বাগেশ্বর ধাম সরকার (Bageshwar Dham Sarkar) নামে পরিচিত স্বঘোষিত ঈশ্বরপুরুষ ধীরেন্দ্র শাস্ত্রীর (Dhirendra Shashtri) বক্তৃতা শুনতে বহু মানুষ ভিড় করে থাকে। তিনি তাঁর ভক্তদের যাবতীয় সমস্যা অনুমান করতে পারেন, তারা তাঁকে কিছু না-জানালেও। কারও দিকে একবার তাকিয়েই তিনি নাকি তার সমস্যার কথা এক টুকরো কাগজে লিখে ফেলেন, কখনও-সখনও উচ্চ স্বরে তাদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য, তাদের নাম-ধাম, পরিবারের সদস্যদের কথা আওড়ে যান। এ সবই নাকি তিনি নিজের পূর্বানুমানের ক্ষমতা থেকে করতে পারেন!
এবিপি নিউজ-এ (ABP News) এক রিপোর্টারের ক্ষেত্রেও তিনি সম্প্রতি এটা করে দেখান, যে বিষয়ে পরে ওই রিপোর্টার শাস্ত্রীজির ওই অলৌকিক ক্ষমতা অনুমোদনও করেন। পরে এবিপি চ্যানেলের ফেসবুক পেজ-এ তিওয়ারি সবিস্তারে এই ব্যাপারে তাঁর বিস্ময়ের কথা ব্যক্ত করেন, যেহেতু তিনি কখনও শাস্ত্রীজির সঙ্গে অতীতে নিজের সম্পর্কে কিছু খোলসা করেননি।
গত ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ ছত্তিশগড়ের রায়পুরে শাস্ত্রীজির এক ‘দিব্য দরবার’ অনুষ্ঠানে তিনি এই চমৎকার ঘটান। সেখানে উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন—“তোমাদের মধ্যে এমন কোনও সাংবাদিক আছো, যে আমার চাচার নাম বলতে পারবে? যদি না পারো, তাহলে এর পর আমাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন আখ্যা দিও না।”
এর পরেই শাস্ত্রীজির বক্তব্য, “এখানে উপস্থিতদের মধ্যে যার কাকার নাম ভৃগুনাথ, সে মঞ্চে উঠে এসো।” তখন এবিপির রিপোর্টার জ্ঞানেন্দ্র তিওয়ারি পায়ে-পায়ে মঞ্চে উঠে জানান, তাঁরই কাকার নাম ভৃগুনাথ। শাস্ত্রীজি এর পর তিওয়ারির কাছে জানতে চান, সম্প্রতি তার ভাই রঘুনাথ গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান করেছে কিনা। তিওয়ারি তাতেও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে শাস্ত্রীজির আরও প্রশ্ন —তিওয়ারির ভাইঝির নাম আভীষি কিনা। তাতেও উত্তেজিত তিওয়ারি সম্মতি জানান।
এর পর শাস্ত্রীজি তিওয়ারির কাছে জানতে চান, তার কোনও প্রশ্ন আছে কিনা। তিওয়ারি বলেন, তিনি সাংবাদিকতার পেশায় নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবিত এবং কী ভাবে সমাজের উপকার করা যায় তা চিন্তা করেন। তাতে শাস্ত্রীজি দ্রুত তিওয়ারিকে কয়েকটি মন্ত্র উচ্চারণ করতে বলেন এবং একটি কাগজে কিছু লিখে বলেন— তাঁর সম্পর্কে ‘যে সব গোপন কথা দুনিয়া জানে না, সে সবই ওই কাগজে লেখা রয়েছে’।
এর পর যা ঘটে, তা আরও চমকপ্রদ। তিওয়ারি এবিপি চ্যানেলে এসে শাস্ত্রীজির ‘অলৌকিক ক্ষমতা’র ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বলেন, আগে থেকে কিছু না জানা থাকা সত্ত্বেও শাস্ত্রীজি যে ভাবে তিওয়ারির যাবতীয় ব্যক্তিগত খবরের হদিস দিয়েছেন, তা ‘বিস্ময়কর’l
তিওয়ারির আরও বক্তব্য—বিশ্বাস এবং কুসংস্কারের মধ্যেকার বিভাজনরেখাটি অতিশয় সূক্ষ্ম, যা সকলেরই বোঝার চেষ্টা করা উচিত।
