এই সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা তিনটি কৃষি সংস্কার বিল পাস হয়েছে লোকসভায়। তার ফলে, হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও আরও কিছু রাজ্যে কৃষক সংগঠন ও কৃষি আন্দোলনের কর্মীরা বড় ধরনের আন্দোলনে নেমেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, ওই সংস্কার কৃষকদের ভাল করবে। অন্যদিকে, কৃষক ইউনিয়নের নেতা ও সক্রিয় কর্মীরা দাবি করছেন, ওই নতুন আইন ন্যুনতম সহায়ক মূল্যকে বানচাল করে বড় কম্পানিগুলিকে শোষণ করার সুযোগ করে দেবে।
শুক্রবার এ বিষয়ে কথা বলার সময়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, "কেউ যদি কৃষকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করে থাকে, সে হল বিজেপি-এনডিএ সরকার।"
মোদী আরও বলেন, বিরোধীরা মিথ্যে বলে কৃষকদের বিভ্রান্ত করছেন।
কিন্তু বিজেপির বেশ কিছু সহযোগী পার্টি ও সংগঠনও ওই বিল সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস-এর কৃষক শাখা ভারতীয় কিষাণ সংঙ্ঘ (বিকেএস) বলেছে, কেন্দ্র যেন পর্যালোচনার জন্য বিলটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠায়।
বিকেএস-এর জাতীয় সাধারণ সম্পাদক দীনেশ কুলকার্ণি
ইকনমিক টাইমস-কে বলেন, "এই বিলগুলি কৃষকের স্বার্থসিদ্ধি করবে কিনা সে ব্যাপারে আমাদের গভীর সংশয় আছে। দেখে মনে হচ্ছে, এগুলি কৃষকের হাতের অস্ত্র না হয়ে, ক্রেতাদের হাতের অস্ত্র হয়ে উঠবে।"
শেষমেশ, মোদীর ক্যাবিনেটে খাদ্য ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের মন্ত্রী শিরোমণি অকালি দলের (এসএডি) নেত্রী হরসিমরত কউর বাদল তাঁর পদ থেকে ইস্তফা দেন, এবং তাঁর জায়গায় আসেন নরেন্দ্র তোমার।
সংসদের বাদল অধিবেশনে, ৫ জুন তারিখে আনা তিনটি অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশের বদলে তিনটি বিল পেশ করেন কেন্দ্রীয় সরকার। সেগুলি লোকসভায় পাস হয়ে যায়। বিলগুলি হল:
১) 'কৃষি পণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন বিল, ২০২০': এই বিল বর্তমান এমপিএমসি আইনের আওতায় থাকা মাণ্ডি ব্যবস্থা থেকে ব্যাপারিদের মুক্ত করে পূর্বনির্ধারিত জায়গায় বানিজ্য করার ছাড়পত্র দেবে।
২) 'কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত করতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি সংক্রান্ত বিল, ২০২০': কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে চুক্তি-চাষের আইনি কাঠামো আছে এই বিলে।
৩) 'অত্যাবশ্যক পণ্য আইন' সংশোধন বিল, ২০২০': 'বিশেষ পরিস্থিতি' ছাড়া, খাদ্য সামগ্রীর চলাচল আর আগের আইনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলে, এই আইনের বলে কেন্দ্র কিছু খাদ্য দ্রব্যের যোগান নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
যে বিয়ষগুলিকে ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলি হল ন্যায্য মূল্য ঠিক করার কোনও পন্থার উল্লেখ নেই বিলগুলিতে। এবং 'ট্রেডার' বা ব্যবসায়ী, 'ডিসপিউট রেজিলিউশন' বা বিবাদ মিমাংসা এবং 'ফ্রি মার্কেট' বা খোলা বাজারের কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞাও দেওয়া হয়নি সেগুলিতে। কৃষক সংগঠনগুলির আরও অভিযোগ, অধ্যাদেশগুলি জারি করার আগে তাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করা হয়নি।
'অ্যালায়েন্স ফর সাসটেনেবেল অ্যান্ড হোলিস্টিক এগ্রিকালচার-কিষাণ স্বরাজ'-এর মুখাপাত্র কবিতা কুরুঙ্গতি বুমকে বলেন, "একত্রে, তিনটে বিল প্রতিযোগিতা শেষ করে দিতে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের সাহায্য করবে। এবং বর্তমান মাণ্ডি ব্যবস্থা, যা কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করে, সেটিকে ধ্বংস করবে।"
কৃষি পণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন বিল, ২০২০
