১৫ জুন গালওয়ানে ২০ জন ভারতীয় সেনা, চিনের সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হওয়ার পর সোশাল মিডিয়ায় দাবি করা হচ্ছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের জামানা, বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের তুলনায় জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে বেশি সফল ছিল।
কিন্তু পরিসংখ্যানগত তথ্য-যাচাই করে দেখা গেছে যে, ওই সব পোস্টে যে সব পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলি বিভিন্ন অবিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে নেওয়া। অথচ সেগুলিকে কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন (সিআইসি) কিংবা সাউথ এশিয়ান টেররিজম পোর্টাল (এসএটিপি) থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বলে চালানো হয়েছে।
এসএটিপি-র দেওয়া পরিসংখ্যান ওই পোস্টগুলির ব্যবহৃত পরিসংখ্যানের সঙ্গে মেলে না, আর সিআইসি-তে তো সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান আইনত এক্তিয়ারের বাইরে।
ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, ''মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রীত্বকালে ১০ বছরে ১৭১ জন সেনা'' প্রাণ হারিয়েছেন। আর নরেন্দ্র মোদীর আমলে, ''৬ বছরে ১৮৬৭ জন শহিদ হয়েছেন।''
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মাসে পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যুর পর থেকেই কিছু কংগ্রেসী সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেল থেকে একই ধরণের প্রচার হয়েছিল। তার মধ্যে একটি হ্যান্ডেল তো কর্নাটকের যুব কংগ্রেসের শাখার একেবারে নিজস্ব।
Now You Decide India is Never been Safe Under Bjp or Modhi government..
— IYC Darshan Ulli (@IYCDarshanulli) March 11, 2019
#ಅಬ್_ಕೀ_ಬಾರ್_ಬದಲೋ_ಚೌಕಿದಾರ್ pic.twitter.com/kVcm1386Zq
টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
প্রক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহের অনুরাগী ফেসবুক পেজ থেকেও একই তথ্যের গ্রাফিক্স শেয়ার করা হয়ছিল সে সময়।
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
পোস্টগুলিতে দাবি করা হয়েছে, ২০০৯-২০১৪ পর্যন্ত ইউপিএ-২ জমানায় পাকিস্তান থেকে সীমান্তে সংঘর্ষ-বিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা কম ঘটেছে, জঙ্গি হামলার ঘটনাও কম ঘটেছে। এবং সামরিক বাহিনী ও অসামরিক জনসাধারণের মধ্যে নিহতের সংখ্যাও অনেক কম থেকেছে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার তুলনায়। তথ্যের সূত্র হিসাবে পোস্টগুলি এসএটিপি(ফেসবুক পোস্টের ক্ষেত্রে) এবং সিআইসি-র (টুইটগুলি) উদ্ধৃত করেছে।
আরও পড়ুন: সেনাবাহিনীর উদ্দেশে ইন্দিরা গাঁধীর ভাষণের ভাইরাল ছবিটি গালওয়ানের নয়
তথ্য যাচাই
পরিসংখ্যানগুলো কেন ভুয়ো, তার ৩টি কারণ:
প্রথম কারণ: এর উৎসগুলি পরস্পর সম্পর্কহীন
সংঘর্ষবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের সংখ্যাগুলি সঠিক নয় এবং সেগুলি নেওয়া হয়েছে জম্মু-কাশ্মীরের কিস্টওয়ার জেলার একটি ট্রাফিক পুলিশ অভিযানের রিপোর্ট থেকে।
২০১৯-এর ৭ ফেব্রুয়ারি কিস্টওয়ার জেলার ওই পুলিশি অভিযানে ৫৫৯৬টি চালান ইস্যু হয় এবং ৫৫৩টি গাড়ি বাজেয়াপ্ত হয়। স্থানীয় গণমাধ্যমে এই নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দ্য ডেইলি এক্সেলসিয়র-এর প্রতিবেদন পড়া যাবে এখানে।
গ্রেটার জম্মু নামে একটি দৈনিকেও এই বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
বুম জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের কাছে এই অভিযানটির ব্যাপারে ২০১৯ সালে জানতে চাইলেও কোনও সদুত্তর পায়নি।
দ্বিতীয় কারণ: কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন (সিআইসি) সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে কোনও তথ্য রাখে না
ভাইরাল হওয়া ভুয়ো পোস্টগুলিতে সিআইসি থেকে এই সব তথ্য পাওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু সিআইসি বা তার রাজ্য শাখাগুলির এই সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য বা পরিসংখ্যান রাখার কোনও এক্তিয়ার নেই। সংঘর্ষ-বিরতি চুক্তি লঙ্ঘনই হোক বা সন্ত্রাসবাদী হামলা, এ সংক্রান্ত তথ্য ও পরিসংখ্যান থাকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে। তা ছাড়া এসএটিপি-ও স্বাধীনভাবে এই বিষয়ে তথ্য জমা রাখে।
তথ্য কমিশনগুলি হল তথ্য জানার অধিকার আইনে (২০১৫) প্রতিষ্ঠিত সংস্থা। আইনের পঞ্চম অনুচ্ছেদে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক স্তরে কমিশনের ক্ষমতা ও এক্তিয়ার বিষয়ে বলা আছে। কেউ যদি কমিশনের কাছে কোনও প্রতিকার চায়, তাহলে তার এক্তিয়ার আছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ডেকে পাঠানোর, সাক্ষ্য গ্রহণের এবং যে-কোনও অফিস বা আদালত থেকে নথি চেয়ে আনিয়ে তা পরীক্ষা করার।