শাস্ত্রীর দিব্য দরবারের ১ ঘন্টা ২৫ মিনিটের পর থেকে লাইভ সম্প্রচারটি দেখা যাবে। এবিপি চ্যানেলেও সমগ্র দৃশ্যটি লাইভ সম্প্রচারিত হয়।
ভক্ত অনুগতজনের মধ্যে শাস্ত্রীজির এই অলৌকিক ক্ষমতায় অন্ধ বিশ্বাসের ব্যাপারটা বোঝা যায়, কিন্তু যার বিরুদ্ধে ‘মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি’ কুসংস্কার ছড়ানোর অভিযোগ তুলে তাঁর তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতা প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে, তাঁর সম্পর্কে একটি সংবাদ-চ্যানেলে এমন ভূয়সী শংসাপত্র অবাক করে। যুক্তিবাদী ও কুসংস্কারবিরোধী এই সমিতির প্রতিষ্ঠা করেন প্রয়াত (নিহত) নরেন্দ্র দাভোলকর। ২০১৩ সালের ২৩ অগস্ট প্রাতঃভ্রমণ করার সময় দাভোলকর ওঁকারেশ্বর মন্দিরের কাছে দুই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
এবিপি নিউজ শাস্ত্রীর ‘দিব্য দরবার’ শো-কে কুসংস্কার বলে মনে তো করেই না, উপরন্তু এখন সারাক্ষণই ওই দরবারের অনুষ্ঠান জীবন্ত সম্প্রচার করে চলেছে।
একই অনুষ্ঠান “বাগেশ্বর বাবা সম্পর্কে সত্য কী?” এই নামেও সম্প্রচার করা হয়।
২০ জানুয়ারি ২০২৩ অন্য একটি শো প্রচারিত হয় অন্তর্তদন্ত হিসাবে, যার নাম ছিল, “কোনও ব্যক্তি কী অসুখে ভুগছে, বাবা সে কথা জানেন কী ভাবে: বাগেশ্বর ধাম সরকার!”
এই অনুষ্ঠানটিতে কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তোলা হয় বটে, তবে সেগুলির কোনও সন্তোষজনক উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি।
সাংবাদিক তিওয়ারির সঙ্গে ‘ঈশ্বরপুরুষ’ শাস্ত্রীর কথোপকথনের ফুটেজও এই শো-তে তুলে ধরা হয়—দেখুন জীবন্ত চমৎকার!এই নাম দিয়ে।
পোস্টটি দেখুন এখানে।
এই শোতে তিওয়ারিকে বিশেষ অতিথি হিসাবে পেশ করা হয় এবং তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, চমৎকার বলে কিছু সত্যিই হয় কিনা। উত্তরে তিওয়ারি বলেন— ‘‘শাস্ত্রী তাঁর জীবন ও পরিবার সম্পর্কে যে ভাবে সব কথা খুলে বললেন, তা বিস্ময় কিনা জানা নেই, তবে তিনি এতে স্তম্ভিত হয়েছেন। এর আগেও আমি শাস্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি, কিন্তু কখনওই আমার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনের খুঁটিনাটি তাঁর সঙ্গে আলোচনা করিনি। ....কারও সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়াটা হয়তো খুব বড় কোনও চমৎকার নয়, কিন্তু যে ভাবে এক দল লোকের ভিড়ের মধ্যে বসে থেকে তুমি সহসা নিজের কাকার নাম শুনতে পাও, নিজের ভাইয়ের গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠানের কথা শোনানো হয়...আমি আশ্চর্য না হয়ে পারিনি...
তিওয়ারি কাগজের টুকরোটির প্রসঙ্গও টেনেছেন। “শাস্ত্রীজি আমাকে বলেন তাঁকে যে-কোনও প্রশ্ন করতে। কিন্তু আমি প্রশ্ন করার আগেই তার উত্তর একটা কাগজে লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দেন।”
এইখানে এসে রিপোর্টারটি জানাচ্ছেন যে “আমরা এবিপি নিউজে বিতর্কটির দু-দিকের বক্তব্যই পেশ করছি, কিন্তু আমার এই অভিজ্ঞতাটা বিমূঢ় করে দিয়েছে!”
