২০১৯ সালের মে মাসে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই প্রামাণ্য খবর সরবরাহকারী ওয়েবসাইট ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে। ক্রমেই মুছে যাচ্ছে নিছক প্রচারমূলক সংবাদ এবং ভুয়ো খবরের মধ্যেকার সীমারেখা । গত কয়েক মাস ধরে বুম এ ধরনেরই একটি ওয়েবসাইট ভাইরাল ইন ইন্ডিয়া-র গতিবিধি অনুসরণ করে দেখেছে কী ভাবে এই সাইটটি নির্জলা মিথ্যা ও ভুয়ো গুজবকে নির্ভরযোগ্য সংবাদ হিসাবে পরিবেশন করে চলেছে । এখানে ভাইরাল ইন ইন্ডিয়া প্রচারিত ১০টি খবর রয়েছে, যেগুলির তথ্য যাচাই করেছে বুম। বুম-এর পর্দাফাঁস করা ওই প্রতিবেদনগুলি হিন্দিতে ও ইংরাজিতে এখানে দেখা যেতে পারে ।
মজার ব্যাপার, ভাইরাল ইন ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইটটি বুধবার রদ করে দেওয়া হয়েছে এই বার্তা দিয়ে যে, “অপব্যবহারের জন্য এই সাইটের পরিষেবা বরাবরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হল”। সাইটের প্রতিষ্ঠাতা অভিষেক মিশ্রকে দিল্লি পুলিশের অপরাধ-দমন শাখা ভুপাল থেকে ২২ জানুয়ারি গ্রেফতারও করেছে, যা মধ্যপ্রদেশে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে, কারণ স্থানীয় পুলিশকে এই গ্রেফতারির ব্যাপারে কিছু জানানোই হয়নি ।
মঙ্গলবার মিশ্রকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে শোনা গেছে । তাঁর গ্রেফতারির সঙ্গে যুক্ত দিল্লি পুলিশের আধিকারিকদের সঙ্গে বুম যোগাযোগ করলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদস্থ মহল থেকে বলা হয়, “মিশ্রকে গ্রেফতার করা হয় এক ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে । অভিযোগকারী মিশ্রর বিরুদ্ধে তাঁর ওয়েবসাইট ও সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট মারফত ধর্মীয় আবেগে আঘাত করেছেন বলে অভিযোগ আনেন”।
তাঁর গ্রেফতারির কয়েকদিন আগে বুম তাঁর সঙ্গে কয়েক দফায় টেলিফোনে কথাবার্তা বলে বোঝার চেষ্টা করে, কেন তিনি তাঁর সাইটে কেবল কংগ্রেস দলের হয়ে প্রচার চালান । ভুয়ো খবর প্রচার নিয়ে তাঁর অনুতাপহীন জবাব হলঃ মূল স্রোতের মিডিয়া যে সব খবরকে গুরুত্ব দেয় না, তিনি সেগুলোই প্রচার করেন ।
সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির প্রতি যে, যারা জনরোষ উস্কে দিতে ভুয়ো খবর প্রচার করে, তাদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। মিশ্র কিন্তু বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ছাড়া ঔদ্ধত্যের সঙ্গে তাঁর ভুয়ো খবরের পক্ষে সাফাই গেয়ে গেলেন ।
ঘটনার ছোট্ট প্রেক্ষাপট
ভুপালে বসবাসকারী মিশ্র নিজেই তাঁর ফেসবুক পেজ ভাইরাল ইন ইন্ডিয়ার অ্যাডমিন বা পরিচালক । এবং ১০ লক্ষ অনুগামীর এই ওয়েবসাইটটি সার্থকনামা—এটি সত্যিইসংক্রামক বা “ভাইরাল”। পেজটির “আমাদের সম্পর্কে” বা ‘About Us’ বিভাগটির দাবি—আমাজন অ্যালেক্সা এই সাইটটিকে আন্তর্জাতিক স্তরে ৩১৮১ এবং ভরতীয় স্তরে ২৭৩ নম্বর স্থানে রেখেছে ।
পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মিশ্র ২০১৫ সালে এই সাইটটি চালু করেন । বুম যখন তাঁর কাছে জানতে চায়, এই সাইটটি খোলার পিছনে তাঁর লক্ষ্য কী ছিল, তিনি উত্তরে বলেন—“আমাদের প্রথম ও শেষ লক্ষ্যই হল, মুদ্রিত ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম যে সব খবর চেপে যায়, তা জনসমক্ষে তুলে ধরা । জনসাধারণও তাই আমাদের খবর ও তার পরিবেশনকে ভালবাসে । জনপ্রিয়তার আমরা একবার দেশের প্রথম একশো ওয়েবসাইটের তালিকাতেও ঢুকেছিলাম”।
ভাইরাল ইন ইন্ডিয়া কী ভাবে কাজ করে?
