সাতাশ বছর বয়সী অভিনেত্রী মিষ্টি মুখার্জি বেঙ্গালুরুর রেনাল ফেইলিওর হয়ে মারা গেলেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তাঁর পরিবার কিডনি ফেইলিওর এবং মৃত্যুর জন্য প্রয়াত অভিনেত্রীর কিটোজেনিক ডায়েটকে দায়ী করেছেন।
কিটোজেনিক ডায়েট ওজন কমানোর খুব কার্যকরী উপায় হিসাবে জনপ্রিয় হয়েছে। এই ডায়েটে বেশি ফ্যাট এবং কম কার্বোহাইড্রেট খাওয়া হয়। বহু বিখ্যাত ব্যক্তি ওজন কমানোর জন্য এই ডায়েট মেনে চলেন। কেটো ডায়েটের বিভিন্ন দিকগুলি জানার জন্য বুম ডায়েটিসিয়ান গীতা শেনয়ের সঙ্গে কথা বলে। গীতা মুম্বইয়ের চেম্বুরে তাঁর নিউট্রিশন অ্যান্ড ওয়েলনেস ক্লিনিক চালান।
প্রথম দিকে এই ডায়েট একটি মেডিক্যাল নিউট্রিশনাল থেরাপি হিসাবে দেওয়া হত। এই ডায়েটে খুব দ্রুত ওজন কমায় বলে এই ডায়েট তাড়াতাড়ি মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়।শেনয় জানান, "মেডিক্যাল নিউট্রিশনে এপিলেপ্সি বা অ্যালজাইমার্সের মত অসুখে যেখানে নিউরোট্রান্সমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেখানে চিকিৎসকরা কিটোজেনিক ডায়েটের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।"
এই ডায়েট ওজন কমাতে সাহায্য করে আর তাই বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার থেরাপির চেয়ে ওজন কমানোর উদ্দেশ্যেই এই ডায়েট বেশি ব্যবহার করা হয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ডায়েটিসিয়ান জানিয়েছেন, এই ডায়েট শুধু স্বল্প সময়ের জন্য কার্যকরী নাকি এর দীর্ঘমেয়াদী উপকারিতা আছে তা নিয়ে এখনও গবেষণা হওয়া দরকার।
কিটো ডায়েট কি?
কিটোজেনিক ডায়েট কথাটি কেটোসিস শব্দ থেকে এসেছে। কিটোসিস হল শরীরের একটি এনার্জি ও মেটাবলিসম পাথওয়ে। এতে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা, যেগুলি শরীরের এনার্জির প্রধান উৎস যেমন শস্যদানা, ডাল এবং গ্লুকোজ (চিনি), গ্রহণ করা একেবারে কমিয়ে দিতে হয় এবং গ্লুকোনেজেনেসিস বা কেটোসিস পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। শর্করা, যা গ্লুকোজ তৈরি করে, শরীরে তার অভাব হওয়ার ফলে শরীর এনার্জির চাহিদা পূরণ করার জন্য অন্য মলিকিউল খুঁজে নেয়।
গ্লুকোনেজেনেসিস পদ্ধতিতে শরীর গ্লুকোজ তৈরির জন্য অন্য অ-শর্করা খাদ্যের উপর নির্ভর করে। শরীর তার ফলে জমা হওয়া ফ্যাটি অ্যাসিডের উপর নির্ভর করে। এই ফ্যাটি অ্যাসিড লিভারে কেটনসে ভেঙে যায়। যেহেতু শরীরের এনার্জির চাহিদা পুরণ করতে যে ফ্যাটযুক্ত খাবার খাওয়া হয় তা ক্রমাগত ভাঙ্গতে থাকে, তার ফলে ওজন খুব দ্রুত কমে যায়। স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম, বিভিন্ন বীজ, অ্যাভোকাডো এবং মাছ— এই সব খাবারে প্রচুর ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে।
এই ডায়েট অনুযায়ী চলতে গিয়ে শরীরের অনেক প্রয়োজনীয় উপাদানের অভাব দেখা দেয়। এই ডায়েট খুব কঠিন এবং শরীরের বিভিন্ন ক্ষতিও করতে পারে— তাই যাঁরা এই ডায়েট অনুসরণ করেন, তাঁদের খুব নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়।
শেনয় জানিয়েছেন, "এই ডায়েটের মূল কথা হল খাবার খাওয়া একদম নিয়ম মেনে করতে হবে। নিয়মের বাইরে একেবারেই যাওয়া যাবে না। যেসব খাবার উপকারী নয়, সেরকম খাবার খাওয়া যাবে না। যাঁরা এই ডায়েট মেনে চলবেন, তাঁদের নানারকম সাপ্লিমেট খেতে হবে, যেমন মাল্টিভিটামিনস এবং ফাইবারযুক্ত খাবার, যা ডায়েটের সমতা বজায় রাখতে পারে।"
কিটো ডায়েট শুরু করার আগে যেসব পদক্ষেপ জরুরি
শেনয় খুব জোর দিয়ে জানিয়েছেন যে, এই ডায়েট শুরু করার আগে শরীর এবং রক্তের সমস্ত পরীক্ষা করে এই ডায়েটের কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া উচিত।