এবিপি নিউজ-এর সঙ্গে শাস্ত্রীজির যোগসাজশ অবশ্য এখানেই শেষ হয়নি। এর পর তিওয়ারি ফেসবুক লাইভে এসে সেই সমালোচনার জবাব দিয়েছেন যে, তাঁর সম্পর্কে শাস্ত্রীর ফাঁস করা যাবতীয় তথ্য সোশাল মিডিয়ায় তিওয়ারির অ্যাকাউন্ট ঘাঁটলেই পাওয়া যায়।
সংশয় এবং প্রশ্ন জাগা বিষয়ে তিওয়ারির বক্তব্য—“এ সব কিছুই পরের ব্যাপার। আপনি যখন কারও দিতে তাকিয়ে কথা বলছেন... তার চোখের দৃষ্টির দিকে চাইছেন... সেই দৃষ্টিতে কেমন একটা বিষাদ মাখানো...একেবারেই কোনও সাধারণ মানুষের দৃষ্টি তা নয়...l”
শাস্ত্রীজির বাড়ি মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলের ছত্তরপুরে। অতীতে অনেক বার তিনি সাম্প্রদায়িক বক্তব্য প্রচার করেছেন, ধর্মান্তরণ নিয়েও বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন।
এবিপির রিপোর্টারের ব্যক্তিগত তথ্য ধীরেন্দ্র শাস্ত্রী কোথা থেকে জানলেন? কেন ফেসবুক থেকে!
তিওয়ারি খুব অবাক হয়েছেন, শাস্ত্রী তাঁর এত খবর জানলেন কী করে? তাঁর কাকার নাম, ভাইয়ের নাম, ভাইয়ের গৃহপ্রবেশের খবর বা ভাইঝির নাম ইত্যাদি? খুবই সহজে এসব তথ্য জেনেছেন তিনি। যার অধিকাংশ তথ্যই ফেসবুকে তিওয়ারির ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে দেওয়া ছিল।
বেশ কয়েকজন সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারী এই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
বুম নিজেও তিওয়ারির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খতিয়ে দেখেছে এবং শাস্ত্রীজির ‘অবাক-করে-দেওয়া’ তথ্যগুলির সবই সেই অ্যাকাউন্টে দেখতে পাওয়া গেছে।
তিওয়ারির প্রোফাইলের ‘অ্যাবাউট’ অংশে তাঁর ভাই রাঘবেন্দ্র তিওয়ারির কথা আত্মীয়দের তালিকায় উল্লেখ করা রয়েছে।
তিওয়ারির টাইমলাইন অংশে চোখ বোলালে ১৮ জানুয়ারির একটি ভিডিও নজরে আসে যাতে হিন্দি ক্যাপশনে তাঁর বড় ভাইয়ের গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
এই পোস্টটি দেখুন এখানে।
ভাইঝির নাম এবং কাকার নাম
তিওয়ারির বড় ভাই রাঘবেন্দ্র তিওয়ারির ফেসবুক প্রোফাইলে তাঁর মেয়ের সঙ্গে দেওয়া ছবি ‘‘কভার ছবি’’ হিসাবেই পোস্ট করা রয়েছে। তার উত্তরে ভৃগুনাথ প্রসাদ তিওয়ারি নামে জনৈক ব্যক্তি মেয়েটিকে ‘মিষ্টি সোনা’ বলে ডেকে তার নাম ‘আভীষি’ বলে উল্লেখ করেছে।
ভৃগুনাথের ওই স্নেহসূচক মন্তব্যের জবাবে আবার রাঘবেন্দ্র অর্থাৎ মেয়েটির বাবা এবং তিওয়ারির বড় ভাই লিখছে, “ধন্যবাদ চাচাজি”!
শাস্ত্রীজিও কিন্তু এবিপি রিপোর্টারকে মঞ্চে ডাকার সময় বলেছিলেন— “এখানে কার কাকার নাম ভৃগুনাথ!”
বুম এবিপি নিউজ-এর সংবাদ ও প্রযোজনা বিভাগের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট সন্তপ্রসাদ রাই-এর সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথমে বলেন—“আমরা কোথায় বলেছি যে আশ্চর্যজনক কিছু ঘটেছে! সব তথ্যই ফেসবুকে রয়েছে এবং এর মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার মতো ঘটনা কিছু নেইl”
তাঁকে অতঃপর প্রশ্ন করা হয়, তাহলে তাঁর রিপোর্টার জ্ঞানেন্দ্র তিওয়ারি বিষয়টাকে এমন আশ্চর্যজনক, চমৎকার বলে প্রচার করছে কেন? উত্তরে তিনি বলেন—“কারও যদি একে আশ্চর্যজনক, চমৎকার বলে মনে হয়, তাহলে সেটা তার ব্যাপার। আমরা এর মধ্যে অত আশ্চর্যজনক কিছু দেখছি না, আমরা বরং যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণা ভাঙতে চাই।”
তবে রাই এই প্রশ্নের কোনও জবাব বুম-কে দেননি যে কেন এবিপি নিউজ এটা প্রকাশ্যে সম্প্রচার করেনি যে তিওয়ারিকে তাঁর সম্পর্কে বলা শাস্ত্রীর যাবতীয় ‘তথ্য’ই ফেসবুকে আগে থেকেই নথিভুক্ত ছিল!