সুপ্রিম কোর্টে রামজন্মভূমি নিয়ে বিতর্কের মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। সেই শুনানি পর্বে অনেক নাটকীয় দৃশ্য এবং গোলমালের সাক্ষী থেকেছে আদালত। সর্বভারতীয় হিন্দু মহাসভার উকিল হিন্দু দেবতা রামের জন্মস্থানের প্রমাণ সম্বলিত একটি পুস্তিকা দাখিল করলে মুসলিম আবেদনকারীদের আইনজীবী রাজীব ধাওয়ান তা ছিঁড়ে ফেলেছেন।
ধাওয়ান যখন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগইয়ের কাছে পুস্তিকাটি ছিঁড়ে ফেলার অনুমতি চান এবং বিচারপতি তাকে বলেন—"আপনার যা ইচ্ছা করুন", তখনও আদালতকক্ষে তীব্র বাদানুবাদ হয়েছে।
৪০ দিন ধরে একটানা শুনানির পর শীর্ষ আদালত তার রায় সাময়িকভবে স্থগিত রেখেছে এবং বিবদমান দুই পক্ষকেই তিন দিন সময় দিয়েছে রায় থেকে কোনও বিষয়ে ছাড় পাওয়ার সুযোগ দিতে।
এই শুনানি শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে রামজন্মভূমি বাবরি-মসজিদ বিরোধের দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাসের একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। একই সঙ্গে আদালতের বাইরে দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করে মীমাংসায় পৌঁছানোর জন্য তৈরি প্যানেলও তার সুপারিশ আদালতে পেশ করেছে।
বরাবরের জন্য ভারতীয় রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এই বিতর্ক সম্পর্কে যা কিছু জ্ঞাতব্য, এখানে তা পেশ করা হলো।
১. রামজন্মভূমি বিতর্কটি ঠিক কী?
হিন্দু দেবতা রামের জন্মস্থানকে ঘিরে বিতর্ক দানা বাঁধে ১৯৯২ সাল থেকে, যখন এক দল হিন্দু জনতা বাবরি মসজিদ নামে ষোড়শ শতকের একটি মুসলিম ধর্মস্থান ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। মসজিদ-বিরোধীরা বরাবরই দাবি করে এসেছে যে, হানাদাররা একটি মন্দির ধ্বংস করে তার ধ্ংসস্তূপের উপর এই মসজিদটি খাড়া করেছিল। ১৯৯২ সালে এই মসজিদটির ধ্বংসসাধন দেশ জুড়ে ব্যাপক দাঙ্গা সৃষ্টি করে এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আগুনে অন্তত ২০০০ মানুষ নিহত হন ।
সেই থেকেই হিন্দুদের তরফে মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপরেই রামজন্মভূমি মন্দির বানানোর দাবি উঠতে থাকে আর মুসলিমরা বাবরি মসজিদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দাবি জানায় ।
তবে এই জমিটি নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ এবং উত্তেজনা আরও অনেক আগে থেকেই ছিল, বস্তুত কয়েক শতাব্দী ধরেই ছিল। আধুনিক যুগের ইতিহাসে বিতর্কিত জমিটি ঘিরে সাম্প্রদায়িক গোলমালের প্রথম লিখিত বিবরণ ১৮৫৩ সালের, যখন অবধ-এর শাসক ছিলেন শাহ।
১৯৪৯ সালে কিছু লোক মসজিদের ভিতরে রামের মূর্তি রেখে দিয়ে আসে। উভয় পক্ষই স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়। এটিকে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে জমি নিয়ে বিরোধগুলির মধ্যে প্রথম দিকের বিরোধ বলা হয়।
২. রামজন্মভূমি মামলায় আগের রায়গুলো কী?
