ভারতের ড্রাগস কন্ট্রোলার জেনারেল (ডিসিজিআই) ডঃ ভি জে সোমানি সিরাম ইনস্টিটিউটকে আবার অক্সফোর্ড টিকা ট্রায়াল পুনরায় শুরু করার নির্দেশ দিল। কোভিড-১৯-এর কার্যকর ও নিরাপদ মোকাবিলার জন্য প্রতিষেধক তৈরির দৌড়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি এই টিকাটি অগ্রগণ্য।
ডিসিজিআই-এর তরফে সিরামকে এই ট্রায়ালের প্রতিটি ধাপে আরও যত্ন ও সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে বলা হয়েছে। সিরামকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ডিসিজিআই কার্যালয়কে যেন ব্যবহৃত ওধুষ ও ভবিষ্যতে তার কোনও পার্শপ্রতিক্রিয়া হবার সম্ভাবনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশদে জানানো হয়।
ব্রিটেনে একজন স্বেচ্ছাসেবকের শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার পরেই কোভিড-১৯ প্রতিষেধক টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থা অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকাটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ছিল গত সপ্তাহে।
বুম সেসময় আলাদা ভাবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে যোগাযোগ করে। একটি বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই এই পরীক্ষা বন্ধ করেছে এবং তদন্ত করে দেখছে, টিকার কারণেই ওই বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে কিনা। পরীক্ষামূলক প্রয়োগটি যাতে নিশ্ছিদ্র ও নিরাপদ হয়, সেটা নিশ্চিত করতেই এই স্থগিতাদেশ।
শনিবার সংস্থাটি আবার বিবৃতি দিয়ে জানায়, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় টিকার ট্রায়াল চালাবে। যুক্তরাজ্যের ওষুধ নিয়ামক সংস্থা টিকাটি নিরাপদ বলে ছাড়পত্র দেওয়ায় হঠাৎ স্থগিত হওয়া ট্রায়াল আবার চালু হল।
টিকাটির বিরূপ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ঠিক কী ছিল অ্যাস্ট্রাজেনেকা তা বিশদে জানাতে চায়নি গণমাধ্যমকে।
খবরটি প্রথম প্রকাশ্যে আনে স্ট্যাট নিউজ।
সিরামের ট্রায়াল স্থগিত করেছিল ভারত
অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা ট্রায়াল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলে বুম সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছে জানতে চায় পরবর্তী পদক্ষেপ কী, কেননা অ্যাস্ট্রাজেনেকার নজরদার গোষ্ঠী শীঘ্রই এই টিকার নিরাপত্তা খতিয়ে দেখবে। তাতে ইনস্টিটিউটের তরফে এক ই-মেল-এ জানানো হয়, ভারতে এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ আগের মতোই চালু থাকবে।
কিন্তু ভারতের টিকা স্বেচ্ছাসেবকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে ভারতের ড্রাগস কন্ট্রোলার জেনারেল ১১ সেপ্টেম্বর এক নির্দেশে ওই ট্রায়াল স্থগিতের নির্দেশ দেয় সিরামকে। শনিবারের নির্দেশে আবার সেই ট্রায়াল আগের মতই চলার ক্ষেত্রে আর কোনও বিধিনিষেধ রইল না।
ভারতে সিরাম ইনস্টিটিউট ১৭টি জায়গায় মোট ১৬০০ স্বেচ্ছাসেবকের উপর এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চালাচ্ছে।
একটি কোভিড-১৯ টিকা কিভাবে জাতির উপরে প্রভাব ফেলবে, জানতে হলে নিচের ভিডিওটি দেখুন।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা যা বললো
অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানালো, যে ব্যাপক আয়তনে এই পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চালানো হচ্ছে, তাতে স্বেচ্ছাসেবকদের কারও কারও শরীরে কিছু অসুস্থতা ঘটনাচক্রে দেখা দিতেই পারে, কিন্তু তবু সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া দরকার যে টিকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াই সেই অসুস্থতার কারণ কিনা। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই যাতে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কাজটি সম্পন্ন করে ফেলা যায়, সে জন্য দ্রুত পর্যালোচনার কাজটি হাতে নেওয়া হয়েছে।
তবে সন্দেহজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াটি ঠিক কী এবং কোন দেশের স্বেচ্ছাসেবকের ক্ষেত্রে তা লক্ষ্য করা গেছে, সে বিষয়ে সংস্থাটি বিস্তারিত কিছু জানায়নি। আশা করা হচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবকটি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এর একটি সূত্র জানাচ্ছে যে, ওই স্বেচ্ছাসেবকটি সম্ভবত ব্রিটেনে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দফার পরীক্ষার মধ্যে ছিলেন এবং টিকা নেওয়ার পর তাঁর স্পাইনাল কর্ডে ফুলে ওঠার লক্ষণ দেখা দেয়। অ্যাস্ট্রাজেনেকা নিশ্চিত হতে চায় যে টিকা নেওয়ার ঠিক পরেই এই লক্ষণটি পরিস্ফুট হয় কিনা।