শেনয় বলেছেন, "যাঁরা এই ডায়েট করবেন, তাঁদের প্রতি পদক্ষেপে খুব ভাল করে পরীক্ষা করে দেখা হয়। যাঁদের ইউরিক অ্যাসিড, উচ্চ কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ, টাইপ ১ ডায়বেটিস ইত্যাদি আছে, বা গর্ভবতী মহিলা বা যাঁরা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ান, তাঁদের এই ডায়েট করতে নিষেধ করা হয়।"
যাঁদের কোমর্বিডিটি আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই ডায়েট ক্ষতিকারক হতে পারে। আবার এই ডায়েট হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। শেনয় জানান, "যাঁদের টাইপ ২ ডায়বেটিস বা পিসিওডি আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই ডায়েট খুব ভাল কাজ দিতে পারে।"
বিভিন্ন স্টাডি থেকে জানা গেছে লো-কার্ব এবং কিটোজেনিক ডায়েট মেনে চলা লোকেদের মধ্যে মৃত্যুর হার কম এবং ওষুধ বন্ধ করে দিয়েও ডায়বেটিস রোগীরা ভাল থাকতে পারেন।তবে, এই গবেষণাগুলির অধিকাংশ বিতর্কিত। যেমন, একটি অত্যন্ত পরিচিত স্টাডি, প্রস্পেক্টিভ আরবান রুরাল এপিডেমিওলজি, যাতে মোট ১৮টি দেশে সমীক্ষা করা হয়েছিল, এবং স্টাডিটি লো-কার্ব ডায়েটের পক্ষে কথা বলেছিল,সেই গবেষণাটি ছিল শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণমূলক।
অভিনেত্রী মুখার্জির মৃত্যু বিষয়ে শেনয় কথা বলতে অস্বীকার করেন, কারণ তিনি এই অভিনেত্রীর বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে কিছু জানেন না। তবে তিনি জানান, কোনও অন্তর্নিহিত কারণ না থাকলে কিটো ডায়েটে এমন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা কম।
শেনয় আরও জানিয়েছেন, "অনেকেই হাই ফ্যাট ডায়েটকে হাই প্রোটিন ডায়েট ভেবে বেশি প্রোটিন খেয়ে ফেলেন। তার ফলে কিডনির খুব ক্ষতি হতে পারে।" পনীর, মাংস, ডিম খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশি ফ্যাট যুক্ত খাবার যেমন অলিভ, অ্যাভোকাডো, আমন্ড অয়েল এবং বাদাম জাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়া দরকার।
দ্রুত ওজন কমানোর বিবিধ সমস্যা
যেহেতু আচমকা শরীরে কার্বোহাইড্রেটের অভাব ঘটে, তাই শুরুতে অনেকের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয়। "খাবার মানুষকে একরকম আরাম দেয়। এই ডায়েট চলার সময় সেই ফিল গুড ফ্যাক্টরটা চলে যায়। যেমন আমরা জানি চিনি বা চিনি জাতীয় খাবার দ্রুত এনার্জি দেয়। শুরুতে মাথা ঘোরানো, বুঝতে না পারা, মনোযোগের অভাব হতে পারে তবে এগুলো সবই সাময়িক এবং পরে আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যায়।"
এছাড়া, কিটো ডায়েট খুব অল্প সময়ের জন্যই মেনে চলা যায়। কার্বোহাইড্রেটসহ স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসে ফেরার জন্য উপযুক্ত গাইডেন্স এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। যদি এগুলি ঠিক ভাবে না মানা হয়, তবে যে ওজন ডায়েট চলার সময় কমে গিয়েছিল তা আবার বাড়তে পারে। শেনয় ব্যাখ্যা করে জানিয়েছেন, "এই ডায়েট বন্ধ করাটা ধীরে ধীরে করা উচিত এবং তা ঠিক ভাবে লক্ষ্য রাখা দরকার। তা না হলে ওজন আবার ফিরে আসতে পারে।"
ফাইবারযুক্ত খাবার এবং অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের অভাব মানুষকে পুষ্টি জোগানকারী খাবারের চেয়ে সাপ্লিমেন্টের উপর নির্ভরশীল করে দেয়। শেনয় শেষে আমাদের ওজন কমানোর বিভিন্ন কার্যকরী পদ্ধতির কথা বলেছেন যাতে ব্যালান্সড ডায়েটের সমস্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরীর পায়।"খাবারের পরিমাণ এবং ক্যালোরি নিয়ন্ত্রণ করার পুরানো পদ্ধতি হল ওজন কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায়। ভারতীয়দের ক্ষেত্রে ফাইবারযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া উচিত, তবে কার্বোহাইড্রেটস একেবারে বন্ধ করে দেওয়া উচিত নয়"।
বুম এর আগে ডায়েটিসিয়ান এবং নিউট্রিশনিস্ট জরনা শাহের সঙ্গে কেটজেনিক ডায়েটের ব্যাপারে আলোচনা করেছে।