গত ২০ দিনে বিহারের মুজফ্ফরপুরে ১১৩ জন শিশু এলসেফেলাইটিসে (অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিনড্রোম) মারা গেছে । গোটা রাজ্যে ৫১৮ জন শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ।
বিহারের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখেছেন, সর্বশেষ ১৮ জুন শ্রীকৃষ্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সফর করেছেন । যে ভাবে নেতারা বিক্ষোভ-প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছেন এবং তাঁদের কালো পতাকা দেখানো হয়েছে, তাতে পরিস্থিতির তীব্রতা বোঝা যায় ।
একটি মৃত বালিকার বাবা সুনীল রাম রয়টারের সহযোগী সংবাদসংস্থা এএনআই-কে জানানঃ
“এখানে সুচিকিৎসার কোনও ব্যবস্থাই নেই, থাকলে আমার মেয়ে মারা যেত না ।”
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মঙ্গল পান্ডে, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন এবং স্বাস্থ্য দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার চৌবের বিরুদ্ধে একটি জনস্বার্থ মামলাও দায়ের হয়েছে ।
রোগের প্রকোপ যত বাড়ছে, মৃতের সংখ্যাও তত বাড়ছে । রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা স্পষ্টতই ভেঙে পড়ার উপক্রম । বুম এই রোগ সম্পর্কে ৫টি জ্ঞাতব্য বিষয় জানাতে চায় ।
এনসেফেলাইটিস কী?
এনসেফেলাইটিসকে ব্রেন ফিভার বা মস্তিষ্কের জ্বরও বলা হয়, স্থানীয় ভাষায় চমকি বুখার ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুসারে এনসেফেলাইটিস হল এক বা একাধিক ভাইরাসের আক্রমণে মস্তিষ্কের ফুলে ওঠা ।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লুসিল প্যাকার্ড শিশু হাসপাতাল জানাচ্ছে, এই সংক্রমণ স্পাইনাল কর্ড এবং মস্তিষ্কের ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এবং স্নায়বিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে মানসিক বিভ্রান্তি এবং খিঁচুনিও ডেকে আনতে পারে । এনসেফেলাইটিস যে-কারও হতে পারে, তবে এটা বেশি আক্রমণ করে শিশু ও বৃদ্ধদের, যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম ।
বর্তমান প্রাদূর্ভাবের চেহারা
দ্য হিন্দুর রিপোর্ট অনুযায়ী যে ১১৩ জন এই রোগে মারা গিয়েছে, তাদের সকলেই ১ থেকে ১০ বছর বয়সের শিশু । এর মধ্যে ৯৩টি মৃত্যুই ঘটেছে সরকারি শ্রীকৃষ্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, যেখান থেকে ১১৮ জন রোগীকে চিকিত্সার পর ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে । দ্য হিন্দু আরও জানিয়েছে যে, ১৯টি শিশুর মৃত্যু ঘটেছে বেসরকারি কেজরিওয়াল হাসপাতালে, যদিও গত চব্বিশ ঘন্টায় কোনও নতুন মৃত্যুর খবর নেই । পাশের জেলা পূর্ব চম্পারনে একটি মৃত্যু ঘটেছে ।
১ জুন থেকে এ পর্যন্ত ৫১৮টি এনসেফেলাইটিস সংক্রমণের খবর এসেছে, যার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ মেডিকেলে ৩৭২ জন এবং কেজরিওয়াল হাসপাতালে ১৪৬ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর আছে ।
এনসেফেলাইটিসের কারণ ও লক্ষণ
এনসেফেলাইটিসের লক্ষণ অনেক রকম হতে পারে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে এগুলি হলঃ
ধুম জ্বর, মাথার যন্ত্রণা, আলো সইতে না পারা, ঘাড় ও কাঁধ শক্ত হয়ে যাওয়া, বমি, বিভ্রান্তি এবং চরম অবস্থায় খিঁচুনি, পক্ষাঘাত ও কোমা
বুম পোস্টগ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউ অফ মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (পিজিআইএমইআর)-এর ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অরিহন্ত জৈনের সঙ্গে কথা বলেছে । তাঁর মতে ভাইরাস এবং জীবাণু এই রোগ সংক্রমণের প্রধান কারণ, কিন্তু তার প্রাদূর্ভাব নির্ভর করে রোগের এলাকা, ঋতু এবং সংক্রমণের আধিক্যের উপর l জাপানি এনসেফেলাইটিস যেমন মশার থেকে ছড়ায় । ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে ছড়িয়ে পড়া এনসেফেলাইটিস ছিল এই গোত্রের ।
আবার এনসেফেলাইটিস তাদেরও হতে পারে, যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা যারা আগের কোনও অসুখ থেকে সেরে ওঠার প্রক্রিয়ায় রয়েছে । ভারতে এই রোগের ভাইরাস ঠিক কোন উৎস থেকে উদ্ভূত হচ্ছে, ডাক্তার জৈনের মতে সেটা শনাক্ত করা যায়নি ।
লিচু খেলে কি এনসেফেলাইটিস হতে পারে?