রাজ্য 'এগ্রিকালচার প্রোডিউস মার্কেট কমিটি (এপিএমসি) অ্যাক্ট' অনুযায়ী, ব্যবসা চলত কমিশন এজেন্টদের মাধ্যমে। তাদের আর্থিক ক্ষমতা যাচাই করার পর তাদের ব্যবসা করার লাইসেন্স দেওয়া হত। নতুন আইনে ওই কমিশন এজেন্টদের আর কোনও ভূমিকা থাকছে না। তার বদলে থাকছেন 'ব্যবসায়ী'। তিনি হলেন 'এক ব্যক্তি যিনি নিজে বা অন্য এক বা একাধিক ব্যক্তির হয়ে, আন্তর্রাজ্য বা অন্তর্রাজ্য বা উভয় ভাবেই কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য কিনবেন। সেই কেনার উদ্দেশ্য পাইকারি, খুচর বিক্রি, এন্ড ইউজ বা নিজের ব্যবহারের জন্য, অথবা মান বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াকরণ, উৎপাদন, রপ্তানি, খাওয়ার জন্য বা অন্য কোনও প্রয়োজন মেটানোর জন্যও হতে পারে।'
কিন্তু এপিএমসি মান্ডির বাইরে কেনা-বেচার এলাকায় কোনও রকম আর্থিক যাচাই বা লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তার কথা বিলে উল্লেখ করা হয়নি।
কেন্দ্রীয় সরকারের কথা অনুযায়ী, প্যান কার্ড থাকলেই একজন ব্যবসায়ী মান্ডির বাইরে কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে পারবেন।
কুলকার্ণি বলেন, এর ফলে এই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, ব্যবসায়ীরা টাকাও না দিতে পারেন, বিশেষ করে যখন তাঁদের সামর্থ যাচাই করার বা টাকা জমা রাখার কোনও ব্যবস্থা নেই।
কৃষি পণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন অধ্যাদেশের ৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, "একটি বানিজ্য এলাকায় কৃষকদের পণ্য কেনা-বেচার জন্য কোনও চাষি বা ব্যবসায়ী, বৈদ্যুতিন ব্যবসা বা লেনদেনের প্ল্যাটফর্মের ওপর কোনও বাজার শুল্ক, সেস, লেভি বা রাজ্য এপিএমসি আইন বা অন্য কোনও আইন অনুযায়ী অন্য কোনও ধরনের ফি বসান যাবে না।"
কুরুঙ্গতি মনে করেন, এপিএমসি মান্ডি থেকে সম্পূর্ণ এক অনিয়ন্ত্রিত বাজারে সরে গেলে, চাষিদের বড় কম্পানিগুলির সঙ্গে সরাসরি কারবার করতে হবে। তার ফলে চাষিদের শোষণ করার সুযোগ পেয়ে যাবে কম্পানিগুলি।
ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বানচাল হয়ে যাওয়া সম্ভাবনার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে, তিনি বলেন, "যদি বর্তমানের মান্ডি ব্যবস্থা ধ্বসে যায়, তাহলে তেমনটা হওয়ারই ইঙ্গিত রয়েছে।"
কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত করতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি সংক্রান্ত বিল, ২০২০
চুক্তি-চাষ বিলের ৩ নং ধারায় বলা হয়েছে, "যে কোনও ধরনের কৃষি পণ্যের জন্য একজন চাষি লিখিত চুক্তি করতে পারেন। তাতে যা থাকবে, তা হল:
ক) পণ্য যোগান সংক্রন্ত শর্তাবলী। তাতে নির্দিষ্ট করা থাকবে যোগান দেওয়ার সময়, মান, গ্রেড, স্ট্যান্ডার্ড, দাম ও অন্যান্য বিষয়
খ) কৃষি পরিষেবা দেওয়ার শর্তাবলী।
বিলের ১৯ নং ধরায়, দেওয়ানি আদালতের আওতা সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। এই নিয়েও প্রশ্ন উঠছে, কারণ এই চুক্তিগুলি, এমনকি লিখিত চুক্তিও, স্বেচ্ছায় ও ব্যক্তিগত ভাবে করা হবে।
কুরুঙ্গতি মনে করেন, এর ফলে কৃষকের প্রতি অবিচার করা হবে। কারণ, ওই ধরনের চুক্তিতে কৃষকরা হলেন দুর্বল পার্টি। "সরকারের যা করা উচিৎ ছিল, তা হল, কৃষি পণ্যের দামটা যাতে ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে ঠিক করা হয়, সেই ব্যবস্থা করা। চুক্তিতে যে দামটা ধার্য করা হবে, তা যেন ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে চেয়ে বেশি হয়।"
অত্যাবশ্যক পণ্য আইন' সংশোধন বিল, ২০২০
কৃষক ইউনিয়ন ও সমাজ কর্মীরা মনে করেন, এই সংশোধনী বড় কম্পানিগুলিকে এমন পরিমাণে কৃষি পণ্য মজুত করতে সাহায্য করবে, যা ফার্ম প্রোডিউসারস অরগানাইজারস বা এফপিও-র মত ছোট প্রতিযোগীদের পক্ষে সম্ভব নয়।
কুরুঙ্গতি আরও বলেন যে, বিলটি দাবি করে কৃষকদের "আয় বাড়ানই" এর উদ্দেশ্য। কিন্তু ১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে মজুত করার ব্যাপারে কেবল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও মহাজনদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, কৃষকদের ওপর নয়।
"বড় ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুত করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তার মানে হল, বড় কম্পানিগুলি দাম নির্ধারণ করবে এবং তা কমিয়ে দেবে। এর ফলে কৃষকদের আয় কমে যাবে," বলেন কুরুঙ্গতি।