উত্তরপ্রদেশে সম্প্রতি দুই মর্মান্তিক গণধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগের ঘটনায়— হাথরসে ১৯ বছর বয়সী তরুণী ও বলরামপুরে ২২ বছর বয়সী যুবতী— গোটা দেশ স্তম্ভিত। নারী সুরক্ষা নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠতে আরম্ভ করেছে।
অতি দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্য যে ভারতে গণধর্ষের ঘটনা বিরল নয়। ২০১২ সালে দিল্লিতে নির্ভয়া-কাণ্ডের পর বারে বারেই গণধর্ষণের ঘটনা জনসমক্ষে এসেছে, এবং ভারতে মেয়েদের কী পরিমাণ হিংস্রতার সম্মুখীন হতে হয়, এই ঘটনাগুলি তারই প্রতীকী।
২০১৪ সাল থেকে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো গণধর্ষণের ঘটনার তথ্য প্রকাশ করছে, এবং তাতে দেখা যাচ্ছে, সমগ্র দেশে হিন্দি বলয়ের পরিস্থিতি সবচেয়ে মারাত্মক।
হিন্দি বলয়ে গণধর্ষণের প্রাবল্য
২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল অবধি গোটা দেশে মোট ১২২৫৭টি গণধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশ (৩১৮২টি ঘটনা), রাজস্থান (২৯৮৭টি ঘটনা), মধ্যপ্রদেশে (১৩৬১টি ঘটনা) এবং হরিয়ানাতেই (১০৯৮টি ঘটনা) ঘটেছে মোট গণধর্ষণের ৭০ শতাংশ (চার রাজ্যে মোট ৮৬১৯টি গণধর্ষণের ঘটনা)। এই রাজ্যগুলিতে দেশের মোট মহিলা জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ বাস করেন।
পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র ও দিল্লি রয়েছে এই চার রাজ্যের পরেই। এই তিনটি রাজ্যে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ৬৪৬, ৫৭৩ ও ৪৮৮টি।
২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯-এ দেশে গণধর্ষণের সংখ্যা সামান্যই বেড়েছে (১৮২৬ থেকে ১৯৩১টি ঘটনা), কিন্তু রাজস্থানে নথিভুক্ত গণধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে ৬২ শতাংশ। উত্তরপ্রদেশে অবশ্য ২০১৭ সাল থেকে নথিভুক্ত গণধর্ষণের ঘটনা হ্রাস পেয়েছে ৩০ শতাংশ। ২০১৮ সালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, আগের বছরের তুলনায় উত্তরপ্রদেশে গণধর্ষণের ঘটনা কমেছে ২৭ শতাংশ।
দ্রষ্টব্য: এনসিআরবি পরিসংখ্যানে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সর্বশেষ প্রাপ্ত পরিসংখ্যান হিসেবে ২০১৮ সালের তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে, কারণ রাজ্য এখনও ২০১৯ সালের তথ্য জমা করেনি।
গত বছর, দেশে মোট যতগুলি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল, তার ছয় শতাংশ ছিল গণধর্ষণ। যদিও ২০১৪ সাল থেকে নথিভুক্ত গণধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা ক্রমেই কমছে, কিন্তু ২০১৯ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল ছয় শতাংশ।
হেফাজতে ধর্ষণ এবং ধর্ষিতাকে হত্যা
ভারতের মাত্র ১৭ শতাংশ মহিলা উত্তরপ্রদেশে বাস করেন, কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে সেই রাজ্যে হেফাজতে ধর্ষণের ঘটনা (পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, সরকারি চাকুরে, হাসপাতা কর্মী, জেলকর্মীদের দ্বারা) গোটা দেশের মোট ঘটনার ৭২ শতাংশ।
২০১৪ ও ২০১৫ সালে ভারতে মোট ১১টি হেফাজতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল— তার মধ্যে ন'টি ঘটনাই ঘটেছিল উত্তরপ্রদেশে। তার পর থেকে এনসিআরবি পরিসংখ্যানে এই বিশেষ তথ্যটি আর অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
২০১৭ সাল থেকে এনসিআরবি-র পরিসংখ্যানে ধর্ষণ বা গণধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা একটি পৃথক পরিসংখ্যান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গত বছর এই অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ২০ শতাংশ। ২০১৭ সালে গোটা দেশে মোট ১৩২টি ধর্ষণ।গণধর্ষণের পরে খুনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছি। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে এই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৮৭ ও ২২৩।
গত বছর, ধর্ষণ/গণধর্ষণের পরে খুনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল মহারাষ্ট্রে (৪৭টি ঘটনা)। তালিকায় তার পর ছিল মধ্যপ্রদেশ (৩৭টি ঘটনা), উত্তরপ্রদেশ (৩৪টি ঘটনা), অসম (২৬টি ঘটনা) ও কর্নাটক (২৩টি ঘটনা)।
মেয়েরা সুরক্ষিত নয় দেশে
২০১৯ সালে ভারতে প্রতি দিন গড়ে ৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছিল সাত শতাংশ। কিন্তু গোটা দেশে মেয়েদের কতখানি যৌন নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়, এই পরিসংখ্যান থেকে তার আঁচ পাওয়া যাবে না, কারণ মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার সিংহভাগ ঘটনাই এখনও নথিভুক্ত হয় না।
২০০৬ সালে এনসিআরবি জানিয়েছিল, দেশে মোট ধর্ষণের ৭১ শতাংশই পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয় না। ২০১৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের অধ্যাপকদের করা একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, অনুপাতটি ৫৪ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু, ধর্ষণের প্রকৃত পরিসংখ্যান নিয়ে যে কোনও সমীক্ষাই চরিত্রে এত জটিল যে বাস্তবে অনথিভুক্ত ঘটনার অনুপাত ঠিক কত, তা জানার কোনও উপায় নেই।
তার চেয়েও বড় কথা, ভারতে দাম্পত্য ধর্ষণ অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত নয়। কাজেই, মহিলাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যা কত, তা জানার উপায় নেই। তবে, অতীতের কিছু সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনাতেই জড়িত থাকে ধর্ষিতার কোনও পূর্বপরিচিত, যার মধ্যে বহু ক্ষেত্রেই থাকে মেয়েটির স্বামী বা প্রেমিকও।
আরও পড়ুন: না, এটি হাথরসে প্রয়াত নির্যাতিতার ছবি নয়