লিচু থেকে এনসেফেলাইটিস সংক্রামিত হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন । সম্প্রতি ওড়িশায় এ জন্য বিভিন্ন ধরনের লিচু গবেষণাগারে পরীক্ষা করা শুরু হয়েছে ।
এনসেফেলাইটিসের কারণ হিসাবে লিচুকে দায়ী করে ইতিমধ্যেই ইন্টারনেটে নানা বিভ্রান্তিকর গুজব ছড়ানো হচ্ছে । তবে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, শুধু লিচু খাওয়ার জন্যই কারও এনসেফেলাইটিস হয়নি । তার সঙ্গে অপুষ্টি এবং রাতে পর্যাপ্ত খাদ্য না পাওয়া শিশুদের বিষয়টিও যুক্ত ।
২০১৭ সালে ভারতীয় ও মার্কিন চিকিত্সকদের একটি বড় দল লিচুর সঙ্গে এনসেফেলাইটিসের সম্পর্ক নিয়ে ল্যান্সেট গ্লোবাল হেল্থ পত্রিকায় একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যাতে ২০১৪ সালে এই রোগের প্রাদূর্ভাবের কার্যকারণ খতিয়ে দেখা হয় । গবেষণায় দেখা যায়, যে সব অপুষ্টি-আক্রান্ত শিশু খালি পেটে রাত্রিবেলা লিচু খেয়ে ঘুমোতে যায়, পরদিন সকালে তাদের অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি । এই অসুস্থতা ডেক্সট্রোজ নামক গ্লুকোজ জাতীয় পথ্য খাইয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।
এই অসুস্থতার কারণ মিথাইলএনসাইক্লোপ্রপিলগ্লাইসিন (এমপিসিজি) এবং হাইপোগ্লাইসিন এ নামক দুটি বিষাক্ত উপাদান, যা লিচুতে রয়েছে । এগুলি রক্তে শর্করার পরিমাণ রাতারাতি কমিয়ে দেয়, যার ফলে ওই অসুস্থতা দেখা দিতে পারে । আর রক্তে শর্করা কমে যাওয়া কিন্তু এনসেফেলাইটিসের অন্যতম লক্ষণ ।
ওই চিকিৎসাদলের ব্যাখ্যাঃ
“আমাদের অনুসন্ধান ইঙ্গিত দিচ্ছে, মুজফ্ফরপুরে এনসেফেলাইটিসের প্রাদূর্ভাবের পিছনে হাইপোগ্লাইসিন এ এবং এমপিসিজি-র ভূমিকা রয়েছে । তাই অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার কমাতে আমাদের পরামর্শ হল—লিচু খাওয়া থেকে বিরত থাকা, সন্ধেবেলা ভরপেট খাবার সুনিশ্চিত করা এবং অবশ্যই লক্ষণ দেখা দিলে গ্লুকোজ শরীরে প্রবেশ করানো ।”
অর্থাৎ লিচু খাওয়ার সঙ্গে রোগ ছড়ানোর একটা সম্পর্ক থাকলেও লিচু খাওয়াই এনসেফেলাইটিসের একমাত্র কারণ নয় ।
গবেষণাপত্রটি এখানে পড়ে দেখতে পারেন ।
অতীতের প্রাদূর্ভাব এবং সরকারি ব্যবস্থা
এনসেফেলাইটিস ভাইরাস ভারতে এই প্রথম আসছে না । ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিকেল রিসার্চের একটি পত্রে জানা যায়, ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ভারতে ৪৪ হাজার জন এনসেফেলাইটিসে আক্রান্ত হয়, যাদের মধ্যে মারা যায় ৬ হাজার, যার অধিকাংশই ঘটে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে । ২০১৪ সালেই পশ্চিমবঙ্গে এনসেফেলাইটিসের সংক্রমণে জানুয়ারি থেকে অগস্টের মধ্যে ২৫৪ জনের মৃত্যু হয় । ২০১৭ সালে তথ্য জানার অধিকার আইন প্রয়োগ করে সংবাদসংস্থা ফার্স্টপোস্ট জানায়, ওই বছর ১২ হাজার ৫৭৮টি সংক্রমণের ঘটনা নথিভুক্ত হয় । শুধু উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরেই কুখ্যাত বাবা রাঘব দাস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩০৯ জন এনসেফেলাইটিসে মারা যায় ।
তবে ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জাপানি এনসেফেলাইটিস নির্মূল করতে ‘দস্তক অভিযান’-এর সূচনা করেন । সরকারি অফিসাররা সংক্রমণ-প্রবণ ৩৮টি জেলায় বাড়ি-বাড়ি ঘুরে রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করেন এবং টিকাকরণের ব্যবস্থা করেন ।
বিহার সরকারও এখন ক্ষতি মেরামত করতে নেমেছে l চিকিত্সার ব্যাপ্তি ঘটানো এবং পদ্ধতিগত জটিলতা হ্রাস করতে ততপর হয়েছে । মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার শ্রীকৃষ্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরেজমিনে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিচ্ছেন । কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীও রবিবার হাসপাতাল পরিদর্শন করেন ।
দয়ানন্দ এবং পাটনা মেডিকেলকলেজ ও হাসপাতাল থেকে অতিরিক্ত চিকিত্সক এনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে । সরকার হাসপাতালে যাতায়াতের জন্য মাথা-পিছু ৪০০ টাকা এবং মৃতদের জন্য মাথা-পিছু ৪ লক্ষ টাকা এককালীন ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে ।
এই প্রতিবেদনটি জনসাধারণের অবগতির জন্য এবং আদৌ পেশাগত চিকিৎসা পরামর্শের বিকল্প হিসাবে গণ্য হওয়ার নয় ।