গত ৯ আগস্ট কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ধর্ষণ ও খুন করা হয় তাদের ৩১ বছর বয়সী চিকিৎসক কন্যাকে। সন্তানের মৃত্যুর যন্ত্রণাদায়ক সেই অভিজ্ঞতার পাশাপাশি অন্যদিকে সমাজমাধ্যমে ছড়ানো গুজবের সাথে লড়াই করতে হচ্ছে তাদেরকে।
কলকাতায় মৃতা ওই চিকিৎসকের বাড়ির বাইরে সাংবাদিক এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ক্রমাগত যাতায়াত ছাড়াও ভিড় জমাচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা।
কলকাতার শহরতলীর সেই বাড়িতে এখন ২৪ ঘন্টা পুলিশ কর্মীরা পাহারায় নিযুক্ত। “আমরা খুব চিন্তাগ্রস্ত, আমরা চাই পুলিশ কিছু একটা করুক। মেয়েটার দেহ শেষকৃত্যের জন্য বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই ভিডিওও সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়াচ্ছে,” বুমকে জানায় মৃতার আত্মীয়।
বাড়ির লোককে আগে কলকাতা পুলিশ না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফোন করেছিল সেই নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়ায় নানান গুজব ছড়ায়। “হাসপাতালের সহকারী সুপার ফোন করে আমাদের কন্যার মৃত্যুর খবর দেয়। পুলিশ আমাদের কিছু জানায়নি, তারা শুধু ফোন করে তাড়াতাড়ি আসার জন্য বলে,” বক্তব্য পরিবারের।
চিকিৎসকের পরিবারকে বলা হয় তাদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছে - এমনটাও দাবি করেছেন অনেকে। এবিষয়ে মৃতার বাবা ডিকোডকে বলেন, “সহকারী সুপার আমাদের জানায় সে আত্মহত্যা করেছে, যদিও আমরা জানতাম এটা অসম্ভব। তাই আমরা তাড়াতাড়ি করে ৯ অগাস্ট দুপুর ১ টার দিকে হাসপাতালে পৌঁছই।”
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাস্তায় মহিলাদের নিরাপত্তা এবং ওই চিকিৎসকের মর্মান্তিক মৃত্যুর বিচারের দাবিতে আন্দোলন চলছে ক্রমাগত। অনেকেরই অভিযোগ, বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
১৩ অগাস্ট কলকাতা হাইকোর্ট মামলাটি সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয়। এরই মধ্যে কলকাতা পুলিশ ১৫ অগাস্ট রাতে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভাঙচুর করার জন্য কুড়িজনকে গ্রেফতার করে।
মেয়ের কলেজে সেদিন তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর ফোন পেলে দুপুর ১টা নাগাদ তারা সেখানে উপস্থিত হন। মৃত চিকিৎসকের বাবা আমাদের জানান, মেয়ের মৃতদেহ দেখার আগে তাদেরকে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তিনি বলেন,”প্রথম দিন থেকেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনও রকম সাহায্য করেনি।”
ফেসবুকে কীওয়ার্ড সার্চ করলে কাপড়ে আবৃত মহিলার দেহ ও শবদেহ বহনকারী গাড়িতে আরজি করের সেই চিকিৎসকের মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। মৃতার আত্মীয় বলেন, “এগুলি ভীষণ সংবেদনশীল। কীভাবে লোকজন পাচ্ছে এসব ভিডিও?”
পুলিশ মৃত চিকিৎসকের বাড়ির এলাকা ঘেরাও করে বন্ধ রেখেছে, শুধুমাত্র স্থানীয় বাসিন্দা ও নির্যাতিতার পরিবার ছাড়া আর কাউকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তারই মধ্যে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা লোকজন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেখানকার ছবি তুলে ফেলছে।
“সোশ্যাল মিডিয়াতে লোকেরা বেশ কিছু অপ্রীতিকর গুজব ছড়াচ্ছে। আমরা চাই সোশ্যাল মিডিয়ার লোকজন কিছু একটা করুক বিষয়টা নিয়ে,” নির্যাতিতার বাবা জানান বুমকে।
সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়ানো নানান গুজবের পাশাপাশি অনেকে নির্যাতিতার নাম এবং তার ছবি শেয়ার করছেন। এই ঘটনায় কলকাতা পুলিশের সাইবার বিভাগ এর মধ্যে ৬০ জনকে ভুয়ো খবর ছড়ানোর জন্য নোটিশ পাঠিয়েছে।
কিছু ফেসবুক পোস্টের দাবি ১০ অগাস্ট মেয়ের দেহ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় রাজনৈতিক দলের লোকজন পরিবারের লোকজনদের আটকায়। এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে মেয়ের বাবা জানান, “বাড়ি ফেরার সময় কেউ আমাদেরকে আটকায়নি।”
সোশ্যাল মিডিয়া দিয়ে কিছু পোস্ট করে অভিযোগ করা হয় মর্মান্তিক ঘটনার পর নির্যাতিতার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। মৃত চিকিৎসকের মা স্পষ্টভাবে বলেন , “আমাদের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়নি। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার সময় পুলিশ আমাদেরকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে বলে।”
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কলকাতা পুলিশ এখনও অবধি একজনকে এই ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় গ্রেফতার করেছে। সঞ্জয় রায় নামের এই অভিযুক্ত তার অপরাধ স্বীকার করেছে।
১৪ অগাস্ট রাতে “রাত দখল কর” আন্দোলনে হাজার হাজার প্রতিবাদকারীদের রাস্তায় নামার সময় মৃত চিকিৎসকের মা-বাবার চোখ ছিল টেলিভিশনের পর্দায়। তারা জানান, “আমরাও এই প্রতিবাদ দেখেছি। আমার ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমেছে। তারা কোনও রাজনৈতিক দলের নয়। তারা আমার মেয়েকে বোন মনে করে তার বিচারের লড়াইয়ে নেমেছে।”
(অতিরিক্ত রিপোর্টিং: শ্রীজিৎ দাশ)