ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে রহস্যময় করোনোভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ করেছে। রোগের কেন্দ্র চিনে বসবাসকারী ভারতীয়রাও ভারত সরকারের কাছ থেকে নানা সহায়তা পাচ্ছেন।
চিনে ইতিমধ্যেই এই ভাইরাস ২০১৯-এনকভ ২৫ জন লোকের প্রাণহানি ঘটিয়েছে এবং অন্তত ৮০০ জন সেখানে এই জীবাণুর দ্বারা সংক্রামিত হয়েছে। প্রতিবেশী হংকঙ, ম্যাকাও, তাইল্যান্ড, তাইওয়ান, জাপান, কোরিয়া এমনকী সুদূর মার্কিন মুলুকেও এই ভাইরাসের দেখা মিলেছে।
চিনের হুবেই জেলার উহান শহরে হুনান সামুদ্রিক খাদ্যের বাজার থেকেই এই জীবাণু ছড়িয়েছে। শহরের ১ কোটি ১০ লক্ষ বাসিন্দাকেই অন্তরীণ করা হয়েছে। রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে এমন সময়ে, যখন চান্দ্র নববর্ষ উত্সব উপলক্ষে চিনে বহু মানুষ বাইরে থেকে চিনে আসে কিংবা চিন থেকে বাইরে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর বলে পরিচিত উহানে অন্তত ৫০০ ভারতীয় ছাত্র চিকিত্সা শাস্ত্র অধ্যয়ন করে। এদের মধ্যে ২৫ জন রোগাক্রান্ত না হয়েও গোটা শহরের অন্তরীণ অবস্থায় আটকে পড়েছে। উহান থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরের এক হাসপাতালে যে ১৪ জন ভারতীয় ছাত্র ইন্টার্নশিপ করছে, তারাও যত দ্রুত সম্ভব ভারতে উড়ে আসবে।
ভারত সরকার কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে
জরুরি হেল্পলাইন
ভারতীয় দূতাবাস একটি হটলাইন নাগালে এনে দিয়েছে, যার মারফত ভারতীয় ছাত্ররা দেশে তাদের আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে এবং আত্মীয়রাও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পার। করোনাভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে হুবেই জেলায় অধ্যনরত ছাত্রদের উদ্বিগ্ন আত্মীয়রা সরাসরি ছেলেমেয়েদর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে চেয়েছেl হেল্পলাইন নম্বরগুলি হল: +৮৬১৮৬১২০৮৩৬২৯ এবং +৮৬১৮৬১২০৮৩৬১৭। ভারতীয় ছাত্ররা যাতে পর্যাপ্ত খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী পায়, সে জন্য ভারতীয় দূতাবাস চিনা অধিকারিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে।
বিমানে যাতায়াত সংক্রান্ত নীতিনির্দেশ
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত ৪৩টি উড়ান এবং ৯১৫৬ জন যাত্রীকে পরীক্ষা করেছে। এ ছাড়াও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ১৭ জানুয়ারি চিনে যেতে ইচ্ছুক কিংবা চিন থেকে আগত যাত্রীদের জন্য একগুচ্ছ নীতিনির্দেশ জারি করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রক বিভিন্ন বিমানবন্দরে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রোগের উপসর্গ সম্পর্কে যাত্রীদের অবহিত করার দায়িত্ব নিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রক অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলেছে, যাতে যাত্রীদের পরীক্ষা করার কাজটি মসৃণভাবে সম্পন্ন হয়। উড়ান চলাকালীনও বিমানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ঘোষণায় রোগের লক্ষণ সম্পর্কে যাত্রীদের সচেতন করা হচ্ছে এবং তাঁরা যাতে নিজে থেকেই সে ধরনের লক্ষণের প্রকাশ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানান, সে ব্যাপারেও উত্সাহিত করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রস্তুতি
স্বাস্থ্য মন্ত্রক বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে রোগের প্রাদূর্ভাবের জন্য প্রস্তুত থাকার এবং জীবাণু সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যাপারে তত্পর হতে অনুরোধ করেছে। এটা নিশ্চিত করবে যে, সব রাজ্যই সংক্রমণের পরিস্থিতি ঘটলে তার মোকাবিলার জন্য তৈরি থাকে।