বিভিন্ন আদালতে এই মামলাটি বিচারের জন্য নিয়ে যাওয়ার ৪টি নজির রয়েছে:
- ১৯৫০ সালে গোপাল বিশারদ নামে জনৈক ব্যক্তি মসজিদের ভিতর স্থাপন করা ‘রামলালা’র (শিশু রামচন্দ্রের) মূর্তিকে পুজো করার অনুমতি প্রার্থনা করে আদালতের শরণাপন্ন হন
- একই বছরে পরমহংস দাস নামে এক মোহন্ত মূর্তিগুলি মসজিদের ভিতর রেখে দেওয়ার এবং তাদের পূজার্চনা চালিয়ে যাওয়ার আবেদন জানান।
- ১৯৫৯ সালে ‘নির্মোহী আখাড়া’ নামে একটি হিন্দু ধর্মীয় গোষ্ঠী বিতর্কিত জমিটির মালিকানা দাবি করে মামলা করে
- ১৯৮১ সালে উত্তরপ্রদেশে মুসলিমদের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের ভারপ্রাপ্ত ‘সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড’ ওই জমির মালিকানা দাবি করে মামলা করে।
এই গোটা সময়পর্বেই এলাকায় স্থিতাবস্থা রক্ষিত হয়েছিল, যতদিন না ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হিন্দু করসেবকরা বাবরি মসজিদের সৌধটিই সম্পূর্ণ ধ্বংসকরে দেয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন এখানে।
এলাহাবাদ হাইকোর্টে ২০০২ সাল থেকে এ সংক্রান্ত মামলার শুনানি শুরু হয়। ২০১০ সালে হাইকোর্ট রায় দেয়।
- বিতর্কিত জমির এক-তৃতীয়াংশ যাক রামলালার প্রতিনিধিত্বকারী হিন্দু মহাসভার অধিকারে
- এক-তৃতীয়াংশ যাক নির্মোহী আখাড়ার দখলে
- বাকি এক-তৃতীয়াংশ পড়ে থাকুক ওয়াকফ বোর্ডের হাতে
২০১১ সালে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষই এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করে এবং সুপ্রিম কোর্টও পত্রপাঠ এই রায় খারিজ করে দেয়।
মসজিদের বিরুদ্ধে আবেদনকারীরা ১৯৯৪ সালের ইসমাইল ফারুকি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের বিষয়টি তুলে ধরেন, যাতে বলা হয়েছিল—মসজিদ ইসলাম ধর্মের পক্ষে অপরিহার্য নয়।
৩. মধ্যস্থতার প্রয়াস
২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট ৩ সদস্যের একটি মধ্যস্থতা প্যানেল তৈরি করে দেয়। এটি ছিল এ ধরনের পঞ্চম প্যানেল—এর আগে ১৯৯২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আদালতের তৈরি করে দেওয়া এ ধরনের ৪টি প্যানেল উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনও সমাধানসূত্রে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে।
সর্বশেষ প্যানেলটির সদস্য করা হয় সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এফ এম খলিফুল্লা, বরিষ্ঠ অ্যাডভোকেট এবং মধ্যস্থতার কাজে দক্ষ বলে মান্য শ্রীরাম পাচু এবং “আর্ট অফ লিভিং” খ্যাত ধর্মীয় নেতা শ্রী শ্রী রবিশংকর।
৮ সপ্তাহের মধ্যে এই প্যানেলের কাজ শেষ করার কথা ছিল।
আরও পড়ুন: রামজন্মভূমি মধ্যস্থতা: ৫টি বিষয় যা আপনাদের জানা দরকার
কিন্তু মধ্যস্থতাকারী প্যানেলের কাজে সন্তুষ্ট হতে না পেরে সুপ্রিম কোর্ট ৬ অগস্ট থেকে প্রতিদিন জমি বিতর্কের শুনানি শুরু করে দেয়।
৪. ৪০ দিনের সুপ্রিম কোর্ট শুনানি পর্ব
প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগই, বিচারপতি এস এ বোবদে, বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি অশোক ভূষণ এবং বিচারপতি এস এ নাজির-এর সংবিধান বেঞ্চে মামলাটির শুনানি হতে থাকে।
শীর্ষ আদালত ঐতিহাসিক ও পর্যটকদের বিবরণ খতিয়ে দেখে, ব্রিটিশ শাসকদের তৈরি করা জমির কাগজপত্র এবং ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের (এএসআই) করা জমির সমীক্ষা রিপোর্টও খতিয়ে দেখে, জানাচ্ছে লাইভ ল’।
হিন্দু আবেদনকারীদের তরফে আরও দাবি করা হয়, মুসলিমদের তো আরও অনেক ধর্মস্থান রয়েছে। হিন্দুদের আছে বলতে শুধু অযোধ্যা, এবং আর কোনও স্থানকে তারা রামের জন্মস্থান বলে মানতে প্রস্তুত নয়।
ইতিমধ্যে মাঝপথে থমকে যাওয়া মধ্যস্থতা প্যানেলের কাজও শেষ হয়েছে এবং তাদের রিপোর্টও সর্বোচ্চ আদালতের কাছে জমা পড়েছে।
রিপোর্টটি এখানে দেখে নিতে পারেন।
৫. মামলার রায় কখন আশা করা যায় ?
২৭ নভেম্বরের মধ্যে যে-কোনও দিনই মামলার রায় প্রকাশ হতে পারে। ওই দিনই প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগই অবসর গ্রহণ করবেন। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাই মামলার নিষ্পত্তি আশা করা যেতে পারে।