যুক্তরাজ্যের ওষুধ নিয়ামক সংস্থা বা মেডিসিনস হেল্থ রেগুলেটরি অথরিটি সব দিক ক্ষতিয়ে দেখে টিকাটি নিরাপদ বলে ছাড়পত্র দেওয়ায় হঠাৎ স্থগিত ট্রায়াল আবার চালু হল।
যদিও যে কোনও ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের সময় মাঝপথে এ ধরনের স্থগিত হয়ে যাওয়ার ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক, তবু বর্তমানে ব্যাপক কালান্তক আকার ধারণ করা অতিমারীর প্রেক্ষিতে দেশে-দেশে তার প্রতিষেধক তৈরির রুদ্ধশ্বাস প্রয়াসগুলি এর ফলে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছে। সংক্রমিতের সংখ্যা ২ কোটি ৭৫ লক্ষ ছাড়ানোর পর এবং সাড়ে ৮ লক্ষ মৃত্যু ঘটে যাওয়ায় প্রতিটি টিকা তৈরির উদ্যোগের অগ্রগতিই নিবিড়ভাবে বিশ্ব জুড়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছেl এই ভাবে স্বেচ্ছায় পরীক্ষার প্রক্রিয়া থামিয়ে দেওয়ায় বিভিন্ন দেশে ঔষধ নিয়ামক সরকারি সংস্থাগুলি স্বভাবতই যে-কোনও টিকাকে ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যাপারে আরও অনেক সতর্ক হয়ে যাবে।
বর্তমানে এই পরীক্ষামূলক প্রয়োগের প্রক্রিয়াটি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে, ব্রাজিল, ভারত ও ব্রিটেনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরে, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাত্রই ৩১ অগস্ট প্রক্রিয়াটি শুরু করেছে, কিন্তু তারা এরই মধ্যে ৬২টি জায়গায় মোট ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের উপর এই প্রয়োগ শুরু করতে চলেছে। ব্রিটেনে ১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের উপর এই পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে, আর বাকি তিনটি দেশে মোট ১ হাজার স্বেচ্ছাসেবক এই পরীক্ষায় যোগ দিয়েছেন।
কার্যকারিতার দৌড়ে অ্যাস্ট্রাজেনেকা কেন এগিয়ে
জুলাই মাসে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা তাঁদের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের প্রাথমিক গবেষণার (প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের) ফল ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায়, যে ৫৪৩ জন স্বেচ্ছাসেবককে এই টিকা দেওয়া হয়, তাঁদের কারও শরীরেই এর কোনও বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। ৫টির মধ্যে ২টি পরীক্ষাকেন্দ্রে টিকা দেওয়ার আগে স্বেচ্ছাসেবকদের প্যারাসেটামল খাওয়ানো হয়, এবং তাতে গবেষকরা দেখেন যে গায়ে ব্যথা, জ্বরজ্বর ভাব, মাথাধরা, ঠান্ডা লাগা ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো অনেকটাই হ্রাস পাচ্ছে।
রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিরোধী টি-সেলগুলি ১৪ দিনের মাথায় এবং ২৮ দিনের মাথায় অ্যান্টিবডি তৈরি হতে শুরু করছে। যে ৩৫ জন স্বেচ্ছাসেবক সার্স-কোভ-২-র অ্যান্টিবডির কার্যকারিতা মাপার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের সকলের গায়ে তা ফুটে ওঠে।
এডিজেডওয়ানটুটুটু টিকা আসলে কী?
অনেক টিকাই অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করে বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করলেও এখনও পর্যন্ত এগুলি আন্তর্জাতিক ছাড়পত্র পায়নি। রাশিয়া যে স্পুতনিক-৫ টিকা তৈরি করেছে, চিন যে ক্যানসিনো টিকা বানিয়েছে কিংবা জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানি যে জ্যানসেন টিকা বানাচ্ছে, তারা সকলেই অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করেছে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে টিকার গণ-উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়। একই সঙ্গে তারা কোয়ালিশন অফ এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস, সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া, অ্যালবানি মলিকিউলার ক্যাটালেন্ট, ইমার্জেন্ট ব্লো সলিউশনস ইত্যাদির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ২শো কোটি প্রতিষেধক টিকা তৈরির অভিযানে নেমেছে।
আরও পড়ুন: ২০২১ অর্থবর্ষে ভারতের জিডিপি ১৫ শতাংশ সঙ্কুচিত হতে পারে, জানাল গবেষণা