সরকার একটি যৌথ নজরদারি গোষ্ঠীও তৈরি করে দিয়েছে, যাতে চিন থেকে এই রোগের জীবাণু ভারতে আমদানি হলেই তত্ক্ষণাত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ভারতে এই রোগটির জীবাণুর সম্ভাব্য সংক্রমণের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মীদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ চালানো হচ্ছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি জানিয়েছে, তারা সবরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত। তা ছাড়া দ্রুত সাড়া দেওয়ার যে সব স্বাস্থ্যদলকে মধ্যপ্রাচ্যের শ্বাসকষ্টের সংক্রামক রোগের মোকাবিলায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তাদেরও রোগ শনাক্তকরণ, রোগের লক্ষণগুলি বোঝা এবং বিপজ্জনক এই ধরনের প্যাথোজেনের ছোঁয়াচ প্রতিরোধ প্রভৃতি কাজে নিয়োগ করা হয়েছে।
কত জন ভারতীয় এ পর্যন্ত সংক্রামিত হয়েছে
২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দুজনের দেহে নিউমোনিয়ার লক্ষণবিশিষ্ট সংক্রমণ দেখা দেয় এবং তাদের সঙ্গে-সঙ্গেই মুম্বইয়ের কস্তুরবা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওই দুজনকেই আলাদা করে রাখা হয়েছে এবং তাদের স্বাস্থ্যের উপর কড়া নজরদারি চালানো হচ্ছে।
চিনের শেনঝেন জেলাতেই সর্বপ্রথম ৪৫ বছর বয়সী এক ভারতীয় মহিলার দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। তাঁকে বর্তমানে শেনঝেন-এরই একটি হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
সৌদি আরবে কর্মরত ৩০ জন কেরলের নার্সকে সন্দেহ করা হচ্ছে ওই ভাইরাসের কবলে পড়েছেন। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন ওই নার্সদের বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করার জন্য বিদেশ মন্ত্রককে অনুরোধ জানিয়েছেন।
জেড্ডায় অবস্থিত ভারতীয় কনসুলেটের তরফে ভারতীয় বিদেশ দফতরের উপমন্ত্রী এম মুরলীধরনের জিজ্ঞাসার জবাবে জানানাো হয়েছে, ওই নার্সরা অন্য একটি ভাইরাসে আক্রান্ত, করোনাভাইরাসে নয়।
Dr Tarik Al Azraqi, Chairman, Scientific Regional Infection Control Committee, Aseer Region, has confirmed that d Indian Nurse being treated at Aseer National Hospital is suffering from MERS-CoV & not 2019-NCoV (Wuhan). We request everyone to refrain from sharing incorrect info.
— India in Jeddah (@CGIJeddah) January 23, 2020
ভাইরাসটি কতটা মারাত্মক?
কোন উৎস থেকে এই ভাইরাসের জন্ম, তা এখনও শনাক্ত করা যায়নি। তবে এটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রামিত হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনও এটিকে একটি আন্তর্জাতিক মহামারী বলে চিহ্নিত করেনি কারণ তাদের মতে এটি কেবলমাত্র চিনের একটি অঞ্চলের সমস্যা। এ ছাড়া অন্য দু-একটি দেশে কিছু রিপোর্ট পাওয়া গেছে। সংস্থার ডিরেক্টর সংক্রমণটিকে আন্তর্জাতিক স্তরে জরুরি স্বাস্থ্যসংকট ঘোষণা করার ক্ষেত্রে দ্বিধার কথা তাঁর টুইটে উল্লেখ করেছেন:
I am not declaring the new #coronavirus outbreak a public health emergency of international concern today. The Emergency Committee was divided over whether the outbreak represents a PHEIC. This is an emergency in China, but it has not yet become a global health emergency. https://t.co/16knaV4lMZ
— Tedros Adhanom Ghebreyesus (@DrTedros) January 23, 2020
বিজ্ঞানী ও গবেষকদের একাংশের মতে কিন্তু এই সংক্রমণের ঘটনার রিপোর্ট কমিয়ে দেখানো হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এই সংক্রমণ এখনও ২০০২ সালের অনুরূপ একটি ভাইরাসের সংক্রমণের তুলনায় সামান্যl যদিও সেই সঙ্গে এ ব্যাপারেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে যে সময় থাকতে যদি এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে এর ক্ষতিকর প্রভাবও সুদূরপ্রসারী হতে পারে।