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রার্থীদের জন্য 'নয়া উড়ান' প্রকল্পকে চাভাহাঙ্কে বেঠিকভাবে 'উড়ান যোজনা' বলেছেন।
মুসলমান প্রার্থীদের যে সব সুবিধে দেওয়া হয়, সেগুলির কথা বললেও, ওই প্রকল্পের বাকি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি উল্লেখ করেননি।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিষয়ক মন্ত্রকের ওয়েবসাইট দেখে বুম এ বিষয়ে আরও জানতে পারে।
ওয়েবসাইটে পরিষ্কার বলা আছে যে, একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রার্থী সুবিধেটি একবারই পাবেন। ন্যাশনাল কমিশন মাইনরিটিস অ্যাক্টে, ১৯৯২-এর ২(সি) ধারায় মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন ও পার্সিদের সংখ্যালঘু বলে গণ্য করা হয়েছে।
নয়ী উড়ান প্রকল্পটি কেবল তাঁদের জন্যই প্রযোজ্য যাঁরা ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন, স্টাফ সিলেকশান কমিশন ও স্টেট পাবলিক সার্ভিস কমিশন দ্বারা পরিচালিত প্রিলিমিনারি বা প্রাথমিক পরীক্ষায় পাস করার পর মূল পরীক্ষায় বসতে চলেছেন।
দাবি-৫
মুসলমানদের 'সাহায্য' করার জন্য মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মুসলমানদের জন্য কোচিং সেন্টার
ওই শো'র ৫৫.৩৪ সময়চিহ্নে, সুরেশ চাভাঙ্কে বলেন যে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য পাঁচটি কোচিং সেন্টার খোলার ব্যবস্থা করেন। সেগুলি আলিগড় মুসলিস ইউনিভারসিটি, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভারসিটি, জামিয়া হামদর্দ ইউনিভারসিটি, মৌলানা আজাদ ন্যাশনাল উর্দু ইউনিভারসিটি ও ভিমরাও আম্বেডকার ইউনিভারসিটিতে স্থাপিত হয়।
চাভাঙ্কে প্রশ্ন তোলেন যে, ওই ধরনের কোচিং সেন্টার কেন মুম্বাই ইউনিভার্সিটি বা চেন্নাইয়ে কোনও অ-মুসলিম ইউনিভারসিটিতেও খোলা হয়নি।
কিন্তু কিছু রিপোর্ট বুমের নজরে আসে যাতে বলা হয় যে, সংখ্যালঘু, তপসিলি জাতি/উপজাতি ও মহিলাদের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া নিঃখরচায় আবাসিক কোচিংযের ব্যবস্থা করেছে। মে ২০১৯-এ জেএমআই-এর ওয়েবসাইটেও এই মর্মে একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
তাছাড়া আরও কিছু রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, সিভিল সার্ভিস সহ অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য কোচিং নেওয়ার ক্ষেত্রে, দিল্লি সরকার তফসিলি জাতি, ওবিসি ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল প্রার্থীদের আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে।
হিন্দুস্থান টাইমস-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে, 'জয় ভিম মুখ্যমন্ত্রী প্রতিভা বিকাশ প্রকল্প'-এ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীরা সাহায্য পেতে পারে। ওই পরীক্ষাগুলির মধ্যে আছে ইউপিএসসি, দিল্লি সাবরডিনেট সার্ভিস সিলেকশান বোর্ড, স্টাফ সিলেকশান কমিশন, রেলওয়ে রেক্রুটমেন্ট বোর্ড এবং ব্যাঙ্ক ও বিমা কম্পানিগুলির পরীক্ষা।
এ ছাড়াও ভারত সরকারের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন দপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় যে, তফসিলি জাতি ও ওবিসি পড়ুয়াদের জন্য বিনা খরচায় কোচিং দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে তারা। এমনকি অনুমোদিত কোচিং সেন্টারগুলির নামও তালিকাভুক্ত করা আছে।