আইনটির ২০০৫ সালের বয়ানটি তথ্যের অধিকার বিষয়ক ওয়েবসাইটে দেখা যেতে পারে এখানে।
তৃতীয় কারণ: তথ্য এই সংখ্যাগুলিকে প্রমাণ করে না
পোস্টগুলিতে দেওয়া পরিসংখ্যান যে সঠিক নয়, সেটা প্রমাণ করতে আমরা দুটি উৎস ব্যবহার করছি।
এসএটিপি কী বলছে
সামরিক ও অসামরিক নিহতের সংখ্যা:
এসএটিপি ১৯৯৪ সাল থেকে যে ধারাবাহিকভাবে পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে রেখেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে সে জায়গায় মাত্র ২০১৪ সাল থেকে পরিসংখ্যান ধরা আছে।
- ২০০৯-১৩ ইউপিএ-২ জমানায় ২,৬৪৩ জন অসামরিক ব্যক্তি এবং ১,৩২৮ জন নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়, ভাইরাল পোস্টগুলিতে যে সংখ্যাটা দেখানো হয়েছে যথাক্রমে মাত্র ১২ ও ১৪৯
- ২০১৪-১৯ এনডিএ জামানায় ১,২২৭ জন অসামরিক ব্যক্তি এবং ৮৫১ জন নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়, সেখানে ভাইরাল পোস্টের দাবি সংখ্যাদুটি যথাক্রমে ২১০ ও ৪৮৩
যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের তথ্য
নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সীমান্তে গুলিগোলা চলাকেই এসএটিপি সংঘর্ষবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের ঘটনা হিসাবে শনাক্ত করে এবং এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান তারা সংগ্রহ করে লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিভিন্ন প্রশ্নোত্তর থেকে এবং জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভাকে দেওয়া একটি প্রতিবেদন থেকে। এ কথা ঠিক যে, ভাইরাল পোস্টে উদ্ধৃত পরিসংখ্যান সঠিক নয়, তবে এটাও ঠিক যে, ইউপিএ জমানার তুলনায় এনডিএ জমানায় সীমান্তে সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা সংখ্যায় বেশি।
যেমন ২০১৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি এসএটিপি-র সাপ্তাহিক রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়, এই সপ্তাহে এ ধরনের লঙ্ঘনের ঘটনা বিগত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বাধিক।
পাকিস্তানের দ্বারা সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন
এই তথ্য থেকে স্পষ্ট:
- ২০১৯-১৩ দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় ৬২৮ টি সংঘর্ষ-বিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে
- ২০১৪-১৯ এনডিএ জামানায় ৩,০৪১ টি সংঘর্ষ-বিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে
সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া পোস্টের কোনও পরিসংখ্যানই এসএটিপি-র সংখ্যাতত্ত্বের সঙ্গে মেলে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য কী বলছে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তিনটি ক্ষেত্রে জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীদের মোকাবিলার তথ্য সঞ্চয় করে। রিপোর্টটি পড়া যাবে এখানে।
- জম্মু-কাশ্মীর
- অতি বাম সন্ত্রাসবাদ
- উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহ
ভারতে সন্ত্রাসবাদ
এক ঝলকে
- এই তথ্য দেখায় যে:
- দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় (২০০৯-১৩) হিংসার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে ১৪,৯৫৩ টি
- এনডিএ জামানায় (২০১৪-১৯) হিংসার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে ৭, ৯৭৯ টি
এসএটিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দেওয়া তথ্যই সাধারণত অনুসরণ করে, যেহেতু তাদের তথ্য সংগ্রহের ভিত্তি প্রধানত মিডিয়া এবং অন্যান্য পরোক্ষ উৎস, আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পুলিশ ও অন্যান্য সরকারি বিভাগ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।
এর আগে বুম প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের একটি বিবৃতির তথ্য যাচাই করেছিল, যখন তিনি দাবি করেছিলেন, ২০১৪ সালের পর থেকে ভারতে কোনও বড় মাপের সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা ঘটেনি।
Defence Minister Nirmala Sitharaman at BJP National Convention in Delhi: We have not had one major terrorist attack in this country after 2014. This govt under the leadership of PM Modi has ensured one thing that there shall not be an opportunity for terrorists to disturb peace. pic.twitter.com/qWehbpZkFd
— ANI (@ANI) January 12, 2019
- এই তথ্য-যাচাইটি পড়া যাবে এখানে।