এই ফেসবুক পেজটির যে কোনও পোস্টে ক্লিক করলে সরাসরি ভাইরালইনইন্ডিয়া.নেট-এ পৌঁছে যাবেন, যেটাকে সংবাদ প্রকাশকারী ওয়েবসাইট বলে দাবি করা হচ্ছে । সংবাদ–পোর্টালে যা কিছু দেওয়া রয়েছে, তাকে মিশ্র বলেন “যে খবর দরকারি”। তবে শুধু বুম-ই নয়, তথ্য যাচাই করে এমন বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইটই মিশ্রর এই ‘দরকারি খবর’কে ভুয়ো বলে নস্যাত্ করেছে । ভাইরাল ইন ইন্ডিয়ার ফেসবুক পেজ বেশ কিছু মিম-ও ব্যবহার করে, যাতে রাজনৈতিক নেতাদের ছবিও দেওয়া থাকে এগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে । তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সেগুলি ভুয়ো । মিশ্রর বক্তব্য, তাঁদের সংস্থায় ৭-৮ জন কাজ করেন, যাঁরা খবরগুলি লেখেন এবং আপলোড করেন ।
রাজনৈতিক পক্ষপাত
এর ফেসবুক পেজটি ঘাঁটাঘাঁটি করলে সহজেই বোঝা যায়, এটি কংগ্রেস দলের দিকে ঝুঁকে রয়েছে । পেজটিতে শেয়ার করা অধিকাংশ প্রতিবেদন ও মিম সরাসরি নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারকে তার লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে । তবে মিশ্র বলে বেড়ান, তিনি বা তাঁর কর্মীদের কারওই কোনও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব নেই । তিনি বলেন—“আমি রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ”। যখন তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন দলীয় নেতার তোলা ছবির প্রসঙ্গ টানা হয়, তখন তাঁর কৈফিয়ত—“বিভিন্ন নেতার সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাত্ হয়, কখনও-সখনও তাঁদের সঙ্গে ছবিও তোলা হয়, তার সঙ্গে আমার রাজনৈতিক ঝোঁক বা প্রবণতার সম্পর্ক নেই”।
মিশ্রর আরও দাবি, যে ৮-১০ জন কর্মী তাঁর সংস্থায়রয়েছেন, তাঁদেরও কারও কোনও রাজনৈতিক পক্ষপাত নেই । তাঁরানিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন, এ জন্য তাঁরা কোনও পয়সাও পান না । এই ওয়েবসাইটটি কোনও ব্যবসায়িক লাভের জন্য খোলা হয়নি । কংগ্রেস এই সাইটটি চালাবার তহবিল জোগায়, এই অভিযোগ তিনি উড়িয়ে দেন । তিনি বলেন, তাঁরা বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার হয়ে কাজ করেন এবং তাদের ডিজিটাল মিডিয়া কনটেন্ট বানিয়ে দেন, আর তা থেকেই তাঁদের প্রয়োজনীয় খরচ উঠে আসে । উল্লেখ্য, ২০১২ সালে ভুপাল থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা মিশ্র ভাইরাল ইন ইন্ডিয়া চালু করার আগে ইউ-টিউবের ভিডিও বানাতেন । তাঁর একটি ইউ-টিউব পেজও আছে, যার গ্রাহকদের সংখ্যা ১,৩৬,৩৩৫ ।
অস্বীকারের ধারাবাহিকতা
গত কয়েক মাস ধরে মিশ্রর ওয়েবসাইটের অনেকগুলি রিপোর্টকে ভুয়ো বলে প্রমাণ করেছে বুম। তাই আমরা যখন তাঁর ভুয়ো খবরকে প্রকৃত তথ্য দিয়ে মোকাবিলা করি, তখন তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল নিম্নরূপঃ
রাহুল গান্ধী কি দুবাইয়ের ফাইটার প্লেনে ভারতে ফেরেন?
২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি বুমহিন্দি এই রিপোর্টটিকে ভুয়ো প্রতিপন্ন করে দেয় । রিপোর্টে দাবি করা হয়েছিল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি সরকার একটি ফাইটার জেটে করে রাহুল গান্ধীকে ভারতে ফেরত পাঠাচ্ছে । উল্লেখ্য, এ বছরের শুরুতে রাহুল ২ দিনের জন্য আবু ধাবি ও দুবাই সফরে গিয়েছিলেন। আর তখনই দক্ষিণপন্থী এবং তাদের বিপরীতপন্থী ফেসবুক পেজগুলি ডজন-ডজন ভুয়ো খবর বানিয়ে বাজারে ছাড়তে থাকে
। মিশ্র বুমহিন্দির নস্যাতকরণের পর কৈফিয়ত দেন, কেবল শিরোনাম বা হেডলাইনেই রাহুলের ফাইটার জেটে ফেরার খবর ছিল, রিপোর্টের ভিতরে কেবল আমিরশাহির বিশেষ বিমান সরবরাহ করার সংবাদটাই দেওয়া হয় । যখন জানতে চাওয়া হয়, শিরোনামেই বা ফাইটার জেটের বিভ্রান্তিকর খবর কেন দেওয়া হয়, মিশ্র পাল্টা প্রশ্ন করেন, আপনারাই বা ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে সংশয় মেটাননি কেন ?
