রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভার বেশ কয়েকজন বিরোধী সাংসদ কৃষি সংস্কার বিল নিয়ে তাঁদের ভোটাভুটির দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার প্রতিবাদে হৈচৈ করলে সভা বেশ কয়েকবার মুলতুবি করে দেওয়া হয় এবং সভাকক্ষে তুমুল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সভার উপাধ্যক্ষ হরিবংশ সিংহ বিলের উপর উপস্থিত সাংসদদের ভোটাভুটির দাবি অগ্রাহ্য করে ধ্বনি-ভোটে বিলগুলি পাশ করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়াতেই গণ্ডগোলের সূচনা।
আপনারা যদি যথেষ্ট সংখ্যক সংসদীয় অধিবেশন দেখে থাকেন, তাহলে জানবেন যে, কোনও বিলের উপর ধ্বনি ভোট নেওয়ার সময় উপস্থিত সাংসদদের একবার বিলের সপক্ষে "হ্যাঁ" এবং আর একবার বিপক্ষের সাংসদদের "না" বলতে বলা হয়, যখন অধিকাংশ সদস্যকেই বিলের পক্ষে বলে মনে হয়। পক্ষান্তরে, ভোটাভুটিতে ডিভিসন চাওয়ার অর্থ হল, বিলের পক্ষে ও বিপক্ষের প্রতিটি সাংসদের দেওয়া ভোট গণনা করা।
এই দুটি পদ্ধতিই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ঐতিহ্য থেকে ধার করা, যা ব্রিটিশ আমলেও ভারতে প্রয়োগ করা হতো।
ধ্বনি ভোট
যদিও এই পদ্ধতির ভোট নিয়ে বিতর্ক আছে, তবুও সংসদীয় নিয়ম-বিধিতে এই রীতিটি গ্রাহ্য। এই পদ্ধতির একটাই সুবিধা—এটা দ্রুততর, যেহেতু এতে প্রতিটি ভোট গণনার দরকার পড়ে না এবং যে পক্ষের আওয়াজ সবচেয়ে বেশি, তাদেরই জয়ী ঘোষণা করা হয়। সাধারণত তখনই ধ্বনি ভোট নেওয়া হয়, যখন কোনও বিল নিয়ে সংসদে সুস্পষ্ট সহমত থাকে। মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চৌহান একবার দ্য হিন্দু পত্রিকাকে বলেছিলেন, "ধ্বনি-ভোট তখনই বৈধ, যখন তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না।"
এবং তিনি ঠিকই বলেছিলেন। ধ্বনি-ভোট যদিও সংসদীয় রীতির মধ্যেই পড়ে, তবু সাংসদরা যদি তাকে চ্যালেঞ্জ করেন, তাহলে স্পিকারকে ভোটের 'ডিভিসন' মঞ্জুর করতেই হবে।
রাজ্যসভার পদ্ধতিগত নিয়ম এবং কার্যবিধি সংক্রান্ত নিয়মের ২৫২ নম্বর বিধির (৪)গ ধারা অনুযায়ী, "যদি ধ্বনি ভোটের সিদ্ধান্তটি পুনরায় চ্যালেঞ্জ করা হয়, তাহলে স্বয়ংক্রিয় ভোট রেকর্ডার মারফত কিংবা লবিতে গিয়ে সাংসদদের ভোট গণনা করতে হবে।"
ভোটের ডিভিসন
বিধি সংক্রান্ত ওই বইতেই লেখা রয়েছে, যদি কোনও সদস্য ধ্বনি-ভোটের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করেন, তাহলে স্পিকারকে দুটোর মধ্যে যে-কোনও একটা উপায়ে ভোটের গণনা করতে হবে হয় স্বয়ংক্রিয় ভোট রেকর্ডার মারফত গুনতে হবে, কিংবা সদস্যরা আলাদা লবিতে গিয়ে জড়ো হলে তখন গুনতে হবে।
স্বয়ংক্রিয় ভোট গণনা
২৫৩ বিধির ১ নং উপবিধি অনুযায়ী বলা হয়েছে।
"যদি ধ্বনি-ভোটের রায় বা ফলাফল চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং সভাধ্যক্ষ স্থির করেন যে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র মারফত ভোট গণনা করা হবে, তখন তিনি ওই স্বয়ংক্রিয় গণনা যন্ত্রেই ভোট নেওয়ার নির্দেশ দেবেন এবং সাংসদরা তখন তাঁদের নিজ-নিজ আসনে বসেই সেই যন্ত্রের বোতাম টিপে তাঁদের রায় জানিয়ে দেবেন। এটা ভোটদানের একটা বৈদ্যুতিন পদ্ধতি, যার মাধ্যমে প্রত্যেক সাংসদই নিজের নিজের রায় জানিয়ে দিতে পারবেন। যদি কোনও সদস্য ভুল করে কোনও বোতাম টিপে দেন, তাহলেও ভোটের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা হওয়ার আগে তিনি নিজেকে সংশোধন করে নেওয়ার সুযোগ পাবেন এবং আবার বোতাম টিপতে পারবেন।"
লবিতে গিয়ে ভোট দেওয়া
আর একটি ভোটদানের পদ্ধতি হল, সদস্যরা লবিতে যাবেন এবং সেখানে নিজের-নিজের ভোট দেবেন।
