ভারতের আয়ুষ মন্ত্রক করোনাভাইরাস প্রতিরোধের জন্য আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি ও ইউনানি চিকিৎসার বিধান দিয়েছে। কিন্তু অনলাইনে এই পরামর্শ পেয়ে নেটিজেনরা বিষয়টি খুব ভাল ভাবে নেননি। বহু নেটিজেন, এবং তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু চিকিৎসকও আছেন, এ ভাবে এই মারাত্মক ভাইরাসকে ঠেকানো যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য মন্ত্রক থেকে অনেকগুলি আয়ুর্বেদিক ওষুধের মিশ্রণ, হোমিওপ্যাথি ওষুধ এবং ইউনানি ভেষজ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো অফ ইন্ডিয়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করার জন্য টুইট করে হোমিওপ্যাথিক এবং ইউনানি ওষুধ ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এখনও করোনাভাইরাস প্রতিরোধ বা তার চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা নেই।
Advisory for #CoronaVirus
— PIB India (@PIB_India) January 29, 2020
Homoeopathy for Prevention of Corona virus Infections
Unani Medicines useful in the symptomatic management of Corona Virus infection
Details here: https://t.co/OXC7PtM7L3
পিআইবি এই টুইটের পর আরও একটি টুইট করে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে শ্বাসকষ্টজনিত উপসর্গ কমানোর জন্য যে হোমিওপ্যাথি এবং ইউনানি ওষুধ দেওয়া যেতে পারে, সেই টুইটে সেগুলিকে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
Advisory to recess the symptoms of respiratory tract in possible Corona virus infected cases
— PIB India (@PIB_India) January 29, 2020
Read the detailed advisory:https://t.co/hApX41NPx7
দুটি টুইটই বিপুল সমালোচনার মুখে পড়ে। এই ওষুধগুলির গুণগত মান বিষয়ে বেশ কয়েক জন চিকিৎসকসহ বহু নেটিজেন প্রশ্ন তোলেন।
This actually gets worse when you read the detailed press release. A host of ayurvedic, homeopathic and unani preparations, with an unknown adverse effect profile, are being advised to counter #CoronaVirus, based on what? A round table meeting of a group of AYUSH practicioners? https://t.co/sSn7CVwDZE
— The Zucker Doctor (@DoctorLFC) January 29, 2020
মন্ত্রকের পক্ষ থেকে কী ধরনের ওষুধের কথা বলা হয়েছে?
আয়ুষ মন্ত্রক কিছু আয়ুর্বেদিক, কিছু হোমিওপ্যাথি ও কিছু ইউনানি ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে। মন্ত্রকের মতে, এই ওষুধগুলি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সাহায্য করবে।
আয়ুর্বেদ
আয়ুর্বেদিক মতে যে সব পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, সেগুলি মূলত ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক। যেমন, সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধোওয়া, অসুস্থ ব্যক্তির বেশি কাছে না যাওয়া, থুথু ইত্যাদি থেকে হওয়া সংক্রমণ এড়ানোর জন্য এন৯৫ মুখোশ ব্যবহার করা ইত্যাদি। এর সঙ্গে দুটি সার্কুলারেই কিছু মিশ্রণ ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে, যেগুলি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা সাধারণ সর্দি-কাশির জন্য দিয়ে থাকেন।
তাঁরা শাদাঙ্গা পানীয় ও অগস্ত্য হরতকির মত বিভিন্ন মিশ্রণ ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন। এই সব মিশ্রণ বিভিন্ন ভেষজ থেকে তৈরি করা হয়েছে।
হোমিওপ্যাথি
২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি দ্য সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন হোমিওপ্যাথি-র (সিসিআরএইচ) সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইসরি বোর্ডের ৬৪তম সমাবেশ হয়। সেখানে তাঁরা করোনাভাইরাস আটকানোর জন্য নানান পরামর্শ দেন। তাঁরা আর্সেনিকাম অ্যালবাম ৩০ নামের একটি ওষুধ খালি পেটে তিন বার ব্যবহারের কথা বলেন। এটি আর্সেনিক ট্রাইঅক্সাইডের দ্রবণ থেকে তৈরি।
ইউনানি ওষুধ
আয়ুষ মন্ত্রক ইউনানি ওষুধের একটি তালিকাও দিয়েছে, যাতে শরবত উন্নাব, তির্যাক আরবা, তিরাক নজলা, চিরয়তা প্রভৃতি ওষুধ রয়েছে।
বৈঞ্জানিক প্রমাণ?
শাদঙ্গা পানীয় একটি আয়ুর্বেদিক ওষুধের মিশ্রণ, যা জ্বর নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে সর্দি-কাশিতে এর কার্যকারিতার কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। আয়ুর্বেদিক ওয়েবসাইটগুলিতে আরও বলা হয়েছে যে এই ওষুধ যেন অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের সঙ্গে ব্যবহার না করা হয়। অগস্ত হরিতকির সঙ্গেও করোনাভাইরাসের চিকিৎসার কোনও সম্পর্ক এখনও অবধি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রের বিভিন্ন জার্নালে ব্রঙ্কাইটিসের উপর এই ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে জানানো হয়েছে, ওষুধটি কাজ করবে কি না, তা নির্ভর করে ব্রঙ্কাইটিসের মাত্রার উপর।
হোমিওপ্যাথিক কাউন্সিল যে আর্সেনিকাম আলবাম ৩০ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে, তা সাধারণত সদ্য জন্মানো পশুশাবকদের ডায়েরিয়ার চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং কোনও সংক্রমণ সারানোর ক্ষেত্রে এই ওষুধের কোনও বৈজ্ঞানিক সংযোগ নেই। এ ছাড়া, এর মধ্যে আর্সেনিক ট্রাইঅক্সাইড ব্যবহার করা হয়, যা সঠিক ভাবে লঘুকৃত না হলে ব্যবহারকারীর ক্ষতি হতে পারে।
এ ছাড়া, ইউনানি ওষুধ যে এই ভাইরাসের আক্রমণ সারাতে পারে, তার কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
এই চিকিৎসা কী ভাবে কাজ করে, তা বোঝার জন্য বুম এক জন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ও এক জন অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ডঃ নিতিন কোচর মুম্বইয়ের এক জন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। তিনি জানান যে তিনি আর্সেনিক মিশ্রণ ব্যবহারের পরামর্শ দেবেন না, কারণ আর্সেনিক বিভিন্ন ব্যক্তির উপর আলাদা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তিনি বলেন, "অন্য ওষুধগুলির ব্যাপারে সবাই জানে, এবং সর্দি-কাশি সারাতে এগুলি ব্যবহার করা হয়। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে সংক্রমণ ঠেকানোর বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করাটাই নিরাপদ।"
এই সব ওষুধের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা বুঝতে বুম মুম্বইয়ের যশলোক হাসপাতালের সংক্রামক অসুখের বিশেষজ্ঞ ডঃ ওম শ্রীবাস্তবের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ডঃ শ্রিবাস্তব জানান, "এ সব ওষুধের প্রভাব সম্পর্কে আমি বলতে পারব না, কারণ আমি এই বিশেষ ধরনের চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত নই। কিন্তু এই সব চিকিৎসা যে সত্যিই ভাইরাস আটকাতে পারে, তার কিছু বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ চাই। অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে ভাইরাসের চিকিৎসা করা যাবে না, কারণ অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণুর বৃদ্ধি ঠেকায়।"
তিনি আরও জানান, যেহেতু এই নতুন ভাইরাসের কারণ এবং চিকিৎসা কিছুই জানা নেই, তাই নিজের হাত ধোওয়া এবং পরিস্কার রাখা এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী বলছে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই নতুন করোনাভাইরাস সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা বদলে দেওয়ার মতো অনেকগুলি বিষয় জানিয়েছে। এই সব প্রচলিত ধারণার মধ্যে একটি হল, করোনাভাইরাসের প্রতিরোধক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। তারা আরও জানিয়েছে যে কিছু চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে এখনও পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে এবং খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে নিশ্চিত ভাবে জানা যাবে। তারা আরও জানিয়েছে যে সংক্রমিত ব্যক্তির পর্যাপ্ত চিকিৎসা এবং যত্ন দরকার।
করোনাভাইরাস
এই নতুন করোনা ভাইরাস ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চিনের উহান প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ফলে প্রায় ৯১০ জনের মৃত্যু হয়। ৪০, ৫৭৪ জন করোনাতে সংক্রমণে হয়েছে (বর্তমান তথ্য দেখুন জনহপকিন্স-এ)। ভারতে করোনাভাইরাসের প্রথম আক্রান্তের খোঁজ পাওয়া যায় কেরলে। উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা হয়েছে।
ল্যান্সেটে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র অনুসারে এপিডেমিওলজিক্যাল এবং জেনোমিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এই ভাইরাস সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরাটরি সিন্ড্রোমের (এসএআরএস)সমগোত্রীয়। এই গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে যে যদিও বাদুড় এই ভাইরাসের প্রধান ধারক, কিন্তু উহানের সামুদ্রিক খাদ্যের বাজারের অন্য একটি জীবের মাধ্যমেও এই ভাইরাস মানুষের দেহে ছড়িয়ে থাকতে পারে।
এই নতুন ভাইরাস পুরানো এসএআরএস ভাইরাস থেকে ৭৯% এবং মিডল ইস্ট রেস্পিরাটরি সিন্ড্রোম (এমইআরএস) থেকে ৫০% আলাদা।