আরবিআই-এর প্রাক্তন গভর্নর উর্জিত প্যাটেল কি প্রধানমন্ত্রীকে অকর্মণ্য বলেছেন?
এই রিপোর্টটি নিয়েও আমরা মিশ্রকে প্রশ্ন করি ।
ভাইরাল ইন ইন্ডিয়া নামের একটি ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডেলে রিপোর্টটি ব্যাপকভাবে শেয়ার হয় । মিশ্রকে যখন সে কথা বলা হয়, তিনি সরাসরি তা অস্বীকার করেন । মজার ব্যাপার, তার দু দিনের মধ্যেই এই ছবিটি ইনস্টা হ্যান্ডেল থেকে হাওয়া হয়ে যায় এবং তার জায়গায় পড়ে থাকে কেবল একটা খালি পেজ ।
উর্জিত প্যাটেলকে জড়িয়ে প্রচারিতভাইরালের আর একটি রিপোর্ট নিয়েও আমরা মিশ্রকে প্রশ্ন করি । ভাইরাল ওয়েবসাইটের লোগো দিয়ে উর্জিতের একটি ফোটো হিন্দিতে এক বিবৃতি সহ পোস্ট করা হয়-- প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর উর্জিত প্যাটেলের আক্রমণঃ “আমি যখন বিমুদ্রাকরণ সহ সরকারের সব ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নীরব ছিলাম, তখন আমি ওদের প্রিয়পাত্র ছিলাম । যখনই আমি প্রকাশ্যে এই সবের সমালোচনা করলাম, তখনই আমাকে বরখাস্ত করার রব উঠল”।
উর্জিত প্যাটেল কি বিমুদ্রাকরণ নিয়ে সরকারের পর্দাফাঁস করার কথা বলেছিলেন?
এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই মিশ্র তার উত্তর এড়িয়ে যান ।
এমনই আর একটি ভুয়ো খবর হল নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে শিবরাজ সিং চৌহান, অমিত শাহ, নীতিন গডকরি প্রমুখ বিজেপি নেতাদের ছবি দিয়ে একটি পোস্ট শেয়ার করা, যাতে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রদেশে নির্বাচনী পরাজয়ের পর শিবরাজ সিং চৌহানের সঙ্গে দলীয় নেতৃত্ব ভাল ব্যবহার করছেন না ।
এই প্রসঙ্গেও মিশ্র আমাদের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান । তবে মিশ্রর কাছ থেকে সবচেয়ে অদ্ভূত প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় ভাইরাল ইন ইন্ডিয়ার একটি রিপোর্ট বিষয়ে, তথ্য-যাচাইকারী ওয়েবসাইট অল্টনিউজ যাকে সম্পূর্ণ ভুয়ো বলে প্রমাণ করে দিয়েছে । রিপোর্টটিতে দাবি করা হয়, সিবিআইয়ের প্রাক্তন ডিরেক্টর অলোক ভার্মা নাকি প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলেছেন । রিপোর্টটি অল্টনিউজ ভুয়ো প্রমাণ করেছে । যখন আমরা এ বিষয়ে মিশ্রকে চেপে ধরি যে এমন তথ্য তিনি কোথায় পেলেন, তখন তিনি সাফাই দেন—ভার্মা নিজে নাকি তাঁকে এ কথা বলেছেন !
কংগ্রেসের সঙ্গে যোগসাজশ
মিশ্র নিজে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনও রকম সংশ্রবের কথা বেমালুম অস্বীকার করেন। আমরা তাই অন্য দিক থেকে ব্যাপারটা যাচাই করি । কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরজেওয়ালার সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি আমাদের ফোন ধরেননি । পরে তাঁর প্রতিক্রিয়া পেলে আমরা তদনুযায়ী রিপোর্টটি সংস্কার করব । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেস কমিটির এক কর্মকর্তা বলেন—“মিশ্রর সঙ্গে কংগ্রেসের কোনও যোগাযোগ নেই । আমার ধারণা, তিনি একজন সোশাল মিডিয়া কর্মী”।
কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকে থাকার কথা অস্বীকার করলেও আমরা বহু ফেসবুক পেজে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তাঁর ছবি অনবরত দেখে থাকি ।
“তথ্য যাচাইকারীদের উচিত শিক্ষা দেব”
আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় একবার-দুবার নয়, তিন-তিনবার সত্য সংবাদ প্রকাশের মসিহা মিশ্র হুমকি দেন, বুম বা অল্ট নিউজের মতো তথ্য যাচাইকারী ওয়েবসাইটকে তিনি উচিত শিক্ষা দেবেন। তাঁর ওয়েবসাইটে প্রাশিত খবরগুলিকে ভুয়ো আখ্যা দিয়ে এই ওয়েবসাইটগুলি জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করছে বলে তাঁর অভিমত । সাক্ষাৎকারের শেষ পর্বে যখন এই প্রতিবেদক তাঁকে প্রশ্ন করে যে তাঁর ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী, উত্তরে মিশ্র বলেন—“পরিকল্পনা তো অনেকই আছে, যার মধ্যে অন্যতম হল তোমাদের মতো তথ্য যাচাইকারীদের শায়েস্তা করা”।