এ সংক্রান্ত বিধিটি হল: "যদি ধ্বনি-ভোটের ফলাফল কেউ চ্যালেঞ্জ করে, তখন সভাধ্যক্ষ সদস্যদের বলবেন লবিতে গিয়ে নিজেদের ভোট বা রায় জানিয়ে আসতে। তখন যাঁরা বিলের পক্ষে "হ্যাঁ" বলেছেন, তাঁরা ডান দিকের লবিতে চলে যাবেন ভোট দিতে, আর যাঁরা "না" রায় দিয়েছেন, তাঁরা বাম দিকের লবিতে চলে যাবেন। লবিতে হাজির হয়ে প্রত্যেক সদস্যই তাঁদের নিজের-নিজের ডিভিসন নম্বর আওড়াবেন এবং ডিভিসন ক্লার্ক সেই নম্বর ডিভিসন তলিকায় নথিভুক্ত করার পাশাপাশি তাঁদের নামও চেঁচিয়ে ডাকবেন।"
এই পদ্ধতিটি একটু বেশি বিস্তারিত ও দীর্ঘায়িত, যেখানে প্রতিটি সভাসদ তাঁর পছন্দ বা অপছন্দ অনুযায়ী বিলের সপক্ষে বা বিপক্ষে একজন একজন করে নিজের রায় জানাবেন এবং ডিভিসন ক্লার্ক সেই রায় নথিভুক্ত করবেন।
স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক ভোটদানের পদ্ধতির মতো এই পদ্ধতির ক্ষেত্রেও ভোটের চূড়ান্ত ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না, তবে এ ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে কোনও সভাসদ অধ্যক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে নিজের রায় জানাতে গিয়ে কোনও ভুল করে ফেললে তা শুধরে নেবার সুযোগ পাবেন।
আরও পড়ুন: কোভিড-১৯ কি উহানের ল্যাবরেটারিতে তৈরি? লি-মেঙ ইয়ান সম্পর্কে যা জানি
কোন ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি
বোঝাই যাচ্ছে, ধ্বনি ভোট তখনই নেওয়া যায়, যখন কোনও একটি বিলের সপক্ষে সভার অধিকাংশ সদস্যের অনুমোদন রয়েছে এবং তাঁরা বিলে সম্মতি দিতে একমত হয়েছেন।
গত রবিবার যখন কৃষি সংস্কার বিলদুটো সভায় পেশ হয়, তখন তার সপক্ষে স্পষ্টটতই সভাসদদের মধ্যে কোনও ঐকমত্য ছিল না। এমনকী শিরোমণি অকালি দলের মতো শাসক জোটের শরিক দলের সদস্যরাও বিলদুটির কিছু ধারা নিয়ে তীব্র আপত্তি জানাচ্ছিলেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের ডেরেক ওব্রায়েন বিষয়টি সভার উপাধ্যক্ষকে জানান এবং বিলদুটির ওপর ভোটের ডিভিসন দাবি করেন। কিন্তু সভা-পরিচালক সেই দাবি অগ্রাহ্য করেন, আর তারপরেই সভায় বিশৃঙ্খলা শুরু হয়।
এটা অবশ্য খুব কম ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে যে সভাসদরা কোনও বিলের উপর ভোটাভুটিতে ডিভিসন চান এবং যার ফলে ধ্বনি ভোটেই সাধারণত বিল পাশ হয়ে যায়।
পার্লামেন্টের ইতিহাসে প্রথম এ ধরনের ডিভিসন ভোটাভুটির ঘটনাটি ঘটে ১৯৫২ সালের ১৫ মে, যেদিন লোকসভা দ্বিতীয় দিনের জন্যে অধিবেশনে বসে। সে দিন লোকসভার নির্ণেয় ছিল, গণেশ মাভালংকর এবং এস এস মোরে-র মধ্যে কে লোকসভার স্পিকার নির্বাচিত হবেন। মাভলংকর ৩৯৪টি ভোটেজয়লাভ করেন।
সেই থেকেই কোনও বিতর্কিত বিলের ক্ষেত্রে এই ডিভিসন ভোট নেওয়া হয়েছে, যখনই কোনও সভাসদ সেই বিলের উপর ভোটাভুটির ফল নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। ২০১৯ সালে লোকসভার সদস্য আসাদুদ্দিন ওয়াইসি তিন-তালাক বিল নিয়ে বিলের উপর ডিভিসন দাবি করেছিলেন এবং সেই দাবি মঞ্জুরও হয়েছিল। বিলটি শেষ পর্যন্ত ডিভিসনে পাশ হয় পক্ষে ১৮৫টি এবং বিপক্ষে ৭৪টি ভোট পড়ায়।
গত অগস্ট মাসে মণিপুর বিধানসভায় শাসক জোটের গরিষ্ঠতা আছে কিনা জানতে আস্থা-ভোট নেওয়া হয়। সেই ভোটও রহস্যাবৃত ছিল, যেহেতু কংগ্রেস বিধায়করা দাবি করেছিলেন, তাঁদের ডিভিসনের দাবি স্পিকার গ্রাহ্য করেননি।
একই ভাবে ২০১৪ সালে দেবেন্দ্র ফড়নবিশ-এর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের সময় শিবসেনা ও কংগ্রেস ভোটাভুটিতে ডিভিসন দাবি করে। কিন্তু সেই দাবি স্পিকার অগ্রাহ্য করেন এবং ধ্বনি ভোটে বিজেপি সরকারকে জয়ী ঘোষণা করা হয়।
আরও পড়ুন: কৃষি সংস্কার বিল কৃষকদের মধ্যে বিক্ষোভ সৃষ্টি